
এপ্রিল মাসের কোনো এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে পা রেখেছিলাম নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেটা আমার দ্বিতীয়বারের মতো জাপান যাওয়া। তবে প্রথমবারের চেয়ে এবারের আগমনটা একটু ভিন্ন রকম এই কারণে যে, আগেরবার গিয়েছিলাম পিএইচ ডি প্রোগ্রামে ভর্তির ইন্টারভিউ দিতে আর পরেরবার গিয়েছি পিএইচ ডি করতে। ইমিগ্রেশন দিয়ে বের হয়েই দেখি আমার প্রফেসর একগুচ্ছ ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি যথার্থই অবাক হয়েছি কারণ তার আমাকে নেবার জন্য আসার কথা না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন কষ্ট করে এসেছ? আমিতো এখন সবকিছু চিনি, একাই যেতে পারতাম। তিনি তার স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসি সারা মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে বললেন, তোমাকে নিতে না এসে উপায় ছিল না। তুমি আমার ল্যাবরেটরিতে পিএইচ ডি করবে। এত দূর থেকে কষ্ট করে এসেছ, আরও একবার এসে পরীক্ষা দিয়ে তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করে গেছো, আমি কি আর না এসে পারি।
বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে দেখি তিনি এই লম্বা পথ নিজেই ড্রাইভ করে এসেছেন আমার জন্য। নিজেই আমার লাগেজগুলো গড়িয়ে উঠিয়ে আমাকে নিয়ে ছুটলেন আমাদের গন্তব্যে। প্রায় এক ঘণ্টা ১০ মিনিট ড্রাইভ শেষে তিনি আমাকে আমার বাসায় নামিয়ে দিলেন। আমার এই বাসা তিনি নিজেই ঠিক করে রেখেছেন। বাসায় ঢুকে দেখি মোটামুটি সবকিছুই তিনি জোগাড় করেছেন। আর এই কাজগুলো করেছেন তারই এক সহকর্মী সুসুমি সান। আমরা বাসায় ঢুকে দেখলাম সুসুমি সান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। সেই থেকে সুসুমি সান সার্বক্ষণিক ভাবে আমার সঙ্গেই থাকলেন অনেক দিন। আমার জাপানের সুদীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছরের জীবনে সুসুমি সান ছিলেন ছায়ার মতো।
জাপানে প্রবাসীদের একটা বড় সমস্যা হয় ভাষার কারণে। যেহেতু অনেক জাপানিজ ইংরেজি জানেন না অথবা জানলেও বলতে লজ্জা পান তাই জাপানিজ না জানলে জাপানে থাকা দুরূহই বটে (আমি এখনকার অবস্থা জানি না)। এই সুসুমি সান আমার জাপান জীবনে ভাষাগত জটিলতা কখনই আমাকে অনুভব করতে দেননি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বাচ্চাদের স্কুল, ইমিগ্রেশনসহ সর্বত্র তিনি আমাকে দোভাষী হিসেবে সহায়তা করে এসেছেন। অন্যদিকে আমার প্রফেসর কখনই আমাকে জাপানিজ শেখার ব্যাপারে তাগিদ দেননি। যেহেতু ল্যাবে মোটামুটি সবাই ইংরেজি বলতে পারে তাই জাপানিজ শেখার ব্যাপারে তার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। আমিও এমনিতেই অলস প্রকৃতির তাই তার আশকারা পেয়ে আর সুসুমি সানকে পেয়ে আমার আর জাপানিজ শেখা হয়নি। আমার জাপান জীবনে আমার প্রফেসর ও এই সুসুমি সান এতটাই আমাকে বিভিন্ন ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন আমি জীবনেও তাদের কথা ভুলতে পারব না।
