সিলেট অঞ্চলের বিস্তৃত সংস্কৃতি

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কিছু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেলেও তা আজও মনে দোলা দিয়ে যায়। শীতকালে স্কুল ছুটি হলে যখন গ্রামের বাড়ি যেতাম, তখন মাঘ মাসের প্রচণ্ড শীতের রাতে কানে পৌঁছাত জারি গানের সুর, সঙ্গে বহু লোকের মিলিত শোর। মনে কৌতূহল জাগত। সমবয়সী কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলতে, গ্রামের ছেলেরা মিলে মাঘাই শিরনির জারি গাইছে। এ জারি গানেরও রয়েছে আলাদা ইতিহাস। অনেকের মতে, তখনকার দিনে লোকবসতি কম থাকায় এলাকা ছিল জঙ্গলাবৃত। জঙ্গলে বাস করত হিংস্র পশুর দল। তখন লোকেরা বাঘ তাড়াবার ছলে দল বেঁধে মাঘ মাসের শীতের রাতে জারিগান গেয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করে শিরনির আয়োজন করত।
এক রাতে আমাদের বাড়িতেও এমন লোকসমাগম হলো। পনেরো-বিশজন ছেলে-যুবা মিলে জারি গানের সুরে প্রথমে দলের নেতা গান শুরু করত। পরে বাকিরা একই লাইন সুর করে গেয়ে যেত। প্রথমে একটু বুঝতে কষ্ট হলেও পরে বুঝলাম, ওরা গাইছে—
‘আইলামরে আইলামরে,
আইলামরে তালুকদার বাড়ি
গইন্না মাছের পেরপেরি
শুনরে ভাই বরোয়া বাঁশ
এই বাড়ির আশপাশ
আশপাশের নীল ছুয়া
হাত বাড়াইয়া পাইলাম গুয়া (সুপারি)
মাথা ভরি মাখলাম তেল
ও বাঘা বন গেল
বন গিয়া ধরল গাই
গাই ডাখে মাই মাই
এখও বেটি এখ এখ জাত
পিঠা করে নানান জাত
খাইতে পুট্টুরি উঠে
নাখে তাউল্লায় জইল্লা উঠে
আগো, মাঘাই সিন্নি মাগো।।’
এসব জারিগান ছিল বর্ণনায় পরিপূর্ণ। কারও মতে ‘মাঘাই সিন্নি’ হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি করে তৈরি করা শিরনি। আবার কেউ কেউ বলেন, এটা হচ্ছে বাঘাই শিরনি। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে প্রাচীন আমল থেকে চলে আসা প্রথার অনুসরণে এ শিরনি করা হয়। এসব গান বৃহত্তর সিলেটের
বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত। মাঘাই শিরনির আরেকটা জারিগান—
‘মেঘ পড়ে ভাই পিনুর পিনুর
খই জাইতায় রে ভাই
সোনার ছাত্তি মাথায় দিয়া
বাঘ শিকারে যাই।
এক বাঘ মারিলাম ভাই
চিতলিয়ার পারে,
আর এক বাঘে খুঠি ধরল
জঙ্গলার কিনারে,
এই জঙ্গল কি হইল
কাইট্টারায় জ্বালাইল।
এই ছালি কি হইল
ধোপায় কাপড় ধইল।
আগো, মাঘাই শিরনি মাগো।।’
এই গান শেষ হওয়ার পর বাড়ির মালিককে কিছু দান করতে হতো। কেউ দিত চাল, কেউ টাকা-পয়সা। কেউ কিছু না দিলে ছন্দে-সুরে তাকে গালি খেতে হতো। সংগৃহীত এই চাল ও টাকা দিয়ে ওরা ক্ষীর (পায়েস) শিরনির আয়োজন করত। মাঝেমধ্যে আমিও তাদের দলে যোগ দিতাম। মাঘের শীতে চাদর মোড়া দিয়ে তাদের সঙ্গে বাড়ি বাড়ি হাঁটতাম, আর তাদের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে গান গাইতাম। এসব গানের কে ছিল রচয়িতা, আর তারাই বা কীভাবে এগুলো সংগ্রহ করল, তার কিছুই জানতাম না। আমার মনে হয়, যারা গাইত ওরাও কিছু জানত না। একে অন্যের মুখ থেকে শুনে শুনে বাংলার লোক সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। গ্রামবাংলার এসব লোকসংস্কৃতি আজকাল খুঁজে পাওয়া যায় না।
এমনই আরেক আরেক ঐতিহ্য ছিল নৌকাবাইচ। বৃহত্তর সিলেটের গ্রামে গ্রামে বর্ষাকালে নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতা হতো। লন্ডনপ্রবাসীরা সাধারণত এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। কেউ কেউ নিজেরা উৎসাহী হয়ে এ ধরনের নৌকা তৈরি করাতেন। ৫০-৫৫ হাত লম্বা এক-একটা নৌকা তৈরি করা হতো। তাতে থাকত বিভিন্ন রঙের কারুকাজ। আবার কোনো কোনো নৌকার আগা-গলুইয়ে বেশ বড় আকারের টিন দিয়ে তৈরি ময়ূর বসানো হতো। টিন কেটে কেটে এই ময়ূরের আকৃতি করা হতো। ময়ূরঅলা নৌকার নাম দেওয়া হতো ‘ময়ূরপঙ্কি নৌকা’।
