স্বপ্নের এ কোন সমাপ্তি!

নিউইয়র্কে আমার প্রথম কর্মস্থল কুইনস সেন্টার মল। মলের ফায়ার সিস্টেমসহ ক্লিনিং ডিপার্টমেন্ট ও মল ব্যবস্থাপনায় প্রায় ২০ জনের মতো কর্মচারী। 

সবাই একে অন্যকে যেমন ভালো জানত তেমনি সম্পর্কও ছিল খুব আন্তরিক। এদের মধ্যে শাহ ফিরোজ আলি নামে ভারতীয় বংশোদ্ভূত, বর্তমানে গায়ানায় অধিবাসী একজনও ছিলেন। লম্বা একহারা গড়নের সত্তরের কাছাকাছি বয়সেও ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষটি। আমার শিফটে তাঁর কাজ থাকত বলে নানা সময় দেখা হয়ে যেত। জানতেন আমি বাংলাদেশি। তাই আমাকে দেখামাত্র নানা পুরোনো হিন্দি গান, বিশেষ করে মোহাম্মদ রফি, লতা মুঙ্গেশকরসহ পুরোনো শিল্পীদের গান আমাকে শোনাতে চাইতেন। শাহ ফিরোজ সব সময় থাকতে ভীষণ উৎফুল্ল। স্বল্পভাষী হওয়াতে কখনো তাঁর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কোনো বিষয়ে আলাপ করতেন না। শুধু গান নিয়ে আলাপচারিতা। কোন সিনেমায়, কোন গানে কোন নায়ক বা নায়িকা অভিনয় করেছে তা নির্ভুল বলে দিতে পারতেন। কাজের ফাঁকে নানা অজুহাতে আমার কাছে এসে শুধুই গানের গল্প করতেন।
প্রায় তিন বৎসর আমাকে প্রতিদিন দুই জায়গায় কাজ করতে হয়েছে। ভোর সাতটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত মলে কাজ করে দ্রুত শহরের আরেক প্রান্তে ডাউন টাউনে বিকেল চারটা হতে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে যেতাম। তখন এ ছাড়া আমার কোনো বিকল্প ছিল না।
যাক, ফিরে আসি গল্পের নায়ক শাহ ফিরোজ আলীর ঘটনায়। তাঁর অবসর নেওয়ার সময় কাছাকাছি চলে আসায় একদিন প্রসঙ্গক্রমে তাঁর অবসরকালীন জীবন কীভাবে কাটাবে তা শোনালেন।
গায়নায় তাঁর স্ত্রী অনেক আগে মারা গেছেন। একমাত্র ছেলে তাঁর সঙ্গে কখনো থেকেছে কখনো আবার তাকে ফেলে চলেও গেছে। বাবা পেনশন নিয়ে দেশে আসবেন শুনে পিতার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করতে শুরু করেছে আজকাল। অভিভাবকহীন ছিল বলে ছেলেটি স্থায়ী কোনো সংসার করতে পারল না। কিন্তু আলি যখন তার ছেলের কথা বলত ওর চোখে মুখে অনেক আশার ছবি ফুটে উঠত। মুখ টিপে বলত ছেলের জন্য প্রথমে এক গায়ানীজ মেয়েকে ছেলের বউ করে আনবে। পরে ছেলে ও ছেলের বউকে জিজ্ঞেস করে, নিজেও একটি বিয়ে করবে। এসব বলত আর মুখ টিপে হাসত। একদিন আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার এই পরিকল্পনা আমাকে বলছ কেন।’ সে হেসে বলল, ‘ভাই তুমি বহুত সমঝদার! তুমি হয়তো বুঝতে পারবে এখন আমি কী খুঁজি! জীবনে ধন দৌলত তো কম কামাই করি নাই। কিন্তু একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে যে জিনিস বেশি প্রয়োজন তা হলো একটি সুন্দর সংসার। সেই সংসার তো ভাইয়া আজ পর্যন্ত পেলাম না। দেখি শেষ জীবনে হয় কিনা?’
