উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে রাজনীতির প্রতিহিংসার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে বর্ণ-বৈষম্য, অভিবাসন নীতি আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ধর্মের বাড়াবাড়ি, দলীয় কোন্দল। কোনো ঘটনা ঘটলে সরকারি ও বিরোধী দল একে অন্যকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে দেখছি, সেই সাধারণ মানুষগুলোর ক্ষতি হচ্ছে। বিচার চাইতে গিয়ে তারা আরও নাজেহাল হচ্ছে। অনেকে ভয়ে চুপসে যাচ্ছে। এক অজানা আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করেছে। বর্তমানে এশিয়ার দেশগুলোতে এমন প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কে কাকে কত হেয় করতে পারে। আর এতে ব্যবহার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। একটা দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা অবশ্যই দরকার। কিন্তু শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা যেন ফ্যাশন হয়ে গেছে আজকাল। কি উন্নত রাষ্ট্র, কি উন্নয়নশীল—সব দেশে একই অবস্থা বিরাজ করছে। সরকার যাই করুক, তার বিরোধিতা করাই যেন মূল কাজ। ফলে যারা সাধারণ সমর্থক তারা আটকে যাচ্ছে রাজনীতির ফাঁদে।
এই যুক্তরাষ্ট্রেই দেখছি, অভিবাসন নীতি নিয়ে রাজনীতির মারপ্যাঁচ। রিপাবলিকানরা বাতিল করে, ডেমোক্র্যাটরা এসে তা আবার বহাল করতে চায়। এই যে রাজনীতির মারপ্যাঁচে, এতে অবৈধ অভিবাসীরা থাকে দ্বিধার মধ্যে। একদল স্বপ্ন দেখায়, আবার একদল সেই সাধারণের স্বপ্ন ভাঙে। এমনও হয়েছে, দেয়ালের ওপারে মা, এপারে সন্তান।
আইনের দোহাই দিয়ে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হয় যাতে নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোট পেতে পারে। দুই দলের চাপে পিষ্ট হয় অবৈধ অভিবাসী সাধারণ মানুষ। এ যেন এক ট্রাম্প কার্ড।
আর বর্ণ বৈষম্যের বিভেদ! এই বিভেদের সুযোগ নেয় রাজনীতিবিদেরা। তারা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে। এক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তুমুল আলোচনা হয়েছিল। হইচই হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিনের ব্যবধানে দেখেছিলাম, কী করে বিভিন্ন রাজ্যে একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে গিয়ে সাধারণকে নামিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়। লুণ্ঠন, ভাঙচুর কি কম হয়েছে!! কিন্তু এমন অনেক জর্জ আছে যারা হয়তো মারা যায়নি, কিন্তু নির্যাতিত হচ্ছে। প্রমাণ করতে পারছে না বলে এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে দিনযাপন করছে।
আমাদের এশিয়ার দেশগুলোতে বর্ণবৈষম্য তেমন না থাকলেও দেখেছি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। এক বাবরি মসজিদ নিয়ে তো ভারতে সেই কবে থেকে চলছে এক যুদ্ধ। একদল ভাঙে, আরেক দল ভাঙার বিরুদ্ধে কথা বলে। কিন্তু এই যে বিভেদ, এই যে এত এত বিশৃঙ্খলা তাতে নেতার ওপর যতটুকু প্রভাব পড়ে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতি হয় সাধারণের, দেশের, সমাজের। প্রাণ হারায় সাধারণ মানুষ। একেক প্রজন্ম একেকটা ধারণা নিয়ে বড় হয়, ফলে ধাক্কা লাগে নীতি ও আদর্শের জায়গায়। আজকাল ধর্মটা হয়ে গেছে রাজনীতির হাতিয়ার। ধর্ম যতটুকু না পালন হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে নিজেদের স্বার্থের কারণে। রাজনীতিবিদরা সুবিধামতো ধর্মের দোহাই দিয়ে আদায় করে নিচ্ছে নিজের স্বার্থ।
বাংলাদেশে সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনায় একে অন্যকে দোষারোপ করছে, এক নিউজে আসছে একেকরকম। সত্যটা হচ্ছে, যারা হামলা করেছে তারা তো দেশের নাগরিক, বিদেশ থেকে এসে তো কেউ হামলা করেনি। আর যাদের ওপর হামলা হয়েছে, যাদের বাড়িঘর লুট হয়েছে, ভাঙচুর হয়েছে তারা একেবারেই সাধারণ, নিরীহ নিরপরাধ মানুষ। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, যারা হামলা করছে এসব অপরাধীকে বাঁচাতে ও রাজনীতিবিদেরাই এগিয়ে আসে তাদের স্বার্থে। এমনকি হামলাকারীর পরিচয় রাজনৈতিকভাবে দেওয়া হয়।
এসব করতে গিয়ে ধামাচাপা পড়ে যায় আসল ঘটনা। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় নির্যাতিতরা। সমাজে যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে, যত না ক্ষতি হয় অর্থের তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বিশ্বাসের জায়গায়। কারণ, একবার মনে উদয় হয় বিচার পাব না, তখন চুপসে যায় নির্যাতিত নাগরিকেরা, যা সমাজের জন্য ভয়ানক বার্তা। আমরা নুসরাত হত্যাকাণ্ডে দেখেছি, গ্রেপ্তার হয়েছে, রায় হয়েছে। কিন্তু এখনো বিচার ঝুলে আছে। অথচ সরকার চাইলে আইনের ভিত্তিতেই দ্রুত সমাধান করা যায়। কিন্তু সময় বয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে অনেক আরও কতশত ঘটনা ঘটে গেছে। নাসিরনগর, রামু থেকে শাল্লা একই অবস্থা। এই যে একের পর এক ঘটনা ঘটছে, তার কি সুরাহা হচ্ছে? হচ্ছে না বরং অপরাধীরা রাজনীতির দোহাই দিয়ে আরও বেশি অপরাধ করে যাচ্ছে, ভাবছে ধরা পড়লে রাজনীতির ছায়ার আশ্রয় নেবে। এবং অপ্রিয় হলেও এটিই সত্য।
