সিএসআর হতে পারে পোশাকশিল্পের নতুন ব্র্যান্ডিং কৌশল
বর্তমানে করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর) বা করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা একটি অতিপরিচিত শব্দ। সহজ ভাষায়, সমাজ এবং পরিবেশের প্রতি প্রতিষ্ঠানের নৈতিক দায়বদ্ধতাকেই মূলত সিএসআর বা করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা বলা হয়।
একটি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে সমাজ এবং মানুষকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে থাকে। কখনো কখনো তা সমাজ এবং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যেমন, কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলে পানি দূষণ করা কিংবা এমন কোনো পণ্য উৎপাদন করা, যার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।
সিএসআর হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থাপনা ধারণা, যার মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান সমাজ এবং পরিবেশকে প্রভাবিত করায় নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ থাকে এবং সেই নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজ এবং পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে প্রতিষ্ঠান–সংশ্লিষ্ট সবার স্বার্থে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। এতে দুই পক্ষই উপকৃত হয়। বিশ্বের বড় বড় প্রায় সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই এখন সিএসআর ধারণা চর্চা করছে এবং এর সুফলও পাচ্ছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে সিএসআর ধারণাচর্চা করছে। তবে বর্তমানে করোনা মহামারিতে সিএসআর ধারণার চর্চা আরও বাড়ানো উচিত।
সিএসআর বা করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা মূলত চার প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন, ফিলানথ্রোপিক বা পরোপকারী দায়বদ্ধতা, অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা, পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মানবাধিকার ও কর্মীদের প্রতি দায়বদ্ধতা। আমার আজকের আলোচনা মূলত মানবাধিকার ও কর্মীদের প্রতি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা নিয়ে। বাকি বিষয়গুলো নিয়ে হয়তো অন্য কোনো সময় আলোচনা করা যাবে।
প্রতিটা সামাজিক কাজের শুরুটা হওয়া উচিত নিজ ঘর থেকে। তাই মূলধন ব্যবসায়ের মূল চালিকাশক্তি হলেও কর্মীরা হলেন প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের চাবিকাঠি। এ ছাড়া সিএসআর ধারণা অনুসারে প্রতিটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের তার নিজ কর্মীদের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই সব প্রতিষ্ঠানেরই উচিত কর্মীদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং কর্মীদের সুবিধা–অসুবিধার কথা মাথায় রেখে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা করা। প্রয়োজনে কর্মীদের দুঃসময়ে পাশে থেকে সাহায্য করা। বর্তমানে করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের উচিত আগে তাদের কর্মীদের বাঁচিয়ে রাখা। এই দুঃসময়ে কোনো কর্মী যেন কর্মহীন হয়ে না পড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখা। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সিএসআর নিয়ে কাজ করার এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এতে কেবল শ্রমিকেরাই লাভবান হবেন তেমনটা নয়, সংশ্লিষ্ট শিল্পও লাভবান হবে।
করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের পোশাক ও রপ্তানিশিল্প। ইতিমধ্যে অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা। আমাদের নিয়মিত ক্রেতারা ভিয়েতনাম কিংবা চীনের দিকে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ক্রেতাদের নতুনভাবে আমাদের দিকে আকৃষ্ট করতে সিএসআর হতে পারে এক অনন্য পদক্ষেপ। এতে যেমন শ্রমিকেরা বাঁচবেন, তেমনি পোশাকশিল্পও ফিরে পাবে হারানো বাজার।
সাধারণত পশ্চিমা বিশ্বে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতারা সামাজিক দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। কারণ, ক্রেতারা মনে করেন তারা ওই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পণ্য কেনার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারছেন। তাই পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে, যাঁরা সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। পোশাকশিল্পের ওপর রানা প্লাজা দুর্ঘটনার প্রভাব বিশ্লেষণ করলেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়। যেহেতু পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় বাজার, তাই পশ্চিমা বিশ্বে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করারও একটি ভালো উপায় হতে পারে করোনাকালীন সিএসআর। অর্থাৎ করোনাভাইরাসের কারণে পোশাকশিল্প যে ক্ষতির মুখে পড়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে শ্রমিক ছাঁটাই না করে বরং শ্রমিকদের কাজে বহাল রেখে বিশ্বে নতুনভাবে আমাদের পোশাকশিল্পের ব্র্যান্ডিং করা যেতে পারে। ক্রেতাদের দেখানো যেতে পারে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা। দেখানো যেতে পারে আমরা মুনাফালোভী স্বার্থপর নই। আমরা একটি টেকসই সমাজ বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর এবং আমাদের আন্তর্জাতিক ক্রেতারা চাইলে সহজেই আমাদের পণ্য কিনে একটি ভালো কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে।
পরিশেষে বলব সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উচিত নিজ কর্মীদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের ছাঁটাই না করে তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। এতে সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু আর্থিক ক্ষতি হলেও ভবিষ্যতে অনেক বেশি সফলতা পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। অন্যথায় শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হলে সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হলেও ভবিষ্যতে শ্রমিক আন্দোলন কিংবা যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা শুরু হলে পোশাকশিল্পের বাজার পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তাই করোনা মহামারিতে কেবