স্বর্গীয় সৌন্দর্য চেরি ফুল

গুচ্ছবদ্ধ চেরি ফুলগুলো প্রধানত গোলাপি, সাদা ও লাল রঙের। পাপড়ি ও ফুলের গড়নও বিচিত্র। চেরি ফুল ভালোবাসার সৌরভ ছড়াচ্ছে কোরিয়াজুড়ে
ছবি: লেখক

বিদায় নিয়েছে কনকনে শীত। একপশলা বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলেছে তার আপন রূপে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে মৃতপ্রায় পাতাহীন গাছের ঢালগুলো। কোমল বাতাস ও সুন্দর ফুলের সঙ্গে উষ্ণ আবহাওয়া প্রকৃতির শান্ত-স্নিগ্ধ-অপ্রতিম মুগ্ধতার গন্ধে বলে দিচ্ছে দরজায় কড়া নাড়ছে বসন্ত। কোরিয়ানরা অপেক্ষায় থাকেন এই বসন্তের জন্য। কারণ, কোরিয়ায় হাজারো চেরি ফুলের কুঁড়ির প্রস্ফুটনে আগমন ঘটে এ সময়ে। কোরিয়ার বসন্তের প্রধান আকর্ষণ হলো চেরি ফুল।

সাধারণত গোলাপি, সাদা ও লাল রঙের ফুলের প্রাধান্য বেশি দৃষ্টিগোচর হয় চেরিতে। এক বিচিত্র গড়নের পাপড়ি দেখা যায় ফুলগুলোতে। সেই সঙ্গে গাছে গাছে আনন্দে মেতে ওঠে পাখপাখালি ও হরেক প্রজাতির রঙিন প্রজাপতি। এ সময়ে কেরিয়ার প্রতিটি প্রান্তে হয়ে ওঠে চেরি ফুলের স্বর্গরাজ্য। হাজার বছর ধরে এই ফুলকে নিয়ে কোরিয়ানরা রচনা করে চলেছেন চিত্রকর্ম, সাহিত্যকর্ম, গানসহ অনেক কিছুই। চেরি যেমন বসন্তের আগমনী গান শোনায়, তেমনি চেরি ফুলের মাধুর্য কোরিয়ানদের চিন্তাচেতনা ও সৌন্দর্যবোধের জোগান দেয়।

কোরিয়ানদের চেরি নিয়ে এই উন্মাদনা হাজার বছরের। এ জন্যই এর আগমনের সংবাদ জানাতে আবহাওয়া অধিদপ্তর বসে যায় নানা ধরনের হিসাব কষতে এবং সে অনুযায়ী তারা বিভিন্ন প্রিফেকচারে ফুল ফোটার আগাম ঘোষণা জারি করে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়। মার্চের শেষ দিক থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কোরিয়ার সর্বত্র তাপমাত্রা অনুযায়ী দেখা যায় চেরির সমারোহ। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে প্রতিবছরই স্থানীয় কোরীয়সহ বিদেশি পর্যটকেরাও বেরিয়ে পড়েন চেরির সৌন্দর্য দেখতে। পুরো দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন শহরজুড়ে চলতে থাকে এই চেরি উৎসব, যেখানে লাখো মানুষের সমাগম ঘটত। এখানকার মানুষেরা এই উৎসব মিস করতে চায় না, কারণ এই ফুল বেশি দিন স্থায়ী থাকে না। মাত্র ৭ থেকে ১০ দিন থাকে, যদি বৃষ্টি না হয়। আর বৃষ্টি হলেই ঝরে যায়। কোরিয়াজুড়ে চেরিগাছগুলো বসানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। সৌন্দর্যবর্ধনটাই ওদের আসল উদ্দেশ্য। পার্কগুলো তো আছেই, সঙ্গে মূল রাস্তার দুই পাশ ধরে সারি সারি করে লাগানো হয়েছে গাছগুলো। কোরিয়ায় বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চেরিগাছ থাকে।

