সেদিনের চোখের জলে ছিল ভালোবাসার আশা

আমার সুইডেনে বসবাস জীবনের শুরুতে (জুন, ১৯৮৬) প্রথম যেদিন কফি পান করি, সেদিন ঘটেছিল একটি ঘটনা, যা আজ এত বছর পর মনে পড়ে গেল। মেয়েটির বাড়ি লিনসোপিং-এ। আমার সমবয়সী, তবে সে কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্রী, নাম সাবিনা। বাংলা নামের সঙ্গে মিল রয়েছে, তবে তার চুল ছিল কালো আর চোখ ছিল নীল। প্রথম দেখাতেই একটু কেমন কেমন ভাব মনে হয়েছিল। এর কারণ কিছুটা লজ্জা, তারপর সে অপরিচিত।

আমি তার ভাই নিকলাসকে চিনতাম। সে তখন আমার সঙ্গে সুইডেনের লিনসোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। নিকলাস লিনসোপিং-এর ছেলে, তাই বাড়ি থেকেই ক্লাস করে। ১৯৮৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয় বড় দিনের (Xmas) ছুটি। আমি ডরমিটরিতে আছি। প্রথম বছর টাকাপয়সার বেশ টানাটানি, তাই তেমন কোথাও যাওয়ার শখ থাকলেও সামর্থ্য নেই।

হঠাৎ নিকলাস ডরমিটরিতে এসে হাজির। কী ব্যাপার বন্ধু? বলল, আমাদের বাড়ি চল, ডিনার করবি। এই প্রথম কোনো সুইডিশ বন্ধুর বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত। শহর থেকে একগুচ্ছ ফুল কিনে নিকলাসের সঙ্গে সন্ধ্যা আটটার দিকে তার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। লেকের ধারে সুন্দর একটি বাড়ি, টিপটিপ করে পুরো বাড়িটি আলোয় ঝলমল করছে। ঘরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ল ক্রিসমাস ট্রি, সাজিয়েছে বেশ সুন্দর করে। নিকলাসরা দুই ভাইবোন। বাবা ডাক্তার, মা কলেজশিক্ষক। তাদের দাদা এবং দাদিও এসেছেন সেদিনের ডিনারে। তাঁরা থাকেন বেশ পাশাপাশি। একেক করে হাত বাড়িয়ে পরিচয় পর্ব শেষ করল সবাই। হঠাৎ ওপর থেকে হুট করে নেমে এসে নিজ থেকেই বলল, হেই সাবিনা, বললাম, রহমান। সেদিন রাত ১২টা অবধি নিকলাসদের বাড়িতে ছিলাম। কীভাবে যে সময় পার হয়ে গেল, তা বোঝা গেল না। সব মিলে সেদিনের সময়টি ছিল-lots of excitement and full of fun.

বছর গড়িয়ে নতুন বছর শুরু হয়েছে। সুইডিশ বন্ধু-বান্ধবীসহ তাদের পরিবার, সবকিছুর সঙ্গে বেশ মিশে গেছি। সাবিনার সঙ্গে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হয় এবং সময়ের সঙ্গে একটি ইন্টিমেট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জুন মাসের মাঝামাঝি স্টকহোমে চলে এসেছি সামার জব করতে। সাবিনা ধরেছে যেন আমি মিডসামারে স্টকহোম থেকে লিনসোপিং-এ আসি। তার পরিবারের সঙ্গে মিডসামার পালন করতে হবে।

শুনেছি মিডসামারের কথা, তবে তা পালন করিনি কোনো দিন। সামারে কাজ করি প্রতিদিন, সারা দিন, সারা রাত কীভাবে কী করব, পড়েছি ভাবনায়! এ এক মজার ভাবনা। ঝটপট করে সবই ম্যানেজ করে ফেললাম এবং জুনের ২০ তারিখ সকালে ট্রেনে করে লিনসোপিং-এর উদ্দেশে রওনা দিলাম। ঠিক দুই ঘণ্টা পর স্টেশনে এসে পৌঁছে গেল ট্রেন, সাবিনা দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার অপেক্ষায়। ট্রেন থেকে নেমে সরাসরি মিডসামার পার্টিতে চলে গেলাম।

মিডসামার, সে আবার কী

প্রথমে যারা খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী, তারা সাধারণত মিডসামার সম্ভবত ১৩০০ সাল থেকে ধর্মীয়ভাবে উদ্‌যাপন করত। পরে মিডসামার পালন করা একটি ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দেয় যে মিডসামার দিনটি বছরের দীর্ঘতম দিন, এই কারণে তারা এটা উদ্‌যাপন করে। এখন ধর্ম বা ট্র্যাডিশন যা–ই হোক না কেন, মিডসামার পালন করা সুইডিশদের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবারকে মিডসামার ডে বলা হয়। এটা হতে পারে ১৯-২৫ জুনের মধ্যে।

