সুইজারল্যান্ড, জাতিসংঘ এবং নিরপেক্ষতা
সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইগনাজিও ক্যাসিস বলেছেন, সুইজারল্যান্ড ২০২৩-২০২৪ সালে নিরাপত্তা পরিষদের একটি স্থায়ী আসনের অধিকারী। যুক্তিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ–জাতীয় পদক্ষেপ জাতির নিরপেক্ষতা বা স্বাধীনতার ব্যাপারে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
সুইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘের সনদে স্বাক্ষরের ৭৫তম বার্ষিকীতে এ মন্তব্য করেন। ২৬ জুন, ১৯৪৫ সালে ৫১টি দেশ সান ফ্রান্সিসকোতে ঐতিহাসিক দলিলটিতে স্বাক্ষর করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বৈশ্বিক সংস্থাটির সূচনা উপলক্ষে, সেখানে সুইজারল্যান্ড তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল না। লিগ অব নেশনসের ব্যর্থতা তখনকার বিশ্ব রাজনীতিতে যে তিক্ততা এনেছিল, সুইজারল্যান্ড জাতিসংঘকে একধরনের ‘বিজয়ী’ ক্লাব হিসেবে দেখেছিল।
আজকাল নিরপেক্ষ হওয়া সহজ নয়। বিশ্ব রাজনীতিতে একতরফাবাদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা করা আরও কঠিন করে দেখছে সবাই। ক্রমবর্ধমান মেরুকৃত এই বিশ্বে সুইস রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে অন্য রাষ্ট্রগুলোকে অনেক সময় বিচলিত করে, যা দেশীয় রাজনীতির জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান উপাদান নিরপেক্ষতা, এটি কূটনীতিকদের তাদের লক্ষ্যগুলো অনুসরণ এবং কৌশল পরিচালনার দিকনির্দেশনা দেয়। নিরপেক্ষতা জাতীয় চেতনার ক্ষেত্রে জনসাধারণকে অবিশ্বাস্যভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং জাতিকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে রাখে।
আধুনিক সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে তার নিরপেক্ষতা ২০০ বছরের বেশি পুরোনো ইতিহাস। এর উৎস একটি কংগ্রেসে উত্থিত হয়, যখন ইউরোপের আঞ্চলিক সীমানা পুনর্গঠনের জন্য তখনকার শক্তিশালী দেশগুলো অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বৈঠকে হয়েছিল। ১৫১৫ সালে মেরিগানোর যুদ্ধে সুইজারল্যান্ডের পরাজয়, অসংখ্য প্রাণহানি আর সংঘর্ষের পর এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে সম্প্রসারণবাদী নীতিগুলো কেবল ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে, এর প্রতিক্রিয়ায় সুইজারল্যান্ড কার্যকরভাবে তখন থেকে একটি নিরপেক্ষ দেশে পরিণত হয়। এই ধারাবাহিকতায় সুইজারল্যান্ড স্পষ্টতই ১৬৭৪ সালের প্রথম দিকে নিজেকে নিরপেক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়।
সেই থেকে এখন পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড তার নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে উপকৃত হয়েছে। কারণ, ‘নিরপেক্ষতা’ দেশটিকে একটি স্বাধীন রাজনৈতিক অভিনেতার দৃশ্য মঞ্চায়নে সমগ্র বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। যা–ই হোক, এখন প্রশ্ন হলো সুইসরা আর কত দিন এই ধারা ধরে রাখতে পারবে? সুইজারল্যান্ডের কার সঙ্গে চুক্তি করা উচিত? ওয়াশিংটন না বেইজিং, ব্রাসেলস না মস্কো, নাকি তেহরান বা রিয়াদ।
শুধু যে এই সিদ্ধান্তগুলো প্রযুক্তি এবং বাণিজ্য চুক্তি বা আমদানির মতো বিষয়গুলোতে উত্থাপিত হয় তা–ই নয়, সর্বজনীন মান এবং আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্বের ক্ষেত্রে বাণিজ্য অংশীদারদের নির্বাচনের বেলায় প্রায়ই সুইজারল্যান্ডকে অগ্নিপরীক্ষায় পড়তে হয়।