গিউংসান প্রদেশের জিনহে শহরে হয়ে থাকে সবচেয়ে বড় চেরি উৎসব। প্রতিবছর এপ্রিলের প্রথম দিন শুরু হয়ে চলে ১০ তারিখ পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী এই উৎসব ‘জিনহে নেভাল পোর্ট ফেস্টিভ্যাল’ নামে পরিচিত। ১৯৫২ সালের ১৩ এপ্রিল, কোরিয়ার জাতীয় নায়ক অ্যাডমিরাল ই ছান-শিনের স্মরণে প্রথম খুব ছোট পরিসরে এই উৎসব শুরু হয়। সময়ের পরিক্রমায় এই উৎসব এখন বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত উৎসব, যেখানে প্রতিবছর দুই মিলিয়ন পর্যটক ভ্রমণ করে থাকেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে।

প্রতিবছরের মতো এবারও বসন্ত এসেছে, সঙ্গে চেরির আবির্ভাবও ঘটেছে স্বর্গীয় সৌন্দর্য নিয়ে। কিন্তু কে জানত, পৃথিবীর মানুষকে প্রকৃতি বঞ্চিত করবে তার এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে! এ বছরও মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনী পার হবে, এতটা অবাধ্যও এ দেশের জনগণ নয়। বিনয়ী ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে যে তারা বিশ্বসেরা! নেই লাখো দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড়। প্রতিবারের মতো এবারও চেরি ফুল ঠিকই ফুটেছে কিন্তু চারদিকে সুনসান নীরবতা। বসন্তের ঐশ্বরিক পরশের পরিবর্তে আতঙ্কের বেড়াজালে আবদ্ধ পৃথিবী।

চেরি ফুল আমার অন্য রকম ভালো লাগার একটি। আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে পা রেখেছিলাম কোরিয়ার মাটিতে। প্রথমেই কোরিয়ার চেরি ফুলের মুগ্ধতার ছোঁয়া দিয়েছিল আমার মনে। পাশ দিয়ে হাঁটলে আহ…চেরির কী মিষ্টি সুরভি। তাই তো অনেক সুগন্ধি ও প্রসাধনী সংস্থাগুলো স্প্রে এবং লোশনগুলোতে এটি প্রতিলিপি করার চেষ্টা করে। সত্যি এ যেন এক অন্য পৃথিবী! মনে হয় চেরি ফুলের দেশ। যে দিকেই চোখ যায় শুধু চেরি ফুল আর চেরি ফুল। নানা রং আর রূপ নিয়ে বসন্তকে রাঙিয়ে দিতে কোরিয়ার সর্বত্র শোভা পাচ্ছে এ ফুল।

কোরিয়ার রাস্তাঘাটে কিংবা পার্কে চেরি ফুল ফুটে থাকতে দেখলে তখনই আমার মনে পড়ে দেশের কথা। বড় বড় কৃষ্ণচূড়া কিংবা শিমুলগাছগুলো কী সুন্দর লাল রঙে সাজিয়ে রাখে প্রকৃতি। কিংবা বর্ষার মোহময়ী কদমগাছ। কী মনোরম সেসব দৃশ্য! আমার ভাবনায় একটাই প্রশ্ন জাগে, কোরিয়ান-জাপানিদের মতো আমরা সে রকম ফুলের সমঝদার নই। তা না হলে কৃষ্ণচূড়া, শিমুল কিংবা কদম ফোটা আমাদের জনমনে তেমন প্রভাব ফেলে না কেন?

