শান্ত, স্নিগ্ধ পুকুরপাড়ে হরেক রকমের ফুল, ফল আর সবজিগাছের সমাহার। দক্ষিণা মৃদু সমীরণে পুকুরের পানিতে ঢেউ খেলে যায়। মাচায় দোলা দেয় লাউ, কুমড়া কিংবা শিমগাছের পাতা। গ্রামবাংলায় খুবই পরিচিত দৃশ্য। শহরে এসব দৃশ্য অনেক কসরত করেও দেখা যায় না। কিন্তু বিদেশে? যেখানে বছরের ৯ মাসই থাকে ঠান্ডার চাদরে ঢাকা। প্রখর সূর্যের আলো খুঁজে পাওয়া যেখানে অমাবস্যার চাঁদ। যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডে বসতবাড়ির সুইমিংপুলে দেশীয় শাকসবজির চাষ করে সে অসাধ্যসাধন করেছেন একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মুহাম্মদ মহিউদ্দিন।
স্কটল্যান্ডের একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ স্থান ড্যান্ডি। ব্রিটিশ শাসনামলে ড্যান্ডির সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। সমুদ্রপথে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য পাট জাহাজ বোঝাই করে পাঠানো হতো ড্যান্ডিতে। আবার বাংলাদেশের অন্যতম বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জ পরিচিত ছিল বাংলাদেশের ড্যান্ডি হিসেবে।
২৩ বছর আগে স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডিতে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে গিয়ে বসবাস শুরু করেন মহিউদ্দিন। একসময় চাকরি ছেড়ে শুরু করেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। পরিশ্রম আর আন্তরিকতা দিয়ে দ্রুত সফলতা লাভ করেন তিনি। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন ড্যান্ডিতে।
মহিউদ্দিন জানান, চলতি বছরের করোনা মহামারির লকডাউনের সময়ে কিছু করার ছিল না। হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাসার এক পাশে থাকা সুইমিংপুলের অব্যবহৃত জায়গায় কিছু ফল ও সবজির চারা রোপণের চিন্তা আসে তাঁর মাথায়। সেই ভাবনা থেকেই সুইমিংপুলের চারপাশে টবের মধ্যে চারা লাগানো শুরু করেন তিনি।
কিছুদিন পরিচর্যার পর চারাগুলো দ্রুত বাড়তে থাকে। লাউ, শিম, কুমড়ার লতার জন্য সুইমিংপুলের ওপরে নেটের মতো জিনিস লাগিয়ে মাচার মতো ব্যবস্থা করে দেন মহিউদ্দিন। একসময় লতানো লাউগাছে প্রচুর ফলন আসে। আশপাশের প্রতিবেশীসহ ড্যান্ডি শহরে থাকা প্রায় ৪০টি পরিবারে উপহার হিসেবে লাউ নিয়ে হাজির হন তিনি। বেশ পরিতৃপ্তি নিয়েই জানালেন এ কথা।
যেহেতু সুইমিংপুলের পুরোটা জুড়েই লাউয়ের ফলন হয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা দেয় আরেক বিপত্তি। গভীর পানিতে দাঁড়িয়ে মাচা থেকে লাউ সংগ্রহ করাটা দুরূহ। সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে তাঁরা কিনে আনেন রাবারের তৈরি নৌকা। সেই নৌকা বেয়ে মাচার নিচে পৌঁছে পেড়ে আনেন লাউ। এতে পুরো দেশীয় আমেজ আসে বলে জানান মহিউদ্দিন দম্পতি।
লাউ ছাড়াও সুইমিংপুলের মাচায় আরও আছে বিভিন্ন রকমের বিলেতি কুমড়া, আঙুর, টমেটো, শিম, কাঁচা মরিচ, বোম্বাই মরিচ, পুঁইশাক, বেগুনসহ বিভিন্ন রকমের দেশি-বিদেশি সবজি। অনেকটা গ্রিনহাউসের আদলে তৈরি এই সুইমিংপুল বাগানের মনোরম দৃশ্য দেখে বিমোহিত হতে হয়।
সুইমিংপুলের বাইরে বাড়ির আঙিনায় ফলনশীল বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে লেডি আপেল, চেরি আপেল, সবুজ আপেল, প্লাম, নাশপাতি এবং আলুবোখারার গাছ। সব কটিতেই প্রচুর ফলন হয়েছে। এক পাশে জলপাইগাছে মুকুল এসেছে। মহিউদ্দিন জানালেন, ‘ভাগ্যক্রমে জলপাইগাছও এখানকার আবহাওয়ায় উতরে গেছে। আশা করছি এ বছরই ফলন হবে।’
মহিউদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই বৃক্ষপ্রেমী। বসতবাড়ির প্রতিটি কোণে রেখেছেন সতেজ গাছপালা। এর মধ্যে অন্যতম একটি গাছ হলো পেয়ারা। বিশেষ কায়দায় তাঁরা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসেন একটি পেয়ারাগাছের চারা। সেটি ঘরের মধ্যে রেখে দিয়ে নিয়মিত পরিচর্যা করেছেন। বেগম মহিউদ্দিন জানালেন, ইতিমধ্যে গত বছর কাজি পেয়ারার ফলন হয়েছে। এ বছরও ফলন আশা করছেন। একটি গাছ থেকে আরও কয়েকটি গাছের চারা তৈরির উদ্দেশ্যে কলম দিয়ে রেখেছেন। বিলেতে বসেও পেয়ারার চাষ করা যায়—এটি প্রমাণ করেছেন ইতিমধ্যে।
স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে মহিউদ্দিনের সুখের সংসার। বড় মেয়ে ডাক্তারি পড়ছেন স্কটল্যান্ডের আরেক শহর আবারডিনে। বাকিরা পড়ালেখা করছেন ড্যান্ডিতেই। পরিবারের সবাই নিজেদের ঘরে থাকা গাছগুলোর নিয়মিত পরিচর্যা করেন। এই কাজ করে তাঁরা আনন্দিত বলেই জানালেন।
ঘরের ছাদে, আঙিনায় কিংবা বারান্দায় সবজি চাষের গল্প অনেক আছে। বিদেশের বিরুদ্ধ আবহাওয়ায় সুইমিংপুলের পাশে টবে সবজি চাষ মোটামুটি পরিশ্রমসাধ্য কাজ। কিন্তু সব বাধা সরিয়ে মহিউদ্দিন দম্পতি সেটা সম্ভব করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, প্রকৃত বৃক্ষপ্রেমী হতে চাইলে বিশ্বের যেকোনো স্থানে থেকেই সেটা সম্ভব—কথাটি সপরিবার প্রমাণ করলেন মহিউদ্দিন দম্পতি।