স্মৃতিতে নজরুল
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে নাচ, গান, আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, তাই বাধ্যবাধকতা ছিল না। মনে পড়ে, তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি। কাজী নজরুল ইসলাম রচিত জনপ্রিয় কবিতা ‘প্রভাতী’ আবৃত্তি করি। এমন সুন্দর ছন্দের কবিতা আগে পড়িনি। সেদিন থেকে কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন আমার প্রিয় কবি।
পরবর্তী সময়ে আমার আগ্রহ জন্মাল গানের প্রতি। গুরু হিসেবে পেলাম শ্রদ্ধেয় শিল্পী শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র এবং শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে। শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের প্রিয় শিল্পী এবং শিষ্য। তিনি আমাকে প্রথম যে গানটি শিখিয়েছিলেন তার প্রথম লাইনটি হলো, ‘আজও কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া’। হাম্বীর রাগাশ্রিত গানটির রচয়িতা এবং সুরকার হলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
কালক্রমে নজরুলের কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধের সঙ্গে গানের ভেতর দিয়ে প্রথমে পরিচয়, পরে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলাম। আমিই এই বাড়ির প্রথম পুত্রবধূ। শ্বশুর বাবা এবং শাশুড়ি মা দুজনেই অসুস্থ। পরিবারে প্রাচুর্য ছিল না, কিন্তু আনন্দ ছিল। শ্বশুর বাবা মানসিকভাবে অক্ষম হলেও শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন। সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াতেন। আবার ক্লান্ত হলে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট শোয়ার জায়গায় শুয়ে পড়তেন। শাশুড়ি মায়ের শরীরের নিচের অংশ কোমর থেকে অবশ হয়ে গিয়েছিল। শরীরের ওপরের অংশ সুস্থ ছিল। স্বল্প উঁচু একটা চৌকিতে শুয়ে পাশ ফিরে অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় বাবাকে খাইয়ে দিতেন, সবজি কাটতেন, আমাদের খেতে দিতেন। শ্বশুর বাবা যখন হারমোনিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাসিমুখে শব্দ করে তাকাতেন, তখন বুঝতাম গান শুনতে চাইছেন। গান শুরু করলে শব্দ করে হাসতেন।
এভাবে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। অকালে আমাদের ছেড়ে মহাপ্রস্থানের পথে রওনা দিলেন আমার স্বামী অনিরুদ্ধ। তিন পুত্র–কন্যা অনির্বাণ, অরিন্দম, অনিন্দিতাকে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়লাম। নজরুলসংগীতকে অবলম্বন করে জীবনযুদ্ধে নতুন করে যাত্রা শুরু করলাম।
আজ ছেলেমেয়েরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম। নাতি-নাতনিরাও তাদের কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এই ৮৫ বছর বয়সে বড় একা লাগছিল। এমন সময় ছায়ানট কলকাতার কর্ণধার সোমঋতা আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে এল কাজী নজরুল ইসলামের শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা বেশ কিছু জনপ্রিয় ও স্বল্পপরিচিত ছড়া, কবিতা রেকর্ড করার জন্য। ছায়ানট (কলকাতা) দীর্ঘদিন ধরে কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্মকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু কাজ করে চলেছে। এই কাজের সঙ্গে আমিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ায় কাজটি করতে রাজি হয়ে গেলাম। ‘ঘুম পাড়ানী গান’, ‘প্রভাতী’, ‘কালো জামরে ভাই’, ‘শিশু সওগাত’, ‘প্রার্থনা’সহ মোট পঁচিশটি ছড়া, কবিতা আমার কণ্ঠে রেকর্ড করেছি। আমি উপলব্ধি করলাম, শিশুসাহিত্য রচনায় বাবা শ্বশুরের কী সহজ, স্বচ্ছন্দ বিস্তার। প্রথমে ভয় পেলেও পরে নির্বাচিত ছড়া এবং কবিতাগুলো আবৃত্তি করতে গিয়ে ছোট্ট সোনামণিদের হাসি মুখগুলো মনে পড়ায় প্রেরণা পেলাম। ওরা খুশি হলে, সেটাই আমার পরম প্রাপ্তি। অভিভাবকদের মাধ্যমে কাজটি বাচ্চাদের কাছে পৌঁছে যাবে, এ বিশ্বাস আমার আছে।
লেখক: কল্যাণী কাজী, কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ, নজরুলসংগীতশিল্পী ও লেখক, কলকাতা, ভারত।