এসব নৌকা চালাতে প্রায় ৪০-৪৫ জন লোকের প্রয়োজন হতো। এই লোকদের তিন ভাগে ভাগ করা হতো। যেমন, খারালী, পাইক, বাদ্যযন্ত্রী। পাইকের মধ্যখানে চার-পাঁচজন লোক ঢোল-করতাল ও কাসর বাজিয়ে সারি গান গাইত। সারিগানের ছন্দগুলো ছিল এমন—
১. ‘সোনার নায়ে রুপার বইঠা
কে বাইয়া যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে
ময়ূরপঙ্কি নায়।
আগার পাইকা পাছায় গেলে
নায়ে শূন্যে করে উড়া
পিছের বইঠায় মারে টান
নায়ের বাড়ে এক গুরা,
ও কি শাবাশ শাবাশ হেইয়া।’
২. ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল
তারে দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে
ময়ূরপঙ্কি নায়।’
মরমি কবি দেওয়ান হাসন রাজা এ ধরনের নৌকাবাইচের কিছু গান রচনা করে গেছেন। পরে প্রয়াত শাহ আব্দুল করিমের রচনায় কিছু নৌকাবাইচের গান গীত হয়েছে। এসব সারিগান গাওয়া হতো প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে। প্রতিযোগিতা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গানের সুর ও বাজনার তালে পরিবর্তন আসত। বাজনা দ্রুতগতির হতো, আর মুখে বলা হতো—
‘বাইওরে হেইয়া
আরও জুরে হেইয়া
জুরছে মার হেইয়া।’
এক সময় প্রতিযোগিতার সমাপ্তি টানা হতো, যখন নির্ধারিত স্থানে অর্থাৎ শেষ সীমানায় নৌকাগুলো পৌঁছে যেত। তখন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান নির্ধারণের পালা। বিজয়ী নির্ধারণের জন্য প্রতি নৌকায় একজন করে বিচারক থাকতেন, স্থানীয় ভাষায় তাঁদের বলা হতো ‘আমিন’। আমিন ফলাফল ঘোষণা করতেন। তারপর পুরস্কার বিতরণের পালা। এর পর শুরু হতো আরেক ধরনের সারিগান—
‘বিলপারের ময়না মিয়া
বড় ভাগ্যবান
সোনার বাটায় পান খাবাইয়া
পাঠা করলা দান।’
এসব নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার হিসেবে পাঠা দেওয়া হতো। এ দিয়েই চলত উৎসব, খাওয়া-দাওয়া।
এমন অনেক পালাপার্বণ, আচার-অনুষ্ঠানে মুখরিত থাকত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সংস্কৃতি। অগ্রহায়ণে নবান্নের পরপরই শুরু হতো গাজির গান। যিনি গাজির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, তাঁর পোশাক হতো অন্য ধরনের। ধুতির সঙ্গে শেরওয়ানি ও বিশেষ ধরনের পাগড়ি পরতেন তিনি। হাতে থাকত একটা আশা (ত্রিশূল), আর সঙ্গে দুজন লোক। গাজি প্রথমে আশাটি মাটির মধ্যে পুঁতে চাঁদতারা খচিত ত্রিপল টানিয়ে মঞ্চ তৈরি করতেন। তারপর বন্দনা গেয়ে আসরের কাজ শুরু করতেন। বন্দনা গীতিটি ছিল—
‘পুবেতে বন্দনা করি পুবে ভানুশ্বর
একদিকে উদয় হয়ে চারদিকে পসর
পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা ভালো স্থান
যেখানেতে পয়দা হলো কিতাব আর কুরান
উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বত
যেখানেতে জন্ম নিছে মালামের পাথর
দক্ষিণে বন্দনা করি কালিদহ সাগর
যেখানে বাণিজ্য করে চাঁদ সদাগর।’
বন্দনা শেষে গাজি তার দুই সঙ্গী নিয়ে শুরু করতেন ধান-চাল সংগ্রহের কাজ। আজকাল যুগের বিবর্তনে এই সব সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে, হারিয়ে ফেলেছে তার রূপলাবণ্য। বৃহত্তর সিলেটের সংস্কৃতি এখন রূপ নিয়েছে ভিন্ন ধারায় ভিন্ন আঙ্গিকে।