স্বমহিমায় উজ্জ্বল তাজউদ্দীন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমেদ

তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় এক অগ্রনায়কের নাম। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য সহযোদ্ধা তাজউদ্দীন। একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করায় তাজউদ্দীন আহমদের নিপুণ কর্মকুশলতার গুণে মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি জাতিরাষ্ট্রের।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অকুণ্ঠ সমর্থন, সহমর্মিতা এবং সমর্থন লাভে বঙ্গবন্ধুর পর তাজউদ্দীন আহমদের সময়োপযোগী ব্যাপক ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মূল চালিকাশক্তি। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, সেনা-পুলিশ সদস্য, সরকারি চাকরিজীবী তথা বাংলার সব শ্রেণির আপামর নারী-পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে এই মুক্তিযুদ্ধ ‘গণযুদ্ধের’ রূপ পরিগ্রহ করে।

বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, এক কোটি উদ্বাস্তু শরণার্থীদের আশ্রয়ের সংস্থান, তাঁদের প্রতিদিনের খাবার, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, বাংলাদেশ থেকে আগত কিশোর, যুবা, প্রবীণ, নারী-পুরুষের সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাজউদ্দীন আহমদ।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ডামাডোলে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র উপস্থাপন এবং সমর্থন আদায়ের মূলেও এই তাজউদ্দীন। বাংলাদেশের ‘গণযুদ্ধে’ রাশিয়াকে সম্পৃক্ত করা, সর্বোপরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘মিত্রবাহিনী’ রূপে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ—এ সবের মূলে ছিলেন আমাদের ভূমিপুত্র, ভাওয়ালের এবং নাগরী সেন্ট নিকোলাস উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ কৃতি ছাত্র আমাদের ‘তাইজদ্দি’ তথা তাজউদ্দীন। আমাদের জন্য এর চেয়ে বড় গর্বের বিষয় আর কী হতে পারে! আমার সৌভাগ্য, পরে আমি সেন্ট নিকোলাসের শিক্ষার্থী হয়েছিলাম।

নাগরী সেন্ট নিকোলাস উচ্চ বিদ্যালয় বর্তমান গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী গ্রামে অবস্থিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ভাওয়াল এলাকায় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের কেন্দ্রস্থল ছিল নাগরী। নাগরী সেন্ট নিকোলাস টলেনটিনু গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৬৫ সালে। এখানে বসেই পর্তুগিজ মিশনারি ম্যানুয়েল দা আস্‌সুম্পসাঁউ সপ্তদশ শতাব্দীতে ‘কৃপা শাস্ত্রের অর্থভেদ’সহ মোট তিনটি বাংলা বই প্রকাশ করেছিলেন। বইগুলো বাংলা ভাষায় রচিত হলেও এর হরফ ছিল রোমান। লিসবন শহরে বইগুলো ছাপা হয়েছিল। ভাওয়ালের নাগরী ইউনিয়নের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস।

তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম আমাদের ভাওয়ালেই, ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই, কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে। বা সম্পর্কে তাঁর কন্যা সিমিন হোসেন রিমি লিখেছেন—‘... চতুর্থ শ্রেণিতে উঠে তিনি ভর্তি হন দরদরিয়া থেকে পাঁচ মাইল দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি (এমই) স্কুলে। এই স্কুলে থাকার সময় তিনি তিনজন প্রবীণ বিপ্লবী নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তাঁরা ওই স্কুলের শিক্ষকদের কাছে এই ছাত্রকে আরও ভালো স্কুলে পাঠানোর সুপারিশ করেন। সেই সুবাদে তাঁকে কালীগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করা হয়। এখানেও তাঁর মেধা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে তিনি ভর্তি হন ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুলে। তারপর সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে।’

আমাদের তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সোনালি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণালি অক্ষরে নিজের নাম যুক্ত করে প্রকারান্তরে আমাদের নাগরীকেও যুক্ত করে গেলেন। তিনি আমাদের চিরঋণী করেই গেলেন, যাতে আমরা দায়গ্রস্ত হয়েই থাকব চিরদিন। এই ঋণ পরিশোধের নয়। তবে হ্যাঁ, তাঁর প্রতি আমাদের ঋণের দায়ভার লঘু করতে পারি নিঃস্বার্থ হয়ে, দেশের, জাতির ও সমাজের সব স্তরের মানুষে সেবা করে। বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতো প্রধানমন্ত্রিত্ব চাননি। বাংলাদেশের জনগণ সেই সম্মানেই তাঁকে অভিষিক্ত করেছেন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে নিয়োগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁকে তাঁর কৃত ‘মিশন’ ও ‘ভিশন’ সামনে রেখে দেশ ও জাতির সেবায় কাজ করতে টেনে নিয়েছিলেন তাজউদ্দীনকে।

