সিগন্যাল বাতি
জুলাই-আগস্টে ফিলিপাইনে ঝকঝকে সকালের দেখা প্রতিদিন মেলে না। যখন-তখন মেঘ বৃষ্টি। কিন্তু আজকের সকালটা একটু বেশিই রৌদ্রোজ্জ্বল। বাসা থেকে বের হয়েই মন ভালো হয়ে গেল। কী চমৎকার নিল আকাশ! মাঝে মাঝে তুলির আঁচড়ের মতো সাদা মেঘের ছাপ। যদিও তাপমাত্রা একটু বেশি। কিন্তু কোনো গুমোট ভাব নেই।
বাসা থেকে অফিস ২০ মিনিটের পথ। গাড়ির কাচ নামিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। সামনে চৌরাস্তার মোড়ে গাড়ি থামল। রাস্তার কোণে জ্বলজ্বলে এক লাল বাতি। আমাদের সামনে, পেছনে ও ডান-বামে আর কোনো গাড়ি নেই। নেই কোনো ট্রাফিক পুলিশ। তবুও চালক সবুজ বাতির অপেক্ষায় গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করছেন। গাড়ির সামনে জেব্রা ক্রসিং। কয়েকটি ছেলেমেয়ে এসে সেখানে দাঁড়াল। তাঁরা বাম দিকে যাবে। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় এই ট্রাফিক সিগন্যালে পথচারীর সিগন্যাল বামদিকে লাল হয়ে থাকায় তারাও দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
এদের এই ধৈর্য আর শৃঙ্খলা দেখে আমার ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠল। এই ছেলেমেয়েদের জায়গায় নিজেকে ভাবালাম। আমিও হয়তো এমন ফাঁকা রাস্তায় শুধু ট্রাফিক লাইট দেখে অপেক্ষা করতাম না। শুধু আমি নয়, আমাদের দেশের খুব কম মানুষই মনে হয় সিগন্যাল বাতির দিকে তাকান। আমরা সময়ের মূল্য দিতে জানি। সিগন্যাল বাতি দেখার সময় আমাদের নেই। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গাড়িতে ধাক্কা লাগতে পারে বা দিতে হতে পারে। তাই আমাদের গাড়ির সামনে পেছনে বেশ শক্ত মোটা ধাতব বাম্পার লাগাতে হয়। এরপর যত পার হর্ন বাজাও আর মেতে ওঠ সামনে যাওয়ার দৌড়ে। নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যাওয়াই আমাদের প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য।
আমার এক ফিলিপিনো বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। সে গিয়েছিল বাংলাদেশে এক সপ্তাহের জন্য। ফিরে এল এক মুখ হাসি নিয়ে। জানতে চাইলাম, কেমন দেখলে বাংলাদেশ? সে তাঁর হাসিটাকে আর একটু আলোকিত করে বলল, খুব ভালো। তোমাদের দেশের মানুষ বেশ বন্ধুত্বপরায়ণ। আমি হে হে করে হাসলাম। সে তো অবশ্যই। আমরা খুব অতিথিপরায়ণ। খাবার সময় কোনো অতিথি আমাদের ঘরে এসে না খেয়ে গেলে আমাদের অমঙ্গল হয়। তা তুমি কীসে বুঝলে আমরা বন্ধুত্বপরায়ণ? সে তাঁর হাসিটাকে আরও একটু প্রসারিত করল, তোমাদের গাড়ির চালকদের দেখে। আমি একটু অবাক, সেটা কি ভাবে? বন্ধু ব্যাখ্যা করতে শুরু করল। দেখ তোমাদের গাড়িচালকেরা অন্য গাড়ির পেছন থেকে জোরে হর্ন দেয়। কেউ কেউ গাড়িতে ধাক্কাও দেয়। তখন সামনের গাড়ি থেকে মুখ বের করে চালক কিছু বলে। মনে হয়, হাই-হ্যালো বলছে। হয়তো অনেক দিন দেখা হয়নি, তাই রাস্তায় হাই হ্যালো সেরে নিচ্ছে। অথচ দেখ আমাদের এখানে একটু ধাক্কা লাগলে রক্ষা নেই। জরিমানা গুনতে হবে।
আমার মুখ শুকিয়ে গেলেও হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। মনে মনে ভাবলাম, তুমি যদি সেই চালকদের হাই-হ্যালোর ভাষা বুঝতে তাহলে তুমি বুঝতে বন্ধুত্ব কাকে বলে।
এর মধ্যে অফিসে চলে এসেছি। দুই মিনিট ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থেকে আমার খুব বেশি সময়ের ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। আমরা যদি আমাদের দেশে শুধু একটু ধৈর্য ধরে ট্রাফিক আইনগুলো মেনে চলি তাহলে ট্রাফিক জ্যামের পুরো চিত্রটা বদলে যেতে বাধ্য।