সূর্য না–ডোবার দেশেও রোজা রাখা হয়

উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের অনেক অংশেই গ্রীষ্মকালের একটা নির্দিষ্ট সময়ে আক্ষরিক অর্থে সূর্য ডুবতে দেখা যায় না। তেমনি শীতকালেরও একটা নির্দিষ্ট সময় সূর্য উঠতে দেখা যায় না। গ্রীষ্মকালের এ সময়টাকে ‘মেরু দিন’এবং শীতকালের এই সময়টাকে ‘মেরু রাত্রি’ বলা হয়। স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের দেশ সুইডেনের কিরুনা শহর আর্কটিক সার্কেল বা উত্তর মেরু বলয়ের আরও ১৪৫ কিলোমিটার ভেতরে। এখানে গ্রীষ্মকালেও পর্বতের চূড়াগুলো সাদা বরফে ঢাকা থাকে। পুরো গ্রীষ্মকালেই রাতের আকাশ থাকে অনেকটাই আলোকিত। আর শীতকালে দিনের আলোর দেখা মেলা ভার।

এবার এপ্রিল মাসে রোজা শুরু হয়েছে, তাই সুইডেনের কৃষিখেতে কাজ করেছি সকালে। এক ঘণ্টা কাজ শেষে সবাই বলল, কফি টাইম ফিকা করব। আমি বললাম, তোমরা যাও, আমি কাজ করতে থাকি। সবাই একসঙ্গে বলল, না তুমিও আসো। আমি বললাম, আমি রোজা, গতকাল থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই বলল, সরি রহমান, ভুলে গেছি যে রমজান শুরু হয়েছে। এ কথা শেষে তারা বলল, তাহলে আমরা কুইক ফিকা সেরে আসছি। সুইডিশ ফিকা বলতে দেশে আমরা বলি নাশতা করা। আমি বললাম, তাড়া নেই, তোমরা যখন খুশি আসো। গ্রুপের মধ্যে একজনের নাম জুং। সে বলল, রহমান, আমি রোজা রাখতে চাই।

আমি বললাম, সেকি! জুং বলল, আমি খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী, তবে রোজা রাখার খুব শখ। আমি বললাম, তাহলে কাল থেকে শুরু করো। জুং ফিকায় না গিয়ে আমার সঙ্গে কাজ করতে থাকল। জুংয়ের বয়স ৩০ বছর। এক ছেলের বাবা। ছেলের বয়স চার। জুং বলল, রহমান, কী বলব ছেলেকে, সে যখন জিজ্ঞাসা করে, বাবা, মানুষ মানুষকে কেন গুলি করে মারছে? করোনার সময় সবাই সবাইকে সাহায্য করেছে, অথচ এখন খুন করছে? রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে কথা উঠলে যা হয়, অনেক কথা আলোচনা হলো আজ। আলোচনা শেষে আমার ভাবনায় যে চিন্তা ঢুকেছে, এর অংশবিশেষ শেয়ার করছি।

পাশ্চাত্যের চার্চগুলো জনশূন্য, অথচ পাব বা বারে মানুষে ভরা। তারা চার্চে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে বলতে হয়। চার্চের পরিবর্তে প্রকৃতি বা সাগরের পাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করে, নির্জন জঙ্গলে সময় কাটায়। যা দেখা বা শোনা যায় না, তাতে সময় দিতে বা কথা বলতে তারা চায় না। চার্চে বসে বসে ভাবার চেয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো ভালো, ৮০ শতাংশেরও বেশির ভাগ মানুষের সঙ্গে কথা বললে এমন উত্তর মিলবে। আমি তর্কে না জড়িয়ে, বরং যেটা আমার বিবেকে ভালো মনে হয়, সেটাই বলি। আমি মনে করি, স্রষ্টা আদেশ করেছেন রোজা রাখার, নামাজ পড়ার, সেগুলো করলেই হলো। আমরা স্রষ্টার নির্দেশনা থেকে যত দূরে সরে যেতে চেষ্টা করছি, ততই মহামারি, মানুষে মানুষে ঘৃণা, গণহত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি—এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি। যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে বিশ্বের নানা ধরনের যুদ্ধে, এর দশ ভাগের এক ভাগ যদি মানুষের সেবায় ব্যয় হতো, তবে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটত বিশ্বে। আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য পেতাম আরও বেশি।

এখন পাশ্চাত্যে না হয় এরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না বুঝলাম, কিন্তু আমাদের জগতে তো সবাই ধর্মকে গুরুত্ব দেয়। তাহলে সেখানে কেন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না? তাহলে কি আমরা লোক দেখানো ধর্মে মগ্ন? আমরা নিজেদের ঠকাচ্ছিনা তো? যাহোক না কেন, আর যা–ই করি না কেন, এতটুকু বলতে চাই, ধর্মকে মন থেকে বিশ্বাস করার মধ্যে মজাই আলাদা।

সুইডেনের রমজান মাস বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই পালিত হয়। শুধু সময়ের পার্থক্যটাই লক্ষণীয়। ৩ এপ্রিল সূর্য উঠেছে ৬টা ৯ মিনিটে এবং অস্ত যাবে ৭টা ৩৪ মিনিটে। আমাদের এখানে রোজা শুরু হয়েছে ২ এপ্রিল থেকে। খুব কম লোকই আছে, এখানে যারা ভোররাতে রান্না করে। সবাই রাতের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে যায় এবং সূর্য অস্ত গেলে রোজা ভাঙে। প্রতিদিন তারাবিহর নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সব দেশের মুসলমানেরা একত্রে তারাবিহর নামাজ পড়ে।

এবার বসন্তের শুরুতে রোজা শুরুর কারণে প্রতিটি দিনই বড় হতে থাকবে। বিস্ময়কর পৃথিবী, সবকিছু চলছে তার গতিতে, কোনো কিছুরই অভাব নেই, অভাব শুধু আমাদের মানবতা এবং মনুষ্যত্বের। পাশ্চাত্যে তারা কিন্তু রোজা থাকে, তাদের মতো করে যাকে আমরা ‘উপবাস রাখা’ বলি। রমজান মাসের রোজা সুইডেনের সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে আরব দেশের প্রায় দ্বিগুণ সময়, যা নিশ্চয় একটু কঠিন সময়।

সুইডেনে এবারের রোজা বসন্তে হওয়ার কারণে কিছু সময় দিন শেষে রাত হবে। তা না হলে যদি রোজা শীত অথবা গ্রীষ্মে হতো তবে সূর্য না ওঠার সমস্যার পরিবর্তে তখন সূর্য না–ডোবার সমস্যায় পড়তে হতো। গ্রীষ্মকালে দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখার পরিবর্তে শীতে তখন মাত্র কয়েক ঘণ্টা রোজা রাখতে হতো। সবাইকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা।

লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন