স্বাভাবিক হোক জীবন

খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জিকায় ২০২০ সম্ভবত অন্যতম দীর্ঘ বছর হিসেবেই পরিগণিত হবে। অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার হওয়ায় এমনিতেই বছরটির দৈর্ঘ্য বড় ছিল অন্য বছরগুলোর তুলনায়। কিন্তু তাকে যেন এক অফুরান দৈর্ঘ্য দিয়ে দিয়েছিল করোনাভাইরাস মহামারি। জরা ও মৃত্যুর এমন মঞ্চায়ন বহু বছর বিশ্ব দেখেনি। কে আক্রান্ত হয়নি এই মহাদুর্যোগে? সবাই, সব দেশ, সব জাতি আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুর হিসাব গুনতে বহু দেশকেই হিমশিম খেতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বছরটিকে ভুলে যেতে চাইবে মানুষ।

মানুষ সেই কবে থেকেই উদ্‌গ্রীব হয়ে বসে আছে ২০২১ সালের জন্য। কোনো একটি বছরের জন্য এত উদগ্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আর কবে বসে থেকেছে মানুষ? ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সময়টাও কি এমন ছিল? সে সময়ও হয়তো মানুষ ১৯১৯ সালের জন্য অধীর আগ্রহে বসেছিল। ভেবেছিল নতুন বছর এসে পুরোনো বছরের সব শোক-তাপ মুছে দিয়ে যাবে। ভেবেছিল নতুন বছরের নতুন সকালের সূর্যের আলো এসে পৃথিবীর মাটি ছুঁলেই বুঝি সব দুঃখ-জরা মুহূর্তে মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়। সেবার তেমনটা হয়নি। এবার কি হবে? মানুষ কিন্তু অপেক্ষায় আছে। আছে কান্না পোষা বুকে আশার বাতি জ্বালিয়ে।

বৈশ্বিক এই মহামারিতে সারা বিশ্বের ৮ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এখন পর্যন্ত। মারা গেছে ১৭ লাখ ৯৩ হাজারের বেশি মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এ মৃত্যুর সংখ্যা এরই মধ্যে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটির কাছাকাছি। বাংলাদেশের অবস্থাও ভালো নয়। এরই মধ্যে সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষকে হারিয়েছি আমরা। গত মার্চে প্রথম ঢেউ কেটে উঠতে না উঠতেই আছড়ে পড়েছে দ্বিতীয় ঢেউ, যাকে এখন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ‘ভাইরাসের সুনামি’ আখ্যা দিচ্ছেন। হ্যাঁ, ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে মানুষ নিজের শক্তিটি দেখিয়েছে। এখনো লড়ে যাচ্ছে দাঁতে দাঁত চেপে। এরই মধ্যে বিশ্বের ইতিহাসে দ্রুততম সময়ে তৈরি করা টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দেশে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠানের তৈরি টিকা। কিন্তু এই সবকিছু দিয়েও ভাইরাসটির পায়ে বেড়ি পরাতে পারছে না মানুষ। বরং নতুন আতঙ্ক হিসেবে সামনে হাজির হয়েছে, ভাইরাসটির বিবর্তিত নতুন রূপ, যা আগেরটির চেয়েও ভয়াবহ। এরই মধ্যে ভাইরাসটির নতুন এই স্ট্রেইন পাঁচ মহাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে।

এই করোনা বাস্তবতাতেই মানুষ পুরো বছর হাঁসফাঁস করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্কিন নির্বাচন নিয়ে চলা নাটকীয়তা। করোনা স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ফেলেছিল সবাইকে। আর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিনদের ফেলেছেন রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলার অনিশ্চয়তায়। গত ৩ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তার ফল এখনো মেনে নেননি তিনি। বরং হোয়াইট হাউসে আরও চার বছর থাকতে নানা গলি-ঘুপচি খুঁজছেন তিনি। এমনকি সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন দেওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়েও বৈঠক করেছেন ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে সর্বোচ্চ কঠিন করার চেষ্টা করছেন। জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পররাষ্ট্র ও সামরিক খাতের নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাইডেনের দলকে দেওয়ার কথা থাকলেও দিচ্ছেন না। এমনকি করোনায় চরম বিপর্যস্ত দেশের নাগরিকদের জন্য ফেডারেল সহায়তার বিলে সই করতেও বিলম্ব করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিনদের আরও বিভাজিত এবং আরও বিপর্যস্ত করতে সবকিছুই করছেন, যা এমনকি ২০ জানুয়ারি অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা নতুন প্রশাসনকেও ভীষণ ভোগাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

মার্কিনদের জন্য সুখবর হচ্ছে এটুকুই, আগামী মেয়াদে তাদের অন্তত ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো অননুমেয় প্রেসিডেন্টকে দেখতে হবে না। সঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বড় সাফল্য এলে তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই বড় সুসংবাদ হয়ে আসবে। আগামী ২০২১ সাল যেন এমনই এক সুখবর এনে দিতে পারে আমাদের। এই জরা ও দুঃখের সমাপন রেখাটি যেন এই নতুন বছরের শুরুতেই দৃষ্টিগোচর হয়। যেন আরও অনেক মৃত্যু দেখার আগেই মানুষ এই মহামারি জয় করতে পারে। শুভেচ্ছা সবাইকে। শুভ হোক খ্রিষ্টীয় নতুন বছর।