সুইসাইড নোট

সুইসাইড নোট কী? সাধারণত আত্মহত্যা করার আগে যখন কোনো ব্যক্তি কিছু লিখে যান, তাকেই সাধারণত সুইসাইড নোট বলি। দেখা যাক, একজন মানুষ আত্মহত্যা করার আগে কেন সুইসাইড নোট লিখে যান? দেখা যায়, বিভিন্ন করণেই যাঁরা আত্মহত্যা করেন, তাঁরা সুইসাইড নোট লিখে যেতে পারেন। কারণগুলো হলো: ১. মৃত্যুর আগে ব্যক্তিটি তাঁর যাপিত জীবনের সব দুঃখ, বেদনা, ব্যর্থতা সবকিছু সুইসাইড নোটে বর্ণনা করেন; ২. ব্যক্তিটি তাঁর মৃত্যুর আগে মৃত্যুর যথাযথ কারণটি সুস্পষ্টভাবে সুইসাইড নোটে ব্যাখ্যা করেন; ৩. নিজের মৃত্যুর মাধ্যমে অন্যকে শিক্ষা দিতেও সুইসাইড নোট লেখা হয়; ৪. জীবিত অবস্থায় যে কথাগুলো বলা হয়ে ওঠেনি বা বলা সম্ভব ছিল না, সে–ই গোপন সত্য কথাটি মৃত্যুর আগে অনেকেই সুইসাইড নোটে লিখে যেতে চান; ৫. সুইসাইড নোটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কেমন হওয়া উচিত, তার একটি দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে; ৬. নিজের কৃতকর্মকে স্বীকার এবং দুঃখ প্রকাশ করতেও সুইসাইড নোট ব্যবহার করা হয়। 

এই সুইসাইড নোট লিখে পৃথিবীর অনেকেই বেশ জনপ্রিয় হয়েছেন। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যখন আত্মসমর্পণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো, তখন জাপানি সেনাদলের জেনারেল কোরেচিকা আনামি তাঁদের রাজা হিরোহিতোকে উদ্দেশ করে একটি সুইসাইড নোট লেখেন এবং আত্মহত্যা করেন। তাঁর নোটটি ছিল, ‘I-with my death-humbly apologize to the Emperor for the great crime.’ আমেরিকার হলিউডের নায়িকা ক্লারা ব্লানডিক মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে সুইসাইড নোটে লেখেন, ‘I am now about to make the great adventure.’ ৩৫ মিমি ফিল্মের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? এর আবিষ্কারক ও ইস্টম্যান কোডাকের প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ইস্টম্যান আত্মহত্যা করার আগে তাঁর সুইসাইড নোটে লিখেছিলেন, ‘To my friends: my work is done. Why wait?’ বিখ্যাত ফরাসি সংগীতশিল্পী দালিদা মৃত্যুর আগে লেখেন, ‘Life has become unbearable... forgive me.’ ব্রিটিশ পুরস্কারপ্রাপ্ত সেই অভিনেতার কথা নিশ্চয় মনে আছে? আত্মহত্যা করার আগে তিনি তাঁর সুইসাইড নোটে লেখেন, ‘Dear World, I am leaving because I am bored. I feel I have lived long enough. I am leaving you with your worries in this sweet cesspool. Good luck.’
এবার মূল ঘটনায় আসা যাক। ২০১১ সালের দিকের ঘটনা। নিউইয়র্কের বাঙালিপাড়া জ্যাকসন হাইটসে হইচই। সেখানের একটি অ্যাপার্টমেন্টে এক বাঙালি আত্মহত্যা করেছেন। সুদূর আমেরিকায় বাঙালির আত্মহত্যা? আহা! কত দুঃখভরা ছিল তাঁর জীবন! আত্মহত্যা করার আগে তিনি নাকি একটা ‘সুইসাইড নোট’ লিখে গিয়েছিলেন। আহারে বেচারা! নিজের দেশ থেকে কত স্বপ্ন নিয়ে এই বাঙালিরা আমেরিকায় আসেন। তারপর? কেমন থাকে সেই বাঙালি? কী এমন দুঃখ তাঁর ছিল, যে কারণে মৃত্যুর মাধ্যমেই তিনি জীবনের সব জ্বালা–যন্ত্রণার ইতি ঘটাতে চেয়েছিলেন? তিনতলা ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট ঘিরে বাঙালিদের চাপা ফিসফাস। সত্যি বলতে বাঙালি কমিউনিটিতে সেদিন ভয়াবহ রকমের শোকের ছায়া নেমে এল। জানা গেল, ভদ্রলোক থাকতেন অ্যাপার্টমেন্টের দ্বিতীয় তলায়। বয়স টেনেটুনে ৫০ হবে। খুব চুপচাপ আর নিরীহ কিসিমের মানুষ ছিলেন। বাঙালিদের আড্ডাতেও তাঁকে খুব একটা দেখা যেত না। মৃত্যুর দুদিন পর তাঁর বাসায় পাওয়া গেল ‘সুইসাইড নোট’। পুলিশ রিপোর্টে বেরিয়ে এল বিষ খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে মৃত্যুর আগে তিনি একটি ‘সুইসাইড নোট’ রেখে গিয়েছিলেন। সেখানে লেখা ছিল, ‘এই আমেরিকা আমার জন্য নয়, এই পৃথিবী আমার জন্য নয়।’ আহারে! কেন এমন কথা লিখতে হলো তাঁর?
