সুখের অন্বেষণে

ছোটবেলায় তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। তাঁকে আমি চাচা ডাকতাম৷ তিনি এ দেশে এসেছেন অনেক আগে, তাঁর যুবক বয়সে৷ সুন্দর জীবনের অন্বেষণে। দেশে স্ত্রী আর ফুটফুটে দুটি যমজ মেয়ে। একটু গুছিয়েই দেশে ফিরে যাব করতে করতেই অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেল তাঁর জীবন থেকে। মেয়েরা বড় হতে থাকে, খরচ বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে তাঁরও দায়িত্বও। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ভালো কাজও পাননি। কিছুদিন এই কাজ তো কিছুদিন আরেক কাজ। সংগ্রাম করে টিকে থাকা এক বাবা। তবুও বাবার দায়িত্ব শেষ না করে ফিরে যাবার নয়। অক্ষমতার কাছে মাথা নোয়াবার নয়।
তারপর একসময় আমিও এলাম এ দেশে৷ এখানে আসার পর হঠাৎ একদিন দেখা হয় আমাদের। তিনি বললেন, ‘দুইটা ডাক্তার কন্যার বাবা আমি, বুঝলি?’ বুকভরা গর্ব আর চোখেমুখে তাঁর কেমন যেন এক সুখের আলোকচ্ছটা খেলে গেল৷ কোনো শব্দ চয়ন কিংবা শব্দের মাধুর্য দিয়ে তা বোঝাবার ক্ষমতা নেই আমার। শুধু বলি, ‘আঙ্কেল, ওদের কাছে ফিরে যান।’ তিনি বলেন, ‘মেয়েদের বিয়ে দিতেও তো টাকা লাগবে। আমার তো সঞ্চয় কিছু নেই। বিয়েটা সেরে ফেললে আর পিছুটান থাকবে না।’ বুঝি যে, আমরা যা-ই বলি না কেন, বাস্তবতা গল্পের মতো কিংবা স্বপ্নের মতো সুন্দর নয়। অনেক কঠিন, নির্মম।
কিছুদিন পর জানলাম তাঁর মেয়েদের ভালো বিয়ে হয়েছে। আমি যারপরনাই খুশি হলাম। এবার নিশ্চয় তিনি ফিরে যাবেন পরিবারের কাছে। সেই ছোট্ট পরী দুটি তো আর ছোট্টটি নেই। দুর্দান্ত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবে না হয়তো। তবে বাবার শিয়রে বসে অসীম ভালোবাসায় হাতখানি তো অন্তত কপালে, মাথায় বুলিয়ে দেবে। যে হাতগুলোর পরশ সেই কঠোর সংগ্রামী বাবার এতকালের সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। সব! সব!
আজ তাঁর কর্মস্থল সেই গ্রোসারি স্টোরে বাজার করতে গিয়ে জানলাম তিনি হাসপাতালে। ব্রেইনস্ট্রোক হয়েছিল তিন সপ্তাহ আগে। সহকর্মীদের কাছ থেকে হাসপাতালের রুম নম্বর চেয়ে নিলাম। সব ব্যস্ততা পিছু ঠেলে ছুটলাম। আমি ছুটলাম তাঁকে দেখতে, যিনি প্রায়ই বলতেন, ‘তোকে দেখলে মেয়ে দুটির কথা মনে পড়ে। দুদণ্ড শান্তি পাই মনে।’
হাসপাতালে রুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে যাই। বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় এক একটি যন্ত্র। জীর্ণশীর্ণ নিথর দেহখানা আমার হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেয়। কাছে, খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তাঁর মুখের অবয়বে আমি আমার বাবার ছবি দেখতে পাই। ক্ষণিক আবেগাপ্লুত নত হয়ে থাকি। ভেতরের সবটুকু শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিই। কানের কাছে গিয়ে বলি, ‘আঙ্কেল, আমি রিমি।’ তিনি নিষ্প্রভ, নিস্তেজ। কন্যাসম আমি অজানা এক অভিমানে একাকী আনমনে বলে উঠি, ‘এত দিনে গুছানো হলো বুঝি!’
বাইরে ঝকঝকে রোদ। আমি মিশে যাই এই শহরের ব্যস্ত মানুষজনের ভিড়ে…কোলাহলে৷
রিমি রুম্মান চৌধুরী
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র