সুবাসিত বন্দরের পাহাড়ে পাহাড়ে
নভেম্বর শুরু হয়ে গেছে, সুবাসিত বন্দরে শীত প্রায় আসি আসি করছে। বাতাসে একটা হালকা কনকনে আমেজ পাওয়া যায়, গাছের পাতাগুলোর রংও কেমন ফিকে হয়ে এসেছে। যেহেতু করোনাসংক্রান্ত কড়াকড়ির কারণে শহরের বাইরে কোথাও ভ্রমণ করা অত্যন্ত কঠিন, তাই ছুটির দিনগুলোতে বা অবসরে এ শহরের গণ্ডিতে ঘুরে বেড়ানোই এখন শহরবাসীর কাজ। বিপণিবিতান, পার্ক, সমুদ্রসৈকত সবখানেই যেন মানুষের মেলা। হংকং যদিও বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। এর আয়তন কিন্তু অনেক ছোট—মাত্র ১ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার। শহরটি অনেক ঘনবসতিপূর্ণও বটে, বিশ্বের পাঁচটি সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের মধ্যে হংকং অন্যতম। গত দুই বছর যেহেতু আমরা সবাই বন্দী, তাই বিনোদন এবং মনোরঞ্জনের সব ধরনের উপকরণ এখন আমাদের এটুকু জায়গার মধ্যেই খুঁজতে হয়। তবু বাঁচোয়া যে পাহাড়ঘেরা এবং সাগরবেষ্টিত এ শহরে প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করার জায়গার কোনো অভাব নেই। বিপণিবিতানগুলোতে ঘুরে বেড়াতে ক্লান্ত লাগলে হাতের নাগালেই রয়েছে অপূর্ব সুন্দর সমুদ্রসৈকত অথবা গহিন কোনো পাহাড়ে চড়ার সুযোগ। সবকিছু শেষ করে ক্লান্ত হয়ে, শেষমেশ আমিও পাহাড়ে উঠব বলে ঠিক করলাম।
হংকং শহরটি আদতে অত্যন্ত সবুজ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। আমরা সব সময় হংকংকে একটি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবেই চিনেছি, কিন্তু আসলে এ জানার বাইরে যে একটি হংকং আছে, তা কিন্তু নিখাদ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। চাইলেই অজানা নিঃশব্দতায় হারিয়ে যাওয়া যায়। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল এই সময়টা হাইকিংয়ের জন্য আদর্শ। এ সময় আবহাওয়া একটু ঠান্ডা থাকে, আর সাপখোপের ভয়ও প্রায় থাকে না বললেই চলে। সাধারণত হাইকিংটা কত কঠিন হবে বা কত সময় লাগবে, তা একটু ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পাওয়া যায়, আর প্রতিটি পাহাড়েই জায়গায় জায়গায় ম্যাপ এবং পথনির্দেশনা থাকে। যার যেমন দক্ষতা, সেই অনুযায়ী একটা পাহাড় বেছে নিলেই হলো।
আমি যেহেতু খুব দক্ষ কোনো পর্বতারোহী নই, তাই আমি সাধারণত তুলনামূলকভাবে সহজ, এমন জায়গাগুলোই বেছে নিই। এখানে আমি আমার পছন্দের তিনটি পাহাড়চূড়ার কথা বলব, যেগুলো অনেক জনপ্রিয় এবং অসাধারণ সুন্দর।
ড্রাগনস ব্যাক
আমেরিকার গণমাধ্যম সিএনএনের করা তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের সেরা ২৩টি হাইকিং ট্রেইলের মধ্যে হংকংয়ের ড্রাগনস ব্যাক ট্রেইল অন্যতম। এটার নাম ড্রাগনস ব্যাক কেন? চীনা সংস্কৃতিতে ড্রাগনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, সেটা প্রায় সবারই জানা। এই পর্বতটি দেখতে অন্য যেকোনো পর্বতের মতো হলেও অনেক ওপর থেকে দেখলে মনে হয় একটি ড্রাগন যেন উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ট্রেইলটি প্রায় ৮ কিলোমিটার লম্বা, পুরোটা হেঁটে শেষ করতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা লাগে, সেটাও নির্ভর করে হাঁটার গতি, বিরতি ইত্যাদির ওপর। পুরো পাহাড়টাই একটা কান্ট্রি পার্কের অংশ। প্রসঙ্গত, হংকংয়ের পুরো আয়তনের প্রায় ৭০ শতাংশই এসব কান্ট্রি পার্কের জন্য সংরক্ষিত। কেউ যদি অল্প সময়ে সহজেই শহরটির বৈচিত্র্য দেখতে চায়, তাহলে এ ট্রেইলটির কোনো তুলনা হয় না, সুনীল সাগরের বুকে জেগে ওঠা ছোট সবুজ দ্বীপগুলো ওপর থেকে দেখতে বেশ ভালো লাগে। এ হাইকটি শেষ হয় সমুদ্রসৈকতে, যেখানে আছে ছোট ছোট দোকান আর খাবার জায়গা। একটা লম্বা হাইকের পর ঠান্ডা ডাবের পানিতে গলাটা ভিজিয়ে নিতে মন্দ লাগে না। বড়রা তো বটেই, একটু সাহস আর ইচ্ছা থাকলে বাচ্চারাও এই হাইকটি অনায়াসে করতে পারবে। চারপাশের নিষ্কলুষ সবুজ আর অবাধ্য বাতাস যে কারও মন ভালো করে দিতে বাধ্য।
লায়নস রক
ঐতিহাসিকভাবে বা তাৎপর্যের দিক থেকে লায়নস রক হংকংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্বত। কাউলুন পেনিনসুলার ওপরে রক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতটি প্রায় ৫০০ মিটার উঁচু এবং এখানে প্রচুর গ্রানাইটের তৈরি স্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায়। এর মাঝে একটি গ্রানাইটের চূড়া দেখতে একদম একটি সিংহের মাথার মতো। যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন, দেখে মনে হয় একটি গর্বিত সিংহ যেন মাথা উঁচু করে সতর্কতার সঙ্গে হংকংকে পাহারা দিচ্ছে।
বলা হয়ে থাকে, এ চূড়াটির বয়স ১৪০ মিলিয়ন বছরেরও বেশি। ১৯৭৪ সালে একটি টিভি সিরিজ বানানো হয় ‘বিলো দ্য লায়নস রক’ নামে, যেটা ভীষণ জনপ্রিয় হয়। সেই থেকে এ পর্বতের চূড়াটি যেন হংকংয়ের মানুষের শক্তি, সাহস আর অদম্য লড়াকু মনোভাবের সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায়। এই সবকিছুর পাশাপাশি চূড়া থেকে যে অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়, সেটারও কোনো তুলনা হয় না। এখানে দাঁড়ালে মনে হয় যেন পুরো পৃথিবী আমার পায়ের নিচে। প্রায় পুরো হংকং শহরটিকে একনজরে দেখে ফেলতে চাইলে এই লায়নস রকে একবার অবশ্যই আসা উচিত। যদিও এটাকে সহজ হাইকের মধ্যে ধরা হয়, আমার কাছে মনে হয়েছে এখানে উঠতে গেলে শরীর ও মন দুটোই ফিট থাকা চাই। শুরুর দিকের খাড়া সিঁড়ি ভাঙতে যেমন দম লাগবে, একদম খাদের কিনার দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তেমনি মনের জোরও চাই। বিশ্বখ্যাত ভিক্টোরিয়া হারবার থেকে শুরু করে শা-টিন নদী পর্যন্ত সবই এখানে দৃষ্টিসীমার মধ্যে।
পাইনঅ্যাপল মাউন্টেন
হংকংয়ের প্রতিটি পাহাড়ের নামই খুব আকর্ষণীয় এবং সব কটি নামেরই কোনো না কোনো গল্প আছে। হংকংয়ের একটি জনপ্রিয় খাবার হলো পাইনঅ্যাপল বন। এটি মূলত একধরনের বানরুটি, যদিও এখানে আনারসের নামগন্ধও নেই। তবে এই বানরুটির ওপরের এবড়োখেবড়ো অংশটি দেখতে অনেকটা আনারসের মতো দেখায়। এই পাহাড়টির নাম ‘পাইনঅ্যাপল মাউন্টেন’ রাখার তাৎপর্য হলো পাহাড়টির রং ও প্রকৃতি অনেকটাই দেখতে এই বানরুটিটার মতো। এ পাহাড়টিকে ‘হংকংয়ের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ও বলা হয়ে থাকে। যদিও এটাকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বলাটা একদমই অত্যুক্তি, কিন্তু জায়গাটার সৌন্দর্য একদমই অন্য রকম। মাঝেমধ্যে মনে হয় এ যেন অন্য কোনো গ্রহ।
চারপাশে সবুজ, নীল আর বাদামি—নানান রং খেলা করে। সশব্দ বাতাসে চারদিক কেমন যেন অপার্থিব লাগে। এ জায়গাটির একটা মজার ব্যাপার হলো, পুরো পাহাড়টি পুলিশের ফায়ারিং প্র্যাকটিসের রেঞ্জের মধ্যে পড়ে। তাই মাঝেমধ্যেই এখানকার প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। একটু ওপরে উঠলেই পাহাড়ের অপর পাশেই পুরো শেনঝেন শহরটি স্পষ্ট দেখা যায়। শুরুর দিকে খাড়া ওঠা থাকলেও এই হাইকটা আসলে অনেক সহজ, আমি আমার যাওয়ার পথে ছেলে-বুড়ো সবাইকেই দেখেছি। আসলে এখানে এলে মনটা এত শান্ত হয়ে যায় যে শারীরিক কষ্টটা তখন আর কষ্ট মনেই হয় না।
এগুলো ছাড়াও আমি হংকংয়ের আরও অনেকগুলো পাহাড়ে উঠছি এবং আরও ওঠার ইচ্ছা আছে। সৌন্দর্যের পাশাপাশি আমার এখানে সবচেয়ে যেটা ভালো লাগে, তা হলো নিরাপত্তা। মাঝেমধ্যে চলতি পথে বন্য শূকরের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে বা সাপ-বিছে পথে পড়তে পারে। এ ছাড়া ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। তবে খেয়াল রাখতে হয় যেন বেশি রোমাঞ্চের স্বাদ নেওয়ার লোভে নির্দেশনা ছাড়া বেশি বন্য পথে যাতে কেউ হারিয়ে না যায়।
এসব নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে মনে হয় যেন মনটাও নির্মল আর বিশুদ্ধ হয়ে যায়। এই যান্ত্রিক শহরে লোকের ভিড় আর কোলাহলের মধ্যে এ প্রকৃতির উপহারগুলো যেন বিশুদ্ধ অক্সিজেনের মতো কাজ করে।