উদাহরণস্বরূপ আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে দীর্ঘকালের বাণিজ্যবিরোধের মধ্যে বেইজিংয়ের সঙ্গে বিদ্যমান বাণিজ্য চুক্তি হালনাগাদ করা এবং সমান্তরালভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করা কতটা দুরূহ, তা সুইস প্রেসিডেন্ট উলি মোরার (Ueli Maurer) সাম্প্রতিক চীন সফর বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষতার জটিলতার একটি বাস্তব প্রমাণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তার সম্পর্ক পরিষ্কার করার জন্য সুইজারল্যান্ডের প্রচেষ্টা অন্য একটি উদাহরণ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইইউ নিষেধাজ্ঞাগুলো গ্রহণে সুইজারল্যান্ডের অনীহা সম্পর্কে ইইউ একেবারেই কম সহনশীল।
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যার ক্ষেত্রে দেশটি কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়েছিল। সুইজারল্যান্ড তার হত্যার তদন্তের দাবিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতি বাতিল করে এবং সৌদি আরবকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছিল। ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার পর প্রায় ছয় মাস পরে সৌদি আরবকে মানবাধিকার রেকর্ডের জন্য তীব্র তিরস্কার করার এক বিরল আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব সদস্যদেশ এবং অন্য বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতা জেনেভায় এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করার জন্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়েছিল যে তারা এই হত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের তদন্তে সহযোগিতা করবে। তবে সুইজারল্যান্ড এতে যোগ দিতে রাজি হয়নি।
ক্রমবর্ধমান এই মেরুকৃত বিশ্বে সুইজারল্যান্ড ঠিক কী চায়, দেখে মনে হবে সুইস রাজনৈতিক নেতারা দ্বিধাগ্রস্ত। নিরপেক্ষতার সংজ্ঞাটি সুইজারল্যান্ডের রাজনৈতিক মহলেও বিতর্কিত। তাদের বিদেশনীতির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে রাজনীতিবিদেরা এই শব্দের ব্যাখ্যা আলাদাভাবে করেন। বামপন্থী রাজনীতিবিদেরা নিরপেক্ষতার একটি সক্রিয় নীতি অনুসরণ করেন, যা সুইজারল্যান্ডকে বিশ্ব রাজনীতির ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিতে সহায়তা করে। বিপরীতে ডানপন্থী দলগুলো প্রায়ই নিরপেক্ষতার ইস্যুতে হস্তক্ষেপ না করার পক্ষে এবং সচরাচর একটি সংযমের নীতি অনুসরণ করে।
বিভিন্ন সময়ে করা জরিপগুলো ইঙ্গিত দেয় যে নিরপেক্ষতা সুইস নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ২০১৮ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে ৯৫ শতাংশ সুইস নাগরিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার পক্ষে এবং দুই দশক ধরে সুইস জনসাধারণ ক্রমবর্ধমান নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং তার কঠোর প্রয়োগের জন্য রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে, সুইস নিরপেক্ষতা এখনো কারও সঙ্গে আলোচনার ক্ষমতা হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে ফেডারেল কাউন্সিলর উলি মোরার (Ueli Maurer) বলেন, ‘এর অর্থ এই নয় যে আমরা সব সময় সব বিষয়ে একমত হই।’ সুইজারল্যান্ড এবং নিরপেক্ষতা সমার্থক, তবে এর অর্থ এই নয় যে সুইসদের কোনো সামরিক শক্তি নেই। সুইস আর্মি স্ব-প্রতিরক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। নীতিগতভাবে, সুইসরা আক্রমণের শিকার না হলে কোনো সামরিক জোটে প্রবেশ করতে পারে না এবং অবশ্যই আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের পক্ষ নেবে না। যদিও এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ। সুইস অস্ত্র রপ্তানি এ ক্ষেত্রে বেশ আলোচিত। উদাহরণস্বরূপ সুইজারল্যান্ড যেসব দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে অস্ত্র ব্যবহার করা হয় বা তার বড় ঝুঁকি রয়েছে, এমন দেশে অস্ত্র রপ্তানিকে নিষিদ্ধ করেছে। পারমাণবিক শক্তি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান সুইস অস্ত্র রপ্তানির শীর্ষ পাঁচটি গন্তব্যের মধ্যে দুটি দেশ। গড়ে সুইজারল্যান্ড ভারতে ৩৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ মূল্যবান অস্ত্র বেচে, যার বেশির ভাগই মিসাইল ফায়ার কন্ট্রোল এবং গাইডেন্স সিস্টেম। আর পাকিস্তানে ২৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ মূল্যের সুইস অস্ত্র।
সুইজারল্যান্ডের জন্য নিরপেক্ষতা সশস্ত্র নিরপেক্ষতা বোঝায়, যা ব্যাখ্যা করে যে কেন দেশ সর্বদা সম্মানজনক পর্যায়ে তার প্রতিরক্ষা বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়েছে এবং কেন সংবিধানের আওতায় পুরুষ নাগরিকদের জন্য সামরিক পরিষেবা বাধ্যতামূলক। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে নিরপেক্ষতা এখন আর ছোট দেশগুলোর পক্ষে আবশ্যক নয়। আধুনিক বিশ্বের আন্তনির্ভরতা একটি খাঁটি এবং গোঁড়া নিরপেক্ষতা ক্রমবর্ধমানতা বেশ হুমকির মুখে।
২০১১ সাল থেকে সুইজারল্যান্ড জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী আসনের জন্য কূটনৈতিকভাবে তার প্রার্থিতা প্রচার করেছে। এখন পর্যন্ত দেশীয় রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং জনমত গড়ে উঠেনি, তবে ফেডারেল কাউন্সিলের বিরোধিতা কারণে এটি পরিবর্তন হতে পারে। বার্ন ২০১১ সালে জাতিসংঘ সিকিউরিটি কাউন্সিলের একটি আসনের প্রার্থীদের তালিকায় ২০২৩-২৪ সালে সুইজারল্যান্ডকে নিবন্ধিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিমা ইউরোপ দুই বছরের জন্য যে দুটি স্থায়ী আসন অধিকারী, তার একটিতে এটি রাখতে চায়। ২০২২ সালে ইউএন জেনারেল অ্যাসেমব্লির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এখন পর্যন্ত মাল্টা একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী।
অন্যান্য নিরপেক্ষ, দেশ যেমন সুইডেন, অস্ট্রিয়া ইতিমধ্যে বেশ কয়কবার নিরাপত্তা পরিষদে দায়িত্ব পালন করেছে। সুইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে বিশ্ব রাজনীতির শীর্ষ টেবিলে একটি আসন রেখে সুইজারল্যান্ড সত্যিই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেকে খুঁজে পেতে পারে এবং ফেডারেল কাউন্সিল (নির্বাহী সংস্থা) তা শক্ত হাতেই পরিচালনা করতে সক্ষম হবে এবং প্রয়োজন হলে সুইজারল্যান্ড ভোটদান থেকেও বিরত থাকতে পারে।
ইতিমধ্যে রাইন নদীতে অনেক স্রোত বয়ে গেছে; ধীরে ধীরে অনেক পরিবর্তন এসেছে, অনেক প্রতিরোধের পরে অবশেষে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে ২২ মার্চ, ২০০২ সুইস জনগণ সংক্ষিপ্তভাবে জাতিসংঘে যোগ দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। জাতিসংঘের ১৯০তম সদস্য হওয়ার পর থেকে সদস্যপদ ও ইউএন–সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের প্রতি সুইস মনোভাব অনেকাংশে ইতিবাচক ছিল। নিরাপত্তা পরিষদের ভবিষ্যতের অস্থায়ী আসন সম্পর্কে এখনো দেশীয় রাজনৈতিক মহল সন্দিহান।
ছোট কিন্তু ধনী নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ড কি বিশ্ব রাজনীতির শীর্ষ টেবিলে স্থান অর্জন করবে? তবে বিশ্ব স্বার্থের প্রয়োজনে সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষতা সবার কাম্য।