এ সময় দক্ষিণ কোরিয়ার রাস্তার দুধারে সারি সারি শুধু চেরি ফুলের সমাহার দেখা যায়
ছবি: সংগৃহীত

চেরি উৎসব এখন কোরিয়া ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পালিত হয়। জাপান, চীন, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ম্যাকাও, জর্জিয়া, ফিনল্যান্ড ও আমেরিকা। ফুল-ফল মিলিয়ে সারা পৃথিবীতে ৪৫০ জাতের চেরি পাওয়া যায়। এ গাছ সর্বোচ্চ ৩০ মিটারের মতো উঁচু হতে পারে। সেই সঙ্গে চোখধাঁধানো ফুলের অসংখ্য রকমফের। মূলত ফুল, ফল ও আলংকারিক শোভাই এই গাছের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। এরা পিচ ও এপ্রিকট ফলের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ফুল ঝরে পড়ার পর নতুন পাতায় সবুজ রূপ ধারণ করে।

চেরি পুষ্প গাছবাদাম, পিচ, বরই ও এপ্রিকটগাছসহ অন্যান্য সাধারণ গাছের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। যদিও এই গাছগুলো চেরি ফুলের গাছের সঙ্গে একই রকম, তবুও এই গাছগুলোর কোনোটিতেই চেরি ফুলের গাছে যে অনন্যসুন্দর গোলাপি ফুল ফোটেনি। রাস্তার দুই ধারে কিংবা বিভিন্ন পার্কে অজস্র চেরিগাছ সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করে পথিক কিংবা ক্লান্ত অবসন্ন মানুষের মনে প্রশান্তি দেওয়ার জন্য। চেরি ফেস্টিভ্যালে দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু জায়গা খুবই বিখ্যাত। যেখানে প্রতিবছরই হাজারো পর্যটকেরা ভিড় করে থাকেন।

চেরির রাজ্য: জেজু দ্বীপ

দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয় যে চেরিগাছের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রজাতিটির উদ্ভব দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু প্রদেশে। জেজু দ্বীপটি গোলাপি বসন্তের প্রথম দিকে ও মার্চের শেষের দিকে প্রথম পুষ্পিত হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়।

পর্যটকেরা এখানে সমুদ্র উপকূলীয় দৃশ্য সঙ্গে চেরি ফুলের সৌন্দর্যকে উপভোগ করেন। কোরিয়ানদের চেরিগাছের নিচে পিকনিক করতেও দেখা যায়। আপনি এই দ্বীপের বিন্দুতে কিং চেরিগাছের কয়েকটি বড় ফুল দেখতে পাবেন। যেমন সুন্দর তেমনি বড় পাপড়িযুক্ত এই জাতটি এপ্রিলের প্রথম দিকে কেবল দু–তিন দিনই পুরো ফুল ফোটে, তাই আপনার আগমনের সঙ্গে ফুল ফোটা এই দুইয়ের সমন্বয় আবশ্যক। কোরিয়ার ওভারভিউতে চেরি ব্লসমস চেরি ফুলটি সাধারণত জাপানের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে এটি সাকুরা নামে পরিচিত। এটি অংশে রয়েছে কারণ, চেরি পুষ্পটি জাপানের প্রাকৃতিক ফুল। কোরিয়ায় একে (벗꽃) বলা হয়। জেজুতে প্রতিবছর বিভিন্ন চেরি পুষ্প উৎসবগুলোতে অংশ নিতে বিভিন্ন দেশ থেকে হাজারো পর্যটকেরা ভিড় জমান।

চেরির মহা উৎসব: জিনহে

জিনহে গুনহংজে উত্সব (জিনহে) তাদের সব গৌরবে চেরি পুষ্প দেখতে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গাটি হলো কোরিয়ার দক্ষিণ উপকূলের নিকটে জিনহেয়ের ছোট সামরিক বন্দর। বছরে একবার, সাধারণত এপ্রিলের গোড়ার দিকে শহরটি এর বৃহত্তম ও দেশের চেরি ফুলের উৎসবগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বিখ্যাত জিনহে গুনহাজে প্রচুর পর্যটকের সমাগম হয়। চেরি পুষ্প গাছের দর্শনীয় প্রদর্শনী ছাড়াও উৎসবটি দর্শকদের অ্যাডমিরাল লি সান-শিনের বিখ্যাত কচ্ছপ জাহাজের একটি প্রতিরূপে ভ্রমণ করার সুযোগ দেয়, একটি কোরিয়ান যুদ্ধজাহাজ, যা রয়্যাল কোরিয়ান নৌবাহিনীতে প্রথম থেকেই রীতিমতো ব্যবহৃত হয়েছিল।