জানা গেল তিনি বাংলাদেশ থেকে সদ্য এসেছিলেন। নিউইয়র্কে তিনি নতুন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও একটা কাজ জোটাতে পারেননি। অন্যদিকে বাংলাদেশে রয়েছে তাঁর পরিবার–পরিজন। সবাই তাঁর দিকে চেয়ে আছেন। দেশ থেকে মোটা অঙ্কের দেনার বোঝা কাঁধে নিয়ে তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমান। একদিকে দেনার দায়, অন্যদিকে আমেরিকার কঠিন জীবনের সঙ্গে নিত্য জীবনসংগ্রাম। তারপর একদিন জীবনের কাছে হেরে গেলেন। মৃত্যুই হয়তো তাঁকে সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিল। অথচ তাঁরও নিশ্চয় আরও দশজন প্রবাসীর মতো অনেক স্বপ্ন ছিল? নিশ্চয় আমেরিকায় আশার আগে তাঁর প্রিয় মানুষটাকে চুমু খেয়ে বলেছিলেন দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো ডলারের দেশেই যাচ্ছি। কত কথাই মনে হচ্ছে লোকটাকে নিয়ে। এত তাড়াতাড়ি রণেভঙ্গ দিতে হলো? না, ভাবাই যায় না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব জীবনবাদী। জীবনকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। এই আমেরিকা আমাকে যন্ত্রণা কম দেয়নি। কিন্তু দিয়েছেওতো অনেক। সে কথা অস্বীকার করি কোন সাহসে? তারপরও কোথায় যেন মনের ভেতর একটা খচখচ শব্দ টের পাই। নিজেকে মারার আগে যখন কয়েকটা শব্দ গোট গোটা অক্ষরে লিখছিলেন, তখন কি একবারের জন্যও কেঁপে ওঠেনি? বাংলাদেশে ফেলে আসা প্রিয় মানুষদের চেহারা একবারের জন্যও কি চোখের সামনে ভেসে ওঠেনি? লোকটার কথা মনে হলেই বুকের মধ্যে কোথায় যেন রাজ্যের হাহাকার নেমে আসে। তখন চারদিকে শুধু দেখি বেদনার কাব্য। যে বেদনা প্রবাসীর ছোট্ট বুকের ভেতরে তিল তিল করে বাসা বাঁধে।
নিউইয়র্কে ইদানীং হুটহাট আত্মহত্যা করে মানুষ মরার খবর পত্রিকার পাতায় ভেসে আসে। সে খবর পরে আমরা প্রবাসীরা ফেসবুকে লেখালেখি করি, বেদনায় নীল হয়ে মৃত ব্যক্তিটির পরিবার–পরিজনদের সান্ত্বনা দিই। তারপর যথারীতি সব খবর আমরা বেমালুম ভুলে যাই। অথচ আমরা কিন্তু কেউ জানি না সেই আত্মহত্যার পেছনের গল্পটা কী ছিল? কি সেই নিদারুণ বেদনা, যা তাঁকে অক্টোপাসের মতো গ্রাস করেছিল। যে কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁকে মৃত্যুর কথাই ভাবতে হলো! অথচ আমরা তো জানি, প্রবাসী মানেই তাঁদের দুচোখে শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন। অথচ স্বপ্নের সেই রঙিন বেলুন কখন আর কীভাবে ধীরে ধীরে ধূসর হতে হতে মৃত্যুতে পরিণত হয়ে যায়, সে খবরই বা আমরা কজন রাখি?
সত্যি, সুন্দর এই ঝলমলে পৃথিবীটা কেন এত সহজেই কালো আঁধারে ঢেকে যায়? কি সেই দুঃখ, ব্যথা, যাকে ধারণ করা এত কঠিন হয়ে পড়ে? তখন মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশকে,
‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।
বধু শুয়ে ছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্‌ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!’