স্বার্থপর ভালোবাসা

লেখিকা
লেখিকা

সদ্য রান্না করা গরম ভাতের ধোঁয়া দেখে সারা দিন পর ঠোঁট জোড়া দুদিকে খানিকটা প্রসারিত হলো৷ উফফ! রান্না শেষ। প্রচণ্ড ক্লান্তি আর অবসন্নতায় গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। কী এমন অহামরি কাজ করলাম, শুধু ভাতটাই তো রাঁধলাম। আপনাআপনি ডান হাতটা কপালে চলে গেল, ইশ! শরীরের বাড়াবাড়ি তাপমাত্রা জানান দিচ্ছে অসুস্থতার৷ মুখের ভেতর বিশ্রী তেতো একটা স্বাদ।
না চাইতেই আপনাআপনি অসুস্থ শরীরের সুস্থ মনটা উড়াল দিল দেশে৷ তার তো আর আমার মতো টিকিটের বাঁধাধরা গণ্ডি নেই।
আগে অসুখে পড়লে বিনা নোটিশে আব্বুকে টপকে আমিই হয়ে যেতাম বাড়ির হর্তাকর্তা। আমার কথামতোই খাবারের মেন্যু সাজানো হতো, টিভির রিমোটটাও থাকত আমার দখলে৷ কিছু লাগলে শুধু আওয়াজই যথেষ্ট৷ আপু ও ভাইয়ার সঙ্গে সব রকম কম্পিটিশনে তখন আমিই অঘোষিত ফার্স্ট। আব্বু-আম্মুর সব মনোযোগ আর ভালোবাসার একমাত্র দাবিদার তখন আমি৷ আব্বু অফিস যাওয়ার আগে জানতে চাইত, ‘কিছু খাবা, কী আনব?’ কত ব্যাপার স্যাপার। সেই ছোট্টবেলায় কতিপয় বেনিফিটের আশায় কতবার যে সুস্থ হয়েও অসুস্থ হওয়ার ভান করেছি, তার হিসাব না করাই ভালো।
স্মৃতিগুলো কত স্পষ্ট। কিন্তু সময়টা বড্ড বেয়াড়া স্মৃতির আঁচড় কেটে খুব দ্রুত পালিয়ে যায়।
আজ এ অবেলায় একজনের হাতটা ধরতে খুব বেশি ইচ্ছা করছে৷ যিনি কিনা বিনা পারিশ্রমিকে বছরের পর বছর ধরে আমদের বাড়িতে কাজ করেন। কি অদ্ভুত এই ‘মা’ পোস্টের চাকরিটা৷ সারাটা জীবন শুধু দেওয়া আর দেওয়া, কিন্তু পাওয়ার খাতাটা শূন্য।
অনেক বেশি স্বার্থপর আমি৷ আদরের লোভ আর কাজের ভয়ে হয়তো তোমাকে অনেকটা বেশিই মিস করছি ঠিক যেমন, শরীর খারাপ হলে বা বিপদে পড়লেও আল্লাহর দয়াটা অনেক মিস করি।
খুব মনে আছে, একবার আমার জ্বর হয়েছিল৷ অনেক জ্বর, গা থেকে যেন আগুন বের হচ্ছিল৷ কান্নাকাটি করে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি মনে নাই৷ সকালে ঘুম ভেঙে দেখি আমি ঘেমে একাকার৷ গায়ে জ্বর প্রায় নেই বললেই চলে। আম্মু ঠিক তখনো আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। খুব বিরক্ত হয়ে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘উফফ! এভাবে ধরে আছো কেন?’ আমার কপালে হাত দিয়ে একটু খুশি হয়ে আম্মু বলল, ‘তু-ই তো ধরলি, যদি তোর ঘুম ভাঙে, এই জন্য সরাই নাই।’
আরেকবার আম্মুর সঙ্গে ঘুমিয়েছি, সে রাতে আম্মুর ভীষণ জ্বর, ঘুমের মাঝে অজান্তেই আম্মুর হাতটা আমার গায়ের ওপর এলে দেখি কী তাপ! আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আর থাকতে না পেরে অতি সাবধানে আম্মুর হাতটা পাশে রেখে খানিক পরই ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠে দেখি আম্মু রান্নাঘরে৷ খুব মেজাজ দেখিয়ে বললাম, ‘জ্বর নিয়া এইখানে কী করো?’ আম্মু বলল, ‘নাশতা বানাই। ক্লাসে যাবি না, কখন না কখন আসবি, সারা দিন না খেয়ে থাকবি নাকি?’...এইটাই মা, এখানেই পার্থক্য।
আজ খুব চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, আম্মু কোনো ভান করছি না, সত্যিই আজ এই স্বার্থপর আমিটার গায়ে খুব জ্বর...একটু কপালে হাতটা দিবা, বেশি না একটু...৷