চেরি ফুলের আগমন উদ্‌যাপনের ১০ দিনের উৎসব চলাকালে জিনাহে বন্দরের শহর বুশান থেকে বাসে এক ঘণ্টার পথ। জিনে গুনহাজে ফেস্টিভ্যালটি সাধারণত মিলিটারি ব্যান্ডের কুচকাওয়াজ, সংগীত পরিবেশনা এবং তারার আকর্ষণ, চেরি ফুলের গাছগুলো দর্শকদের স্বাগত জানায়।

চেরির আকর্ষণ: হাওয়াগা

হাওয়াগা চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যাল (হাওয়াগা)। জিরি মাউন্টেনের পাদদেশে অবস্থিত হাওয়াগা চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যাল। এপ্রিল এলে অঞ্চলটি সাদা এবং নরম গোলাপি রঙের একটি কম্বলের মতো হয়ে যায়। চেরি উৎসবের ‘10ri Cherry Blossom Road’, একটি রোমান্টিক জায়গা, এখানে চেরি ফুলের গাছগুলোর সারি চার কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে ‘ওয়েডিং রোড’ নামেও পরিচিত। কারণ বলা হয়ে থাকে যে প্রেমিকেরা গাছের নিচে দুজনের হাত ধরে হাঁটেন, তাঁরা বিবাহ করবেন এবং পরে একসঙ্গে সুখী জীবনযাপনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

কয়েক বছর আগেও চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কূটনৈতিক রেষারেষির কমতি ছিল না। তার মাঝে এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে নতুন এক বিতর্ককেরও যোগ হয়েছিল। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি প্রশ্ন ‘চেরি ব্লসম’ গাছের আদি উৎপত্তি কোথায়? তিন দেশের প্রত্যেকেই বলছে, সুন্দর ফুলবিশিষ্ট এই গাছটির উৎপত্তিস্থল তাদের দেশই। বিশেষ করে এই তিন দেশের লোকদের জন্য এ ফুল খুবই জনপ্রিয়। তবে বিশ্বের কয়েকটি দেশে পাওয়া গেলেও এটি জাপানের জাতীয় ফুল। চেরি ফুলকে জাপানিজরা বলে সাকুরা।

অভিমানী প্রকৃতিতে হানা দিয়েছে মরণব্যাধি করোনা। কত রকম রোগ-শোক প্রকৃতি তার বুক পেতে আগলে রাখে এই মানবসভ্যতার জন্য। কিন্তু মনুষ্যত্ব ভূলুণ্ঠিত হতে হতে আমরা এমন এক বীভৎস রূপ ধারণ করেছি যে সত্যি প্রকৃতি আজ আমাদের প্রতি বিরূপ। তার কোনো ক্ষমতাই আজ আর আমাদের রক্ষা করতে নারাজ এই মৃত্যুগ্রাসী করোনাভাইরাসের ভয়ংকর থাবা থেকে।

ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, প্রকৃতির কাছে গেলে মন ভালো হয়ে যায়, প্রকৃতি সুন্দর হলে মনও সুন্দর হয়ে যায়। কিন্তু কোথায় গেলে আর কতটা বোঝালে মানুষ বুঝবে, মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে? বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি কিছু লাগে কি? এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েও যদি আমরা সেটা বুঝতে না পারি, তবে মানুষ হিসেবে আমরা সত্যি অযোগ্য। পৃথিবীর ফুসফুসে আজ অক্সিজেনের ঘাটতি। আসুন, আমরা পৃথিবীটাকে বাঁচতে সুযোগ দিই।