সিডনিতে আমার শুরুর দিনগুলো ছিল কষ্টের। তবে বাংলাদেশ, মা আর জন্মস্থান কুলিয়ারচর ছেড়ে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের এই দেশটিকে নিখুঁত হাতে আঁকা একটা চিত্রশিল্প মনে হতো। আবেগ-অনুভূতি-দর্শন সবই নতুন লাগত। সবকিছু দেখেই আমি ভীষণ অবাক। এমনকি রাস্তার ওপর দিয়ে চলা লাইটরেল কিংবা ট্রাম আর টিকিট কেনার ওপাল কার্ডও আমাকে অবাক করে দিত। আর চাকচিক্যময় ইমারত দেখে মাঝেমধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেতাম। সিডনি টাওয়ার আই, কুইন ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং, পাওয়ার হাউস জাদুঘর, সেন্ট ম্যারিজ ক্যাথেড্রাল, হাইড পার্ক আরও কত কী।
সিডনি শহরের পাশেই ঘিরে রয়েছে বিখ্যাত বন্ডি, কুজি ও মারুব্রার মতো বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত। নীলাভ জলরাশিতে উত্তাল সমুদ্রে যতবারই ঘুরতে যাই, নিজেকে হারিয়ে ফেলি জলের অপরূপ মায়ায়। আকাশ ও সমুদ্রের মাখামাখি সাদা ফেনাওঠা জলের ঝাপটায় আর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের দোলায় গা ভেজায়; প্রশান্তির এই মুগ্ধতা আমাকে আপ্লুত করে। একটু সময় পেলেই ছুটে যাই প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা সেন্টিনিয়াল পার্কে। সেখানকার সবুজ ঘাসের স্পর্শে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।
সিডনি বলতেই যেন দুটি স্থাপত্যের ছবি ভাসে—বিখ্যাত অপেরা হাউস আর হারবার ব্রিজ যেখানে আমার নিত্য আসা-যাওয়া। চোখের সামনে প্রতিদিন এই নাট্যমঞ্চ আর শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহাসিক সেতুটি দেখতে দেখতে অতি আপন মনে হয়। এখনো মাঝেমধ্যে বিকেল-সন্ধ্যা তাকিয়ে থাকি হারবার ব্রিজ আর অপেরা হাউসের ফাঁক গলে আসা গোধূলির দিকে। আমার কর্মস্থল সিডনি শহরের হৃদয় ডার্লিং হারবারে। মিষ্টি সূর্য ও বিশাল আকাশ, এলোমেলো বাতাস আর সিগাল পাখির ডাকে হারবারের দিন শুরু হয়। বিদেশি পর্যটকেরা এখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে ক্যামেরায় বন্দী করতে না পারলে যেন সিডনিতে আসাটাই বৃথা মনে করেন। সেই ডার্লিং হারবার ঘিরে রয়েছে বিখ্যাত মোমের জাদুঘর মাদাম তুসো, সিডনি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার, সিডনি অ্যাকুয়ারিয়াম, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম, চাইনিজ গার্ডেন এবং বাহারি স্বাদের শত রেস্তোরাঁর সমারোহ।
তবে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সিডনিতে তাল মিলিয়ে চলাটাই আমার কাছে অনেক বড় কিছু। চলতে চলতে সবকিছু যখন প্রায় নিজের মতো করে গুছিয়ে এনেছি, ঠিক তখনই এল বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। অস্ট্রেলিয়ায় মার্চের শুরুর দিক দিয়েই আটকে গেল সব। অচলাবস্থা জারি করা হলো দেশটির সর্বত্র। এই মহামারির কালে যখন ঘরবন্দী নির্জন চারিদিক, তখন আমার কাছে আসে পুরোনো বন্ধু, গল্প, চলচ্চিত্র। সঙ্গী হয়ে সারাক্ষণ ঘোরে গল্প, ছায়াছবি।
নিজেকে একটা দিক থেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, কারণ ভিনদেশে এমন একটা কঠিন সময়ে নিজের আপন বোনের সঙ্গে থাকতে পেরেছি। এর মধ্যে টয়লেট পেপার নিয়ে অস্ট্রেলিয়াবাসীর মধ্যে হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু দুদিন যেতেই বুঝলাম এ দুর্লভ বস্তু এখন শত ডলারেও কিনতে পারা মুশকিল। বাঙালি হওয়ার কারণে নিজেকে সামলে নেওয়া খুব বেশি কষ্টের হয়নি, কারণ আমরা টয়লেট পেপার নয়, পানিই ব্যবহার করি বেশি। কিছুদিন পর শুধু টয়লেট পেপার নয়, অন্যান্য দেশের মতো এখানেও মাস্ক আর স্যানিটাইজারেরও ঘাটতি দেখা দিল। যদিও সরকারের দ্রুত পদক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে।
এর মধ্যে দিন-সপ্তাহ-মাস যায় শঙ্কায়। নিজের ঘরবন্দী সময়টাকে কিছুটা কাজে লাগাতে চাইছিলাম। বাংলাদেশে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম, তখন সময় পেলে মিডিয়ার সঙ্গে থাকতে পছন্দ করতাম। বেশি কিছু মডেলিং ও নাটকের অল্পস্বল্প চরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতাও আছে আমার। সেই থেকেই অচলাবস্থায় সিডনিতে ঘরে বসে অনেকের প্রাত্যহিক দিন কেমন ছিল, সেটা নিয়ে আনাড়ি হাতে একটা ছোটগল্প লিখলাম। আর চিকিৎসক বোনের অনভিজ্ঞ হাতে তুলে দিলাম ক্যামেরা। তারপর নিজেই দাঁড়াই ক্যামেরার সামনে। কয়েক দিনের তোড়জোড় শেষে তৈরি হলো স্বল্পদৈর্ঘ্য এক চলচ্চিত্র ‘অপ্রত্যাশিত’। জুন মাস নাগাদ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে কমে আসে। ভিক্টোরিয়ার মেলবোর্ন ছাড়া অচলাবস্থা অল্প অল্প করে কাটতে থাকে। আবার খোলা আকাশের নিচে যাওয়ার সুযোগ হয় সবার। আমরা আবার আশায় বুক বাঁধি করোনামুক্ত সময়ে।