স্মৃতিতে মনবুশো স্কলারশিপ
মনবুশো স্কলারশিপের নামটা প্রথম কানে ঢোকে ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারের দিকে। হলের সিনিয়র ভাইয়েরা দুই-একজন পেয়ে যাওয়া মানেই প্রতি রুমেরই টকশোর টপিকসে মনবুশো ছাড়া অন্য কোনো টপিকস পাত্তা পেত না। হল চত্বরের আকাশে-বাতাসে তখন একটাই শব্দ আর সেটা হলো মনবুশো। মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মেসি ও বায়োকেমিস্ট্রি থেকেই স্কলারশিপ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নাম বেশি শোনা যেত। বায়োকেমিস্ট্রি থেকে অ্যাপ্লাইড ফিজিকসে অটোমাইগ্রেড হওয়া নৈরাশ্যবাদী আমিও তাই মাঝে মাঝে কষ্ট পেতাম। মনে মনে ভাবতাম ইশ্...।
শাহিদা ম্যাডাম একদিন কী কারণে যেন মনবুশো স্কলারশিপের নামটার উচ্চারণের ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। উচ্চারণ করলেন ঠিক এভাবে—মনবু...শো। খুব কষ্ট করে ‘বু’ উচ্চারণের সময় নাক দিয়ে জোরটা একটু বেশি দিয়ে শেষে কিছু বাতাস ছেড়ে দিলেন। মনোযোগ দিয়ে শুনলেও মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিল, নাম দিয়ে কী হবে, একটা কিছু হলেই হলো। মনে পড়ছিল কারমাইকেল কলেজের বাংলার স্যার মাজহারুল মান্নানের বাংলা ভাষায় বিবর্তনের একটা উদাহরণের কথা। ইংরেজদের box কীভাবে বাংলা ভাষায় ঢুকেছিল। box থেকে বাক্স। স্যার মজা করে বলেছিলেন গ্রামে box-কে ঢাক্স বলা হয়। তাই মনবুশো হোক আর মনবু...শো হোক স্কলারশিপ স্কলারশিপই। পরে জেনেছিলাম ম্যাডামও নাকি একই স্কলারশিপ হোল্ডার ছিলেন। পরবর্তীতে জাপানে এসে নামের গুমর উদ্ধারের চেষ্টা করি। জাপানিদের লম্বা শব্দে অ্যালার্জি আছে। লম্বা শব্দকে কেটে ছিঁড়ে ছোট না করা পর্যন্ত ওদের স্বস্তি নেই। তাইতো মনবুকাগাকুশো (文部科学省) ) হয়েছে মনবুশো। আর সেটা আমরা বানিয়েছি মনবসু। আমাদের দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু শিক্ষাটাই ঠিকমতো দেখতে না পারলেও এদের এই মন্ত্রণালয় শিক্ষাতো ভালোভাবে দেখেই পাশাপাশি কালচার, স্পোর্টস ও টেকনোলজিও দেখে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোলাম, বিয়েও করেছি এর মধ্যে। আমরা দুজনই বিসিএসের প্রস্তুতি নেই চাকরি করার পাশাপাশি। আমি একটা দুটো টিউশনিও করি। মোহাম্মদপুরে বাসা, তাই শুক্রবার মানেই আমরা কপোত-কপোতী সংসদ ভবনের পরিচ্ছন্ন জায়গাগুলোকে বাদামের খোসা দিয়ে নোংরা করতে করতে আগামী দিনগুলোর পরিকল্পনা করি। সহধর্মিণীর মেজ দুলাভাই মনবুশো স্কলারশিপ নিয়ে সপরিবারে তখন জাপানে। গিন্নির আশা যদি আমার হয়! চরম পেসিমিসটিক আমার কল্পনাতেও ছিল না যে আমি পিএইচডি করব তাও আবার স্কলারশিপ নিয়ে! কিন্তু গিন্নি হাল ছাড়েনি। বলা যায় ওর চেষ্টাতেই আজ মনবুশো নামটার গুমর উদ্ধার করতে পেরেছি।
অনেক দিন আগের কথা, অথচ মনে হয় এইতো সেদিন। এর মধ্যে কতগুলো বছর যে পার করলাম। চাইনিজ ক্যারেক্টার দিয়ে মনবুশো লেখাটা পর্যন্ত লিখতে পারি। বর্তমানে মনবুশোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক না থাকলেও ছেলের খবর এখনো মনবুশো রাখে। ছেলে মনবুশোর সাপ্লাইকৃত বই দিয়েই পড়াশোনা করছে।
ইমেইলে মনবুশোর সিলেকশনের ম্যাসেজটি পড়ার মুহূর্ত, মেজ ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জাপানে আসার শপিং, প্লেনে উঠে বিলু ভাইয়ের সঙ্গে কান্নাকাটির শেয়ার, সবকিছুই জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে। সিনেমার মতো ফ্ল্যাশব্যাকের দরকার পড়ে না।
টাইফুনের কারণে প্লেনের লেট ফ্লাই, রিসিভ করতে কারও না আসা, যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা, জাপানে আমার অভ্যর্থনাটা মোটেই সুখকর ছিল না। প্রথম জাপানে ঢোকা, তাই ইমিগ্রেশনে একটু বেশি সময় নিয়েছিল। নিষিদ্ধ জিনিস খুঁজতে গিয়ে বাঙালির প্রিয় (আমার খুব) মিষ্টির ডিব্বাটা বের করল। বোকার মতো মিষ্টি অফার করেছিলাম দায়িত্বরত অফিসারকে। এখনো মাঝে মাঝে হাসি সেই সময়কার বোকামির কথা চিন্তা করে। ভাগ্যিস কোনো জরিমানা ঠুকে দেয় নাই।
রিসিভ করতে একজন আসবেই, এই চিন্তা মাথায় ছিল। না আসলে কী করতে হবে সে চিন্তা বা প্ল্যান কোনোটায় করি নাই। দ্বিতীয় অপশন যে রাখতে হয়, যখন বাঙালি গোছের কাউকে পেলাম না তখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। আমার হাই পাওয়ারের চশমার গ্লাস তিন চারবার মুছেও যখন কাউকে না পেয়ে মন খারাপ করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই দেখলাম, আমার লম্বা নামটি লেখা প্লাকার্ড হাতে লম্বা এক জাপানিজ মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা জাপানিজ টু ইংলিশ ডিকশনারি। মূকাভিনয়, অঙ্গাভিনয় করে যেটুকু বুঝলাম তার সারমর্ম হলো টাইফুন সব শিডিউলের বারোটা বাজিয়েছে। মেয়েটা ওসাকার লোকাল। প্রফেসরের অনুরোধে আমাকে আমার গন্তব্যে যাওয়ার যানে উঠানোর ব্যবস্থা করে দিতে এসেছে।
জাপানিরা টাইফুনকে প্রচণ্ড ভয় পায়। তাই প্রায় সব যানবাহনই টার্মিনালগুলোতে বসে আবহাওয়ার অবস্থান বুঝে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সার্ভিসে যাবে কী যাবে না। মেয়েটিকে বেশ অ্যাকটিভ মনে হলো। এখানে সেখানে ফোন করে জানাল যে স্পিড ফেরিতে যাওয়া যাবে। তবে তার আগে ট্রেনে করে ফেরি টার্মিনাল যেতে হবে। আমাকে সে ফেরি টার্মিনাল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বাকিটুকু আমাকে ম্যানেজ করতে হবে।
গিন্নির চাপে ভাষা ইনস্টিটিউটের জাপানিজ ল্যাংগুয়েজ ক্লাসে দুই-চার দিন গিয়েছিলাম। ‘ওহাইও গোজাইমাস’ শুধু বলতে শিখেছিলাম। জাপানিজ ভাষাজ্ঞান শুধু সেটুকুই। প্রফেসর অবশ্য গন্তব্যস্থলে রিসিভ করবে। জাপানে তখন অক্টোবরের মাঝামাঝি। শীত জাপানিদের জন্য আসি আসি করছে আর আমার মনে হচ্ছে আমি দক্ষিণ মেরুতে অবস্থান করছি। বঙ্গ বাজারের সবচেয়ে মোটা জ্যাকেটটা গায়ে আছে তবু ঠকঠক করে কাঁপছি। ফ্লাইওভার বা উড়াল সেতুর নাম শুনেছিলাম, সিনেমাতেও দেখেছি, কিন্তু স্বচক্ষে দেখে নিজের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে সন্দেহ হচ্ছিল। মাথার ওপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছিল, পায়ের নিচ দিয়ে বাস, একটু দূরেই প্লেনগুলোকে উড়তে দেখলাম, তাই আমার অবস্থান মাটিতে, আন্ডারগ্রাউন্ডে, নাকি বাতাসে স্থির করতে পারছিলাম না। মেইন লাগেজের চাকাতো জিয়া (এখনকার শাহজালাল) বিমানবন্দরেই ভেঙে গেছে, তাই ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ব্যাগগুলোকে নড়াচড়া করতে।
ঝক্কিঝামেলা শেষে স্পিডি ফেরিতে উঠে বসলাম। জাহাজ চলতে শুরু করাতেই বুঝলাম কেন এরা এত বড় জাহাজটাকে স্পিডি নাম দিয়েছে। পানির ওপরে জলযানগুলো (বিশাল আকৃতির) যে এত দ্রুত চলতে পারে তা চোখে না দেখে বিশ্বাস করা সত্যিই মুশকিল। চেক-ইন, ইমিগ্রেশন, টেনশন সবকিছুর কারণে লাস্ট দেড়দিন দেশের কথা, দেশের প্রিয়জনদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। সমুদ্রের নীল পানি দেখতে দেখতে চোখ দুটো দিগন্তের দিকে স্থির হয়ে ঝাপসা হয়েছিল। বুঝলাম আমি দেশ থেকে বহু দুরে। দেশ আমাকে রাখল না, নাকি আমিই দেশকে ছেড়ে আসলাম। এই সব আজগুবি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাইনি। স্বপ্নের ঘোরে এক যুগেরও বেশি পার করলাম। পেছনে তাকানোর সময় নেই। এ দেশটা আমাকে কিংবা আমার পরিবারকে গ্রহণ করেছে কিনা জানা নেই। হৃদয়ে পুরোটাই বাংলাদেশ তারপরেও হৃদয়ের কিছু কিছু গহ্বরে এ দেশটার প্রতি মায়া জন্মেছে।