আমি যখন দুমাস আগে পরীক্ষা দিতে যাই তখন আমার প্রফেসর আমাকে বলেছিলেন আমার ফিন্যান্সিয়াল ব্যাপারে আমি যেন কোনো চিন্তা না করি। আমি নিজের থেকে Monkagusho ফেলোশিপে আবেদন করতে চাইলেও তিনি আমাকে করতে দেননি। এরপরে অবশ্য আমাকে কখনই এই ব্যাপারে চিন্তা করতে হয়নি। আমার এই মহৎপ্রাণ প্রফেসর সম্পর্কে দু একটি ঘটনার কথা বলে রাখি। তিনি কোনো দিনও আমার কাজ নিয়ে ভাবতেন না। তার বিশ্বাস আমি দিনের শেষে আমার সব কাজ ঠিকই করে দেব। আসলে হয়েছেও তাই। আমার অভিজ্ঞতা থেকে এইটা আমি শিখেছি, জাপানিজরা কর্মপাগল। আর যারা জাপানে গিয়ে ভালো কাজ করে তাদের বেশির ভাগ বসই বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করে থাকে। অর্থাৎ তারা কর্মপাগল মানুষদের খুব পছন্দ করেন। যদিও আমি একটু ব্যতিক্রমী ছিলাম। কাজের চেয়ে অকাজেই সময় বেশি ব্যয় করতাম।
আমার ছেলের বয়স তখন দুই বছর। জাপানে ডে কেয়ারকে হইকুয়েন বলে। ছেলের মাও চাকরি করবে তাই হইকুয়েন খুঁজতে লাগলাম। টোকিওতে হইকুয়েন পাওয়া খুবই দুষ্কর। আগে থেকে আবেদন করে লাইনে থাকতে হয়। সিট খালি হলে তখন ডাকে। আমরা আবেদন করে অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমাদের এলাকাতে বাসার কাছাকাছি হইকুয়েনগুলোতে কোনো সিট খালি ছিল না। তাই আমার স্ত্রী কাজেও যোগ দিতে পারছিল না। আমি নিজের থেকে এই কথা প্রফেসরকে বলিনি। তিনি সুসুমি সানের কাছ থেকে জানতে পেরে আমাকে নিয়ে একদিন সোজা সিটি হলে গেলেন। সেখানে গিয়ে তার কাজকর্ম দেখে আমিতো রীতিমতো অবাক। তিনি হইকুয়েন ডিপার্টমেন্টের যিনি প্রধান তার সঙ্গে দেখা করলেন। তাকে তিনি যা বললেন তা হলো, দেখো তোমাদেরকে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এই ভদ্রলোককে আমি কষ্ট করে আমার ল্যাবের জন্য পেয়েছি। সে অনেক মেধাবী, এমন মেধাবী ছাত্র আমি হারাতে পারব না। তোমরা যদি তার ছেলেকে একটা ব্যবস্থা না করে দাও তাহলে সে গবেষণা ছেড়ে চলে যাবে। আমি বুঝলাম তিনি অনেক ভাবে সেই ভদ্রলোককে বোঝালেন। সেও নাছোড়বান্দা, কোনো ভাবেই সে নিয়ম ভেঙে আমার ছেলেকে নিতে পারবে না। আমার প্রফেসরও আরও এক ডিগ্রি ওপরে। তিনি এক এক করে নাকানো সিটি কাউন্সিলের নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরলেন। হতে পারে সেসব কোনো মারাত্মক অনিয়ম না। কিন্তু যে ভাবেই হোক আমার ছেলে যাতে হইকুয়েনে সুযোগ পায় তার জন্য সবকিছুই করলেন। একটা লম্বা সময় তর্ক বিতর্কের পরে ভদ্রলোক রাজি হলেন কিন্তু বিমর্ষ বদনে।