ভাবলাম কী আজব খেলাই না চলছে এই আজব দুনিয়ায়।
এর কয়েক দিন পর শুরু হলো মলে আমার অনিয়মিত কাজ। মাঝে মধ্যে যেতাম। ফিরোজ ভাই দেখলেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরতেন। কোটের পকেট থেকে বের করতেন এক গাদা ফটো। গায়নাতে ওর নির্মীয়মাণ নতুন বাড়ির চোখ ধাঁধানো সব ছবি। খুশি হয়ে বলতেন, ছেলে বাড়ি তৈরির দায়িত্ব নিয়ে কাজ দেখাশোনা করছেন। ওঁর দিকে তাকিয়ে দেখি, উনি প্রতিটি মুহূর্ত অপেক্ষা করছেন জীবনের শেষ আশা কবে পূরণ হবে তা দেখার জন্য। কত আশা, আবার উনি নিজ বাড়ি ফিরে যাবেন। বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে কাটাবেন অবসরজীবন। প্রতিদিন সেই একই স্বপ্ন দেখে তাঁর সময় কেটে যায়। অপেক্ষায় থেকে থেকে এত দেরি যেন আর সইতে পারছেন না।
কয়দিন পর মলের কাজ এক প্রকার ছেড়েই দিলাম। একদিন মলে গিয়ে জানলাম ফিরোজ আলি পেনশনে চলে গেছেন। সঙ্গে স্থায়ীভাবে গায়নায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেক দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হতে চলছে বলেই হয়তো শাহ ফিরোজ যেমন আবেগপ্রবণ ছিলেন তেমনি ছিলেন খুশিতে আত্মহারা। সব শুনে খুব ভালো লাগল।
এর মধ্যে গেলাম দেশে। নিউইয়র্ক ফিরে এসে একদিন যেতে হলো মলে। ঢোকার মুখে দেখা হলো মল সুপারভাইজর মিস্টার জিনের সঙ্গে। ‘হ্যালো’ বলে নিজেদের ভালো-মন্দ জানার পর জানলাম মর্মান্তিক খবরটি।
মলের সুপারভাইজার জানালেন, শাহ ফিরোজ আলি ইহজগতে আর নেই। খবরটি শুনে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সব শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম। কবে ও কীভাবে মারা গেলেন শাহ ফিরোজ।
মিস্টার জিন সংক্ষেপে সব ঘটনা খুলে বললেন। গায়না যাওয়ার সপ্তাহ আগে তার এক বন্ধু মারফত জানতে পারেন ভয়ানক এক দুঃসংবাদ। বাড়ি তৈরির জন্য পাঠানো সমস্ত ডলার ছেলে খারাপ পথে নষ্ট করে ভুয়া ছবি বাবাকে পাঠিয়ে ঠকিয়েছে। আর সে সব ভুয়া ছবি দেখে ফিরোজ স্বপ্নের জাল বুনত। আর আশায় থাকত। কখন তৈরি হবে তার স্বপ্নের সেই বাড়ি। সেই বাড়ি ছেলে কখনো তৈরি করেনি।
পুলিশের টেলিফোন পেয়ে মলের কর্মকর্তাসহ মিস্টার জিন যখন ফিরোজের ভাড়া করা বেসমেন্টে গেলেন সেখানে গিয়ে দেখলেন হৃদয় বিদারক এক চিত্র!
মৃত শাহ ফিরোজের ডান হাতে ছিল ছেলের পাঠানো ঝকঝকে সুন্দর মনোরম একটি বাড়ির ছবি যেটা আসলে ভুয়া আর বাম হাতে ছিল বন্ধুর পাঠানো তার পুরোনো জীর্ণ শীর্ণ বাড়ির প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ছবি যেটা ছিল বাস্তব অবস্থা!
তার দু চোখ ছিল তখনো খোলা। দেখে নাকি মনে হচ্ছিল, শাহ ফিরোজ আলি তার আগামী দিনের স্বপ্ন তখনো দেখেই চলছে।
ওর আজীবনের স্বপ্ন ছিল, নতুন তৈরি করা বাড়ির সামনে বসে প্রিয় গায়ক গায়িকাদের ক্ল্যাসিক হিন্দি গান শুনে শুনে কাটিয়ে দেবেন অবসরের সোনালি সেই দিনগুলি। অথচ আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে চিরদিনের জন্য শুয়ে আছেন ভালোবাসার নগরী নিউইয়র্কের কোনো এক মুসলিম সিমেট্রিতে। গায়ানার এক স্বপ্নচারী মানুষ শাহ ফিরোজ আলি। শাহ ফিরোজ আলি সব ছেড়ে গেলেও এই নগরীর ভালোবাসার টান ছেড়ে কোথাও যেতে পারলেন না। শাহ ফিরোজ আলির আপনজন যে ভালোবাসা দিতে পারেনি তা এই ভালোবাসার শহরই বুঝি তাঁকে দিল। পরম মমতায় নিজের বুকে মরহুম শাহ ফিরোজ আলিকে ঠাঁই দিয়ে যেন বলতে চাইছে, ‘এসো হে বন্ধু মোর, এই নগরের আলো আর বাতাসে জীবন কাটানো সন্তান! একমাত্র আমিই পারব তোমাকে এ জীবনে এবং পর জনমে পরম আদরে বুকে ধরে রাখতে। তুমি নিশ্চিন্তে আমারই বুকে অনন্তকালের জন্য ঘুমিয়ে থাকো।’