তাজউদ্দীন নিজের সাধনায় লব্ধ অভিজ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন সার্থক রূপেই। বাংলাদেশকেও করতে চেয়েছিলেন আলোকিত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন পথে, ভিন্ন খাদে প্রবাহিত করতে ‘মোশতাক চক্র’ তৎপর হয়েছিল। পাকিস্তানের শোষক, শাসকের দোসর এই চক্র চেয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ও চলমান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেন অন্যভাবে রচিত হয়। আর তাদের অঙ্কিত সেই নীলনকশা বাস্তবায়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল। সে সময়, তাজউদ্দীনের মেধার সপ্রতিভ প্রকাশ দেখতে পেয়েছে জাতি। দেখেছে বিশ্ব। এমনকি, স্বাধীনতাত্তোর সময় থেকে পঁচাত্তরের ৩ আগস্ট পর্যন্ত এই তাজউদ্দীনকে আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এবং আদর্শে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে। আবার তাঁর মহান নেতার সঙ্গে মতের অমিলও জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। তবে তিনি নেতার বিপরীতে অবস্থান নেননি। তাঁর নিজের শিক্ষায়, দীক্ষায় ও আদর্শে তিনি ছিলেন অনড়!

জীবনের শেষ মুহূর্তে, তাঁর অস্তিত্বের শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর জেলখানার বন্ধ প্রকোষ্ঠে উদ্যত বন্দুকের সামনে নিজেকে সমর্পণ করলেন দেশমাতৃকার পদতলে! ‘নব্য মীরজাফর’ মোশতাক তাঁকে তাক করে রেখেছিল তাঁর উত্থানপর্বেই। তারই রক্তাক্ত অঙ্কের শেষ দৃশ্যের পরিকল্পিত মহড়ার সফল মঞ্চায়ন হয় এদিন।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে সংঘটিত ইতিহাসের বীভৎসতম রক্তাক্ত ঘটনা ঘটে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। তাজউদ্দীন আহমদ অসহায় হয়ে অবলোকন করছেন সে সময়ের চালচিত্র। তাঁর নেতা, নেতার পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করতে সামান্যতম কিছুই করতে পারেননি তিনি। তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে দলে টেনে মোশতাক বঙ্গভবনে তার দল ভারী করতে চেয়েছিল। দলের কতিপয় স্বার্থান্ধের মতো তাঁরা এই চারজন বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত দেহ ডিঙিয়ে জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বঙ্গভবনে পা রাখেননি। মুশতাক চক্রের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার কারণেই এই চারজন জেলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা, অবিচল আস্থা ও কৃতজ্ঞতাবোধ—সব মিলিয়ে তাজউদ্দিন বাংলাদেশের ইতিহাস অনিবার্যভাবেই সংযুক্ত করে নিয়েছে তার নবতর অধ্যায়ের পাতায় পাতায়। লাল সবুজের মোড়কে, রক্তের অক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে আছে তাজউদ্দীনের নাম। তাঁর জীবনের ইতিহাস! তিনি লিখেছিলেন—

১. বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনগণই স্বাধীনতার ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। একা কেউ এ ইতিহাস সৃষ্টি করেনি। এ ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করতে হবে।

২. বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

৩. আত্মত্যাগের মাধ্যমে শহীদ ভাইয়েরা দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। এখন দেশকে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের। আমরা যদি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই, তবে আমাদের ইতিহাস আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।

৪. যখন আমরা আমাদের প্রত্যেকটি নাগরিকের খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হব, তখনই আমরা শহীদদের প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা জানাতে পারব।

৫. সরকারের কাছে সমস্যার কথা তুলে ধরার মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই, বরং এতে সত্যিকার অবস্থা জানতে সরকারের সহায়ক হবে। মন্ত্রীর লেবেল এঁটে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাব না।

[তথ্যসূত্র: তাজউদ্দীন আহমদের আলোক ভাবনা: সিমিন হোসেন রিমি ও তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি: ১৯৫২-চতুর্থ খণ্ড। অনুবাদ: বেলাল চৌধুরী]