স্মৃতির পাতায় নিয়ে এলাম একখণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সিডনিতে পালিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ হলের শতবর্ষপূর্তি উৎসব। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়া। ব্ল্যাকটাউন সিটি কাউন্সিলের মিলনায়তনে ১৯ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে এতে সপরিবার অংশ নেন ঢাবি ও জগন্নাথ হলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। আমিও পরিবারসহ অংশ নিই।
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু
শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে প্রায় দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আমরা পৌঁছে যাই সিডনি শহরে। আগে থেকেই বুক করা ছিল হোটেল নভোটেল। হোটেলে ওঠার আগেই আমরা সিডনিতে ডিনারের বিশেষ নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম এক আত্মীয়ের বাসায়। বাহারি দেশি খাবারের আয়োজন যেন দীর্ঘ যাত্রা শেষে আমাদের ক্ষুধার মাত্রাকে তীব্রতর করেছিল। হোটেলের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা যখন ঘুমাতে যাই, তখন রাতের মধ্যপ্রহর। অনেক ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ হলের শতবর্ষপূর্তি উৎসব। ঈশ্বরকে বলি, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু!’

সুবর্ণজয়ন্তীর রঙে বর্ণিল ব্ল্যাকটাউন সিটি কাউন্সিলের মিলনায়তন

ব্ল্যাকটাউন সিটি কাউন্সিল মিলনায়তন সেদিন সেজেছিল সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ণিল সাজে। এ যেন একখণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! এ যেন ফিরে পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুরন্ত তারুণ্য। নবীন আর প্রবীণের এ মিলনমেলায় যেন সবাই ফিরে পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তারুণ্য। অনেকেই আবেগে কেঁদেছেন, হেসেছেন, আলিঙ্গন করেছেন একে অপরকে প্রাণের এ মিলনমেলায়। মিলনায়তনের মূল ফটকে স্থাপন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাসের রেপ্লিকা। এরপর মিলনায়তনে ঢোকার প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রতীক অপরাজেয় বাংলা। মিলনায়তনটি ছিল চমৎকারভাবে সাজানো। অতিথিদের জন্য ছিল জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার। মূল মঞ্চ সাজানো হয় ১০০ লেখা বৈদ্যুতিক আলো দিয়ে। এ থিমের রূপকার ছিলেন জগন্নাথ হলের বড় দাদা বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, বর্তমানে কমনওয়েলথ ব্যাংকে কর্মরত। তিনি এ অনুষ্ঠানের একজন পৃষ্টপোষক ছিলেন। অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হয় মঙ্গলসূচক সংগীত দিয়ে। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে’ কবিগুরুর এ গানের সঙ্গে মঞ্চের সামনে এগিয়ে আসেন দশ নারী।

মিলনায়তনের বাইরে ছিল প্রচুর ফ্রি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এ আয়োজন মেতে উঠবেন, তা কী করে হয়? ছোটদের জন্য আয়োজন করা হয় বিশেষ ফেস পেইন্টিংয়ের। বেলুন দিয়ে তৈরি জীবজন্তুর নানা রকম নকশা আর আকৃতি ছোটদের মাতিয়ে রেখেছিল উৎসবের আমেজে। সব অতিথির জন্য নানা রকম দেশীয় খাবারে সাজানো হয়েছিল রাতের আয়োজন।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম সেরা একটি ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলা। বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যয় ও সত্যের প্রতীক এ অপরাজেয় বাংলা। বাংলার নারী-পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বিজয়ের প্রতীক এ ভাস্কর্য। অপরাজেয় বাংলার তিনটি মূর্তির সর্বডানে প্রত্যয়ী এক যোদ্ধা নারীর মূর্তি। রাইফেল কাঁধে, ডান হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা এক যুবক যোদ্ধা। সবার চোখে-মুখে স্বাধীনতার দৃপ্ত চেতনা।

শতবর্ষপূর্তির এ অনুষ্ঠানে আয়োজকেরা যেন স্বাধীনতার দৃপ্ত চেতনাকেই ফিরিয়ে এনেছেন সিডনির ব্ল্যাকটাউন মিলনায়তনে। বিজয়ের মাসে শতবর্ষপূর্তির আয়োজনে অপরাজেয় বাংলার রেপ্লিকা যেন অতিথিদের জানিয়েছে সাদর সম্ভাষণ। সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে ক্লাস থাকার সুবাদে অনেকেই হয়তো কম গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার কাছে। কিন্তু এখানে অপরাজেয় বাংলার রেপ্লিকায় ভোলেননি ফটোসেশন করতে। এ ফটোসেশন শেষে অনেকেই ফেসবুকে ছবি পোস্ট করতে ভোলেননি। আমিও করেছি, অনেকেই জানতে চেয়েছেন, আমি বাংলাদেশে গেছে কি না!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস শুধু একটা বাস নয়, এ ছিল তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ভরা স্বপ্নময় গল্প। এ লাল বাস আহামরি কিছু নয়, বাসে নেই কোনো এসি! নেই বসার কোনো ভালো আসন। ছাত্রছাত্রীদের বাদুড় ঝোলার মতো যেতে হয় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। তারপরও এই লাল বাসের কদর কমেনি কখনো। যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে চেয়েছেন, কিন্তু পড়তে পারেননি, এই লাল বাস দেখলেই হয়তো তাঁদের স্বপ্নের কথা মনে পড়বে। লাল বাস আসলেই একটি স্বপ্ন। ঢাকার বুক চিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাসগুলো কেবল দাপিয়েই বেড়ায় না, বরং স্বপ্নও ফেরি করে বেড়ায়। এ বাস স্বপ্ন ফেরি করে দেশজুড়ে, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

এ অনুষ্ঠানের অন্যতম সেরা আকর্ষণগুলোর মধ্যে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব লাল বাসের রেপ্লিকা। এ রেপ্লিকা মিলনায়তনের প্রবেশমুখেই অতিথিদের নিয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই তারুণ্যে ভরা দিনগুলোয়। হলে থাকার সুবাদে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই লাল বাসে উঠতে পারেননি অনেকেই। কিন্তু অনুষ্ঠানে সেই লাল বাসের রেপ্লিকার সুবাদে অনেকেই ফটোসেশন করতে ভোলেননি। সুযোগটি হাতছাড়া করিনি আমিও। পরিবারসহ উঠেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাল বাসের রেপ্লিকায়। ফটোসেশন করতে করতে মনে হয়েছে, আমি ফিরে গেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বাসস্ট্যান্ডে, যেখানে চৈতালি, বৈশাখী, শ্রাবণী, ক্ষণিকাসহ বিভিন্ন নামের বাসগুলো দাঁড়িয়ে থাকত। আমার অনুভূতিতে যেন জাগল নতুন করে স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প।

ম্যাগাজিন ‘গৌরবের এক শ বছর’

অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়া (JHAAA) প্রকাশ করেছে ‘গৌরবের এক শ বছর’ নামের একটি ম্যাগাজিনও। শতবর্ষপূর্তিতে এই ম্যাগাজিনে লিখেছেন অনেক প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, প্রশাসক, গবেষক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ এবং জগন্নাথ হলের প্রাক্তন ছাত্র ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। দেশের বরেণ্য বহু ব্যক্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রসহ অনেকেই সমৃদ্ধ করেছেন ম্যাগাজিনটিকে। ম্যাগাজিনটির জন্য বাণী পাঠিয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আক্তারুজ্জামানসহ অনেকেই। ম্যাগাজিনটি উৎসর্গ করা হয় তাঁদের, যাঁরা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে একাত্তরপূর্ব সময়ে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে যেসব মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন এবং ১৯৮৫ সালে জগন্নাথ হলের অ্যাসেম্বলি ভবনের দুর্ঘটনায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন। প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার সমৃদ্ধ ম্যাগাজিনটি সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন নিকেশ নাগ।

স্মৃতিচারণে নানা রঙের দিনগুলি

নানা রঙের দিনগুলি ধীরে ধীরে অতীত হয়ে ফিরে আসে। কালের যাত্রায় ম্লান হয়ে যায় সব রং। একসময় আমরা হারিয়ে যাই চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে। তবু স্মৃতিচারণ যেন ফিরে ফিরে নিয়ে যায় সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে। স্মৃতি রোমন্থনের সুখ যেন কখনো কখনো হয়ে ওঠে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের স্পর্শ! রাতের খাবার খেতে খেতে স্মৃতিচারণে অনেকেই ফিরে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নানা রঙের দিনগুলিতে! অনেকেই বলেছেন, জগন্নাথ হলের ফেলে আসা দিনগুলো কেমন কেটেছে। জগন্নাথ হলের পূজা, ক্যানটিনের খাবার, সবজি, পাতলা ডাল, খাসির মাংস আর নানা রকম উৎসবের স্মৃতিমন্থন করতে করতে অনেকেই হয়ে গিয়েছিলেন স্মৃতিকাতর। অনেকেই খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের প্রেমিককে এই হলের মাঠে, মন্দিরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল তৈরি করেছে অনেক প্রেমিক। তাই তো এ হলের শিক্ষার্থী না হয়েও শিক্ষার্থীর প্রেমিকা হয়ে গর্ববোধ করেছেন আগত অতিথিদের অনেকেই।
‘এই কথাটি মনে রেখো’ গান আর নাচের তালে অ্যালামনাই সদস্যদের এক স্মৃতিময় সন্ধ্যা!

শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের এ অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ছিল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো এক স্মৃতিময় সন্ধ্যা। সুর আর গানের মূর্ছনায় ভেসেছিলাম আমিসহ আগত অতিথিরা। গানের তালে তালে নেচেছি আর বারবার হারিয়ে গিয়েছি যৌবনের ফেলে আসা দিনগুলোয়। একসময় ছন্দ থেমে যায়, গান থেমে যায়। কিন্তু থেমে থাকে না জীবনের নিরন্তর ছুটে চলা। ছুটে চলা মানেই হলো জীবন, প্রাণের স্পন্দন। একসময় ফুরিয়ে আসে কোলাহল। রাত গভীর হয়। শেষ হয়ে যায় প্রাণের মিলনমেলা। শেষ হয় অনুষ্ঠান। আবার ফিরে যেতে হবে আমার গন্তব্যে—জীবন ও জীবিকার তাগিদে। তবু শান্তি—আমি গিয়েছিলাম জগন্নাথ হল আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনমেলায়। হেসেছি, কেঁদেছি, আলিঙ্গন করেছি জীবনের এ বেলায়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
‘এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এ হাসি খেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।
শুকনো ঘাসে শূন্য বনে আপনমনে
অনাদরে অবহেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।’
গাদা গাদা ভালোবাসা আর স্নেহ নিয়ে ফিরে এলাম মেলবোর্নে। কিন্তু স্মৃতিতে আমার এখনো ভাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জগন্নাথ হলের শতবর্ষপূর্তি উৎসব, ব্ল্যাকটাউনের মিলনায়তন। ঘুমের ঘোরে আমার বারবার কেবলই মনে হয়, আমি যেন নিয়ে এসেছি একখণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।