এ বছর জুনের তৃতীয় শুক্রবার হবে ১৯ জুন, তা সত্ত্বেও মিডসামার পালন করা হবে ২০ জুন। তবে দিনটি অন্য বছরের মতো উদ্‌যাপিত হবে না কোভিড-১৯–এর কারণে।

দিনটির শুরুতে একটি লম্বা গাছকে পাতা দিয়ে সাজানো হয়। গাছের ওপরের অংশে ডাল দিয়ে ত্রিভুজের মতো করে পরে পাতা দিয়ে তাকে আবরণ করা হয়। ত্রিভুজের দুই কোনায় দাঁড়িপাল্লার মতো করে দুটো রিং ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সুন্দর করে সেই রিং দুটোকেও পাতা দিয়ে সাজানো হয়।

তারপর সেই সাজানো গাছকে সুইডিশ ভাষায় বলা হয় মিডসামারস্টং (midsommarstång)। সবাই মিডসামারস্টং-এর চারপাশে হাতে হাত ধরে সুইডিশ জাতীয় পোশাক পরে নাচ-গান, আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে দিয়ে দিনটি পালন করে।
সামারের দিনগুলোকে তারা সত্যি উপভোগ করে মনের আনন্দে। বলতে গেলে গরমকে বরণ করাই মিডসামার পালন করার মূল উদ্দেশ্য।

সুইডেনের উত্তর অঞ্চলের শেষ প্রান্তের একটি শহর নাম কিরুনা। এটি মিডসামারকে কেন্দ্র করে বিশাল পর্যটন শহরে পরিণত হয়েছে; এখানে প্রায় ৭ দিন সূর্যাস্ত হয় না। তাই দেশ–বিদেশের হাজারো পর্যটক এই শহরে আসেন ও বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

ভালোবাসা আর ফুলের অভাব নেই সুইডেনে। বিভিন্ন প্রজাতির ফুল বাছাই করে অনেকে তা বালিশের নিচে রাখে। সুইডেনে বিশেষ করে অবিবাহিত যুবতীরা বিশ্বাস করে, যদি এই উৎসবের প্রথম রাতে (যদিও সূর্য ডোবে না) ঘুমানোর সময় ৭টি বিভিন্ন ধরনের ফুল বালিশের নিচে রেখে ঘুমায়, তাহলে স্বপ্নে যে রাজপুত্রকে দেখবে, সেই তার জীবনসঙ্গী হবে ও তার সঙ্গেই সারা জীবন নাচে–গানে কাটিয়ে দেবে।

সুইডেনের মিডসামার সুইডিশ জাতির জীবনের এক রোমান্টিক সময়। সেদিনের সময়টি আমার জন্য ছিল অনেক কিছু দেখা, জানা ও শেখার। সারা দিন সাবিনার সঙ্গেই ছিলাম।

রাতের ডিনার শেষে সাবিনার দাদি কফি দিয়েছিল। জীবনের প্রথম কফি পান করতে যাচ্ছি। জিজ্ঞেস করেছিল ক্রিম নাকি ক্রিম ছাড়া কফি দেব? বলেছিলাম তুমি যেটা ভালো মনে করো সেটাই দাও। সুইডিশ ভাষায় বলেছিল- Kaffe utan grädde är som kärlek utan kyssar, och kärlek utan kyssar är väl ingen kärlek। বাংলা অনুবাদ করলে এমনটি হবে-ক্রিম ছাড়া কফি পান করা আর চুমু ছাড়া ভালোবাসা এক কথা, মানে প্রেমে চুমু হবে না, সে আবার কেমন প্রেম। সাবিনার দাদি একটু জোক করে কথাটি বলেছিল আমাকে।

পরের দিন কাজ, তাই রাতের ট্রেনে সাবিনা তুলে দিতে এসেছিল। অনুরোধ করেছিল থাকতে, যদিও সে জানত আমাকে কাজ করে পুরো বছরের পড়াশোনা, থাকা–খাওয়া ম্যানেজ করতে হবে। রোমান্স যে ছিল না আমাদের মধ্যে বললে ভুল হবে এবং এটাও সত্যি সাবিনার সঙ্গে সেদিনের সুইডিশ মিডসামার পালন ছিল আমার জীবনের এক রোমান্টিক অভিজ্ঞতা। আসার সময় দেখেছিলাম কীভাবে সাবিনার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। সেদিন রাতে তার মুখটাকে শুধু ভিজিয়ে রেখে চলে এসেছিলাম স্টকহোমে।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন[email protected]