একবার আমি ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করলাম। ভিসা কোম্পানি আমাকে সরাসরি না করে দিল। তারা জানাল যেহেতু তোমার জাপানে কোনো সম্পদ নাই তাই আমরা তোমাকে কার্ড দিতে পারব না। একদিন কথায় কথায় প্রফেসরকে এই কথা জানালাম। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে জানালেন, আচ্ছা তুমি কি তোমার দেশ থেকে এমন একটা পেপার আনতে পারো যেখানে তোমার আবাদি জমিজমার পরিমাণ উল্লেখ থাকবে? আমি কাঁচুমাচু করে বললাম, পারব। যাই হোক বড় ভাইয়ের মারফত অমন একটা কাগজ পেয়ে গেলাম। প্রফেসর সেই কাগজসহ আমাকে আবার দরখাস্ত করতে বললেন এবং রেফারেন্স হিসেবে তার নাম দিতে বললেন। আমি তাই করলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ লাখ ইয়েনের (তখন পাঁচ হাজার আমেরিকান ডলার) ক্রেডিট লিমিটসহ একটা ভিসা কার্ড পেয়ে গেলাম। আমি জানি না টেলিফোনে ভিসা কোম্পানিকে তিনি কি বলেছিলেন।

ওপরের দুটি ঘটনা উদাহরণ মাত্র। এমন অনেক দৈনন্দিন ব্যাপারে তিনি আমাকে অনেক ভাবে সহায়তা করেছেন। আজকে ভাবি আমার দিক থেকে আমি আমার গবেষণা কর্ম আর কয়েকটা পাবলিকেশন ছাড়া তাকে কিছুই দিতে পারি নাই। এমনকি সব শেষে স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভেবে নিজের পরিবারের কথা ভেবে জাপান থেকে চলে এসেছি কানাডায়। যেহেতু জাপানে ছেলেমেয়েদের ভাষাগত সমসার কারণে পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটবে তাই চলে আসতে হয়েছে। কিন্তু আসার সময়ও তিনি আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। যেখানে যেমন রেফারেন্স লেটার দরকার তিনি দিয়েছেন। কোনো দিনও বলেননি তুমি আরও কিছুদিন থেকে আমার সব কাজ শেষ করে দিয়ে যাও। পিএইচ ডি শেষ করে দু বছর জেএসপিএস পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ নিয়ে কাজ করেছি। অসমাপ্ত কাজগুলো পরে তিনি অন্য ছাত্রদের দিয়ে করিয়েছেন। এখনো প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার যোগাযোগ হয়। কাজের খোঁজ নেন, পরিবারের খোঁজ নেন। মনে হয় তিনি আমার পরিবারেরই একজন। নিজেকে খুব ধন্য মনে হয় এমন একজন বড় মনের মানুষের সঙ্গে জীবনের সুদীর্ঘ একটা সময় পার করেছি। সদা কর্মচঞ্চল, উচ্ছল এই মানুষটিকে কোনো দিন মন খারাপ করতে দেখিনি। দেখেছি শুধু একদিন। আমরা যেদিন চলে আসলাম। তিনি আমাদের শিনজুকু বাস স্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। সবগুলো লাগেজ এক এক করে বাসে উঠিয়ে দিলেন। আমাকে একটাও ধরতে দিলেন না। আমার দুই সন্তানকে অনেকক্ষণ ধরে আদর করলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ফিসফিস করে বললেন, কানাডা যাও, ওটাই হয়তো তোমাদের জন্য ভালো জায়গা। কিন্তু যদি ভালো না লাগে, চলে এসো। আমার ল্যাবে তোমার জন্য সব সময় একটা পজিশন থাকবে। আমাদের বাস ছেড়ে দিল। জানালার পাশে সিটে বসে হাত নাড়তে লাগলাম। দেখলাম তার পকেট থেকে এইবার তিনি রুমাল বের করলেন। এইবার তিনি চোখ মুছলেন। তার চোখের জলে আমার অনিশ্চিতের যাত্রা স্নাত হলো।
সব সময় ভাবি এইটাই বুঝি মানুষে মানুষের আসল সম্পর্ক। যে সম্পর্কটি গড়ে উঠেছিল কাজ দিয়ে। এখন তা হৃদয়ের। সার্থহীন, চাওয়া পাওয়া হীন একদম হৃদয়ের অন্তস্তলের। এমন একজন মানুষ বেঁচে থাকুন অনন্তকাল এই প্রার্থনা করি। (চলবে)।