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পরও দেখেছি টিকা নিয়ে ব্যবসা। বিরোধীরা বলেছিল, এই টিকা না নেওয়াই ভালো। আবার তারাই গোপনে সবার আগে নিয়ে নিয়েছে। যে নেতারা বলে জনগণের জন্য রাজনীতি করি, দেখা গেছে তারাই সবার আগে টিকা নিয়েছে। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা—এমন অবস্থা।
সাধারণ অনেক মানুষ এসব নেতার কথার ওপর বিশ্বাস করে টিকা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু দিন শেষে এখন তারাই আফসোস করছে, যখন দেখল নেতা তাদের না জানিয়েই নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভাবল। আসলে সাধারণ জনগণ রাজনীতির গুটি। কর্মীরা প্রাণ দেয়, নেতা পায়ের ওপর পা তুলে বলে, চিন্তা করিস না আমি তো আছি। এমনি হয়ে আসছে।
মিয়ানমারের দিকে তাকালে দেখি, সেখানকার সাধারণের জীবন এখন ভাসমান। গণতন্ত্র এখন সেখানে পারদের মতো ওঠানামা করছে। অং সান সু চি আর সামরিক বাহিনীর রাজনীতির মাঝে পড়ে চ্যাপটা হচ্ছে সাধারণ নাগরিকেরা। কিংবা এক কাশ্মীরের দিকে তাকালে দেখি ভারত, পাকিস্তান দুই দেশের দাবার গুটি যেন কাশ্মীর এবং এই যে দখলদারির বিভেদ, তা কখনো নিষ্পত্তি হবে বলে মনে হয় না। ফলে কাশ্মীরের জনগণে চিঁড়েচ্যাপ্টা হতে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
একটু যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, যেসব দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি কম, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কম, সেসব দেশে শান্তি বিরাজ করছে। বলতে পারি নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড—এসব দেশের কথা। এসব দেশে সহিংসতা নেই, শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। তার মূল কারণ, এসব দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি নেই। নিউজিল্যান্ডে যখন সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল, হামলার পর মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সবাই। নিউজিল্যান্ডে মুসলমানদের সংখ্যা কম, অন্য ধর্মের মানুষ বেশি, সবাই একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। মানবিকতা, সহমর্মিতা দেখিয়েছিল, একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপায়নি। এটাই হচ্ছে সভ্যতা।
এমনকি এই করোনাকালে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নকে দেখেছি, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন জনগণের পাশে থাকতে, তিনি সফলও হয়েছে। খুব দ্রুত সময়ে নিউজিল্যান্ড করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
রাজনীতিবিদেরা হচ্ছেন দেশের কান্ডারি। তারা যখন জনগণের জন্য সত্যি কাজ করেন, তখন দেশ হয়ে উঠে অনন্য। অতীতে আমরা দেখেছি রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ড। আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু ছিলেন, জাতীয় নেতারা ছিলেন। ভারতে গান্ধীজি বা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক নেতা ছিলেন যারা সত্যিকার অর্থে জনগণের পাশেই ছিলেন। মার্টিন লুথার কিং থেকে শুরু করে আব্রাহাম লিংকন, ম্যান্ডেলা, কিংবা হালের জাস্টিন ট্রুডো এমন অনেক অনেক নাম আছে, যারা সাধারণের পাশে ছিলেন, আছেন।
সাধারণ জনগণের কাছে একজন রাজনীতিবিদ কত শ্রদ্ধেয়। কিন্তু সেসব রাজনীতিবিদ যখন হিংসার বশবর্তী হয়ে নিজেদের স্বার্থে সাধারণ মানুষকে ঠকায়, তখনই সমাজে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, নেমে আসে সাধারণের ওপর অত্যাচার। তারা থাকে বহাল তবিয়তে। ক্ষমতা দেওয়া হয় সেবার জন্য, সেই সেবা যখন লিপ্সায় পরিণত হয়, লালসার জালে বন্দী হয়, নিজের স্বার্থ যখন বড় করে দেখে, তখনই তাদের রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। বঞ্চিত হয় ন্যায়বিচার থেকে।
রাজনীতিবিদরা সমাজের আয়না। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের মতো তারা হলো দেশের স্টিয়ারিং। তারা যত ভালোভাবে চালাবে, দেশ তত সুন্দরভাবে চলবে। তাঁরা যদি সত্যিকার অর্থে সেবার ব্রত নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান, তাহলে সমাজ সুন্দর হতে বাধ্য।
সবাই যে শুধু স্বার্থ দেখে, তা নয়। কিন্তু এদের সংখ্যা এত কম যে উদাহরণ হিসেবেও আনা কঠিন। একটা দেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেই হয় না, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যদি পিছিয়ে যায়, আইনের মারপ্যাঁচে যখন সাধারণ নাস্তানাবুদ হয়, তখন অনিয়মটাই নিয়ম হয়ে যায়। আর এই অনিয়মের মধ্যে অপরাধীরা রাজনীতিবিদদের আশ্রয়ে–প্রশ্রয়ে থাকে। এর ফলে জাঁতাকলে পড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয় সাধারণ জনগণ।