সুস্থ থাকাই সবচেয়ে বড় সুখ

সকাল সাতটায় বুয়া এসে ঘরের কাজ শুরু করেছে, লাউড স্পিকারে গান বাজছে। গোসল সেরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। হঠাৎ বুয়া বলল, আপা আমার স্বামীর অপারেশন লাগবে, অনেক টাকার দরকার।
কয়েকদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় হাসপাতালে ছিল বলেছিল।
-পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে, লাখ খানিক টাকা লাগবে, আমার কাছে ৮০ হাজার টাকা আছে। কিন্তু বাকিটা জোগাড় করতে পারতেছি না, যদি একটু সাহায্য করতেন?
৮০ হাজার কোথায় পেলে?
আমি জমাচ্ছিলাম আর ২০ হাজার টাকা সমিতি থেকে নিছি।
আচ্ছা দেখি কি করা যায়।
কথা শোনার পর ভাবলাম, ‘বুয়া তো অনেক ভালো, সে ঘরের কাজ করে ৬০ হাজার টাকা জমিয়েছে। আমি এত পয়সা পেয়েও তেমন জমাই না। কখন কার কী হয়ে যায়! আজ যদি আমার কিছু হয়, আমি কী করব?
আমার ধারণা, সে দিন মনে মনে বলা আমার এই কথাটি তৎক্ষণাৎ আল্লাহ শুনেছেন। ২/৩টি ফিক্সড ডিপোজিট মাত্র। বেতন পেয়ে নতুন ড্রেস কেনা অনেকটা অভ্যাসের মতো ছিল। প্রতি মাসে ঢাকা সিলেট আসা-যাওয়া এসবে সব খরচ হয়ে যেত। জমানো হতো খুব কম। আমি তখন উড়ছি জীবন, পুরোটাই রঙিন। আয়নায় দাঁড়িয়ে গান শুনতে শুনতে যখন নিজেকে তৈরি করতাম, মনে হতো আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী সেই মানবী।
তখন সিটিসেলে চাকরির দুবছরও হয়নি। অফিসে গিয়ে সে দিনই শুনলাম, তৎকালীন হোটেল শেরাটনে মটোরোলার প্রোগ্রাম ও ডিনার। জীবনে প্রথম যাব পাঁচ তারকা হোটেলে। আমি রীতিমতো উত্তেজিত। বিকেলে এসে গোসল সেরে বের হয়েছি, দাঁত ব্রাশ করার জন্য টুথপেস্ট নিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়াতে গিয়ে নিচে ফেলা শ্যাম্পুর মধ্যে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম...চেষ্টা করলাম বাম হাত দিয়ে বেসিন ধরে নিজেকে ব্যালেন্স করব। কিন্তু না, পারলাম না! সারা দেহ মাটিতে পড়ার আগে মনে হলো বাম হাতটাই মাটিতে ঠাস করে পড়েছে। ব্যথা পেয়েছি প্রচণ্ড, পুরো শরীরের বাম দিকটা বিশেষ করে হাত ও মাথায়। মাথায় তোয়ালে ছিল বলে বেঁচে গেছি। কোন রকম উঠে ব্রাশ করে গোসল সারলাম এবং এক সময় সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম। সেটা ছিল বেশ আনন্দের। বুফে ডিনার সব মিলিয়ে আমার জন্য অনেক বড় অভিজ্ঞতা। আমি বিকেলে পড়ে ব্যথা পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।
পরদিন অফিস ডেস্কে কাজ করছি, একটা ফিক্সড ফোন ছিল টেলুলার। টেলুলার বেশ ভারী, আমি বাম হাত দিয়ে সব-সময়ই এটি ওঠাই। পেছন থেকে সেটি উঠিয়ে সামনে একজন গ্রাহককে দিতে যাব, দেখি ওঠাতেই হাতে ব্যথা অনুভব হলো কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত। গ্রাহক চলে গেলে সহকর্মী লিজা আপাকে দেখালাম, ‘দেখেন তো আমার হাত ফোলা লাগে কিনা? ব্যথা করছে। গতকাল বাথরুমে পড়ে গেছি। উনি বিশাল এক লেকচার দিলেন, ‘হ্যাঁ তাই তো দেখছি, ডাক্তার দেখাও। আজকেই যাও ক্লিনিকে, ফ্র্যাকচার কিনা বুঝতে হবে। কী হলো তোমার, দুদিন পর পর পড়ে যাও?’
সহকর্মী লিজাকে দেখিয়ে তো মহামুসিবতে পড়লাম, ‘না ডাক্তার দেখানো লাগবে না’। এ কথা বলার পর আবারও তিনি খ্যাকখ্যাক করে উঠলেন, ‘আজকেই বাসায় যাওয়ার আগে একটা সেল্ফ এক্স-রে করিয়ে নাও।’ এই মহিলার কর্কশ কথার নিচে ভালোবাসা হঠাৎ করে কেউ বুঝতে পারবে না। এর সপ্তাহ দুই আগে অফিসে পড়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছিলাম। নিজে নিয়ে গিয়ে বারডেমে তাঁর এক ডাক্তার বন্ধুর মাধ্যমে সব চেকআপ করিয়ে তবে নিশ্চিত হয়েছেন আমার কিছু হয়নি। সে দিন উনি না বললে, আমি এক্স-রে করাতাম না। আসার পথে ধানমন্ডির সাত মসজিদ সড়কে ইবনে সিনার ক্লিনিকে নেমে এক্স-রে করিয়ে বাসায় এলাম। পরদিন সন্ধ্যায় রিপোর্ট দেবে, অফিস থেকে ফেরার পথে নামলাম। একটা অল্পবয়সী লোক রিপোর্ট দিল না। বলল, আপনার ফ্র্যাকচার হয়নি তবে ডাক্তার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি অধৈর্য! একে তো এসেছি বেবিট্যাক্সি দিয়ে, রাস্তার ধুলাবালি লেগে আছে গায়ে। ক্লান্ত লাগছে, চলে যাব। ডাক্তার তখনো এসে পৌঁছাননি। জোর করে তো রিপোর্ট নেওয়া যাবে না! অনেক তর্ক করার পর সে এতটুকু বলেছে, আমার কঠিন কোন রোগ আছে। বাসা কাছেই, ধানমন্ডি উনিশ নম্বরে থাকি, স্টার কাবাবের পেছনে। কী আর করা বসলাম।
ইউনিভার্সিটি শেষ করে একটা ভালো চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর যে মেয়ে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্নে বিভোর, তাকে যদি হঠাৎ কোন ডাক্তার বলেন, তোমার প্যারেন্টস কোথায়? তখন মনের অবস্থা কী হতে পারে! জবাব দিলাম, জি নেই
-ওহ, এখানে (ঢাকা শহরে) অভিভাবক কে?
-জি কেউ নেই, আমার ছোট ভাই থাকে আমার সঙ্গে। তবে সে এখন সিলেটে। বড় ভাইবোনেরাও ওখানে।
রোগটা বোঝানোর জন্য উনি অন্য একটা ভালো হাতের এক্স-রে নিয়ে আমার এক্স-রের রোগ চিহ্নিত অবস্থা দেখালেন। প্রথমে কিছু হাড়ের মজ্জা নিয়ে বায়োপসি করতে হবে এবং রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী চিকিৎসা হবে। অপারেশন এখানে, ভারতে, সিঙ্গাপুরে যেখানে ইচ্ছে করাতে পারো।
ডাক্তার সাহেব বয়সী মানুষ, নাটকীয়ভাবে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘তোমার একটা অসুখ আছে, হতে পারে স্বাভাবিক, আবার টিবি বা ক্যানসার টিউমার। রিপোর্ট না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না। ভয়ের কিছু নেই। অপারেশন করলে ভালো হয়ে যাবে। টিবি টিউমার ওষুধ খেলে ভালো হয়ে যায় শুধু....।
হাসি মুখের হাসি থেমে গেছে, চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে....। ডাক্তার সাহেব আবারও বললেন, ‘কেঁদো না মামনি, এখন সব রোগের চিকিৎসা আছে।’
এটা কোনো নাটক, সিনেমার দৃশ্য বা গল্প নয়, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা।
তারপর এক দুঃসময় কেটে গেছে, সেটা ছিল অস্টিওক্লাস্টোমা। আমি দ্বিতীয়বারের মতো এই পৃথিবীতে জন্ম নিলাম। এর পেছনে অবদান ছিল সিটিসেলের মালিক ও সহকর্মীদের, ভাইবোনের এবং আমার প্রেমিকের। বিশেষ করে আমার ছোট দুই ভাই যা করেছে, তার ঋণ সাত জন্ম বোন হয়ে জন্মালেও শোধ করতে পারব না। মৃত্যুর আগে অবশ্যই সব নিয়ে একটা বইয়ে লিখে যাব। চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা হলো। জীবনে একটা কঠিন অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে আছি এবং সুস্থদের চেয়েও সুস্থভাবে। এ জন্য বিধাতার কাছে সদাই কৃতজ্ঞ। তিনি সত্যিই মহান।
আমি ২০০০-২০১২ পর্যন্ত নিয়মিত শুধু ফলোআপ চেকআপ চেন্নাইতে করাতাম এবং ভালো ছিলাম। ডাক্তার পরিষ্কার জানালেন, কোন অসুখ চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুয়ায়ী বছর তিনের মধ্য ফেরত আসে যদি তার জীবাণু থাকে। তোমার কোন সমস্যা নেই।
এ দেশে প্রতিবছর শরীর চেকআপ করতে হয়। আগে ফাঁকি দিলেও গত দুবছর ধরে যাই। সব ভালো, হাড়ের কোন সমস্যা নেই, তবে সফট টিস্যুর সমস্যা আছে। মাস দু-এক আগে আবারও চিন্তায় পড়ে গেলাম। রিপোর্ট খারাপ হলেই এ দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাকে। ফোন পাওয়ার পর থেকে অস্থির সময় পার হলো। যখন কাউকে চিকিৎসক খারাপ কোন রোগের উপসর্গ খুঁজে একটার পর একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেয়, তখন একমাত্র সেই মানুষটাই জানে, তার ওপর দিয়ে কতটুকু চাপ বয়ে যায়। রোগ হয়তো নিরাময় হয় কিন্তু দেখা যায় সবচেয়ে বেদনাদায়ক হয় যখন চিকিৎসক বলেন, ‘তুমি এখন রোগের শেষ পর্যায়ে, তোমার হাতে সময় কম।’
কিন্তু রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত আশা-নিরাশার দোলায় দুলতে হয়। এই সময়টা যে কত দীর্ঘ, তা একমাত্র সেই মানুষটাই জানে। সবার সামনে ভালো থাকলেও একান্ত কোন মুহূর্তে হঠাৎ হয়তো হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আমি অনেক আনন্দ-ব্যস্ততার মাঝে এ সময়টা পার করছিলাম। সেই সঙ্গে রাজিব মীরের কথা তার বোনদের কথা, অনুভব উপলব্ধিতে সারাক্ষণ জানান দিচ্ছে। আমি অনুভব করি আমার ভাইদের মুখ। এর মধ্যে অনলাইনে জয় আমাকে শুধু সাহস জোগায়। আমি তেমন কাউকে বলিনি। ২১ জুন বায়োপসি রিপোর্ট দেবে, যেতেই নার্স গাউন বের করে বলল, পোশাক বদল করে অপেক্ষা করতে, ডাক্তার আসছেন। আমি ধরেই নিয়েছি রিপোর্ট খারাপ। চোখে পানি আসছিল না, কিন্তু সব শূন্য মনে হলো।
চিকিৎসক আমার বয়সী মেয়ে বা সামান্য কমবয়সী হতে পারে। এ দেশের চিকিৎসকদের ফেরেশতার মতো মনে হয়। সে গল্প পরে লিখব। কেমন অনুভব করছি জিজ্ঞেস করার পর বললাম, ‘টিস্যু নেওয়ার দুদিন পর ব্যথা হয়েছে, আগে আমার রিপোর্ট বলেন।’ আমার করুণ মুখ দেখে হাসি মুখে বললেন, ভালো। যদিও আমরা সন্দেহ করেছিলাম ক্যানসার! যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, ইচ্ছে করছিল তাকে জড়িয়ে ধরি। কোন আপনজন সঙ্গে নেই। জীবনের অনেক কঠিন সময় আমি একাকী পার করেছি। সিলেট থেকে ঢাকায় ভাইবোন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কিন্তু এ বিদেশ বিভুঁইয়ে জীবনে কী হবে? আমার একটাই চিন্তা, মেয়েটার যত্ন কে নেবে? কে খাওয়াবে যদি হাসপাতালে ভর্তি হতে হই? স্কুলে যাওয়ার সময় বলেছে, ‘Don’t worry you will be fine।’ আমার অ্যাঞ্জেল আগেই যেন জানত।
মুহূর্তে নিজেকে হালকা মনে হলো, অথচ ভারী এক বোঝা দুই মাস আমি বয়ে বেড়িয়েছি। ঘুরেফিরে হিন্দি সিনেমা ‘কাল হো না হো’ ছবির কথা মনে পড়ে যেতো। সেই থেকেই সেই ভালোবাসার ব্রিজের গল্প লিখে ফেললাম। আমি নিজের অসংখ্য সেলফি তুলি পোস্ট করি। নিজেকে খুঁটিয়ে দেখি। নিজেকে ভালোবাসতে না পারলে কেউ অন্যকে কীভাবে ভালোবাসবে? পৃথিবীটা যে সুন্দর, তা এমন অবস্থান থেকেই বোঝা যায়। বের হয়ে মনে হলো, আমি উড়ছি নিউইয়র্ক শহরে। সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটসে মেজবান রেস্তোরাঁয় গেলাম এক অপার শান্তি নিয়ে।
যার শরীর ভালো, তার অন্য কোনো দুশ্চিন্তা না করাই ভালো। নিজে সুস্থ থাকলে পৃথিবীর বাকি সব সমস্যা যেকোনোভাবে সমাধান করা যায়। এটা সেই বুঝে যে আমার অবস্থানে থাকে, রাজিবের অবস্থানে থাকে। প্রেমিক-প্রেমিকা গেলে প্রেমিক-প্রেমিকা মিলে, কেউ না কেউ দূর থেকে হলেও ভালোবাসে, সম্পদ গেলে তা মেলে, না হলেও জীবন চলে যায়। ঘরের দামি আসবাবপত্র, দামি বাড়ি-গাড়ির চেয়েও প্রকৃতি অনেক বেশি সুন্দর। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত অপলক চেয়ে থাকার মতো দৃশ্য, যার কারিগর স্বয়ং বিধাতা। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ওপরে তাকালে মনে হয়, যাই হারিয়ে। এর গভীরতা প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার চেয়েও বেশি। তাই বলছিলাম, কেন মানুষ এত সহজে ভেঙে পড়ে? কেন আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়? সব পরিস্থিতি মাথা ঠান্ডা রেখে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। নিজের সুস্থতার মতো সুখ আর কিছুতে নাই, তেমনি অসুস্থ হওয়ার মতো দুঃখ আর কিছুতে নাই। তাই সব দুঃখ সরিয়ে নিজেকে মানসিকভাবেও সুস্থ রাখুন, যাতে বাঁচতে ইচ্ছে হয় প্রতি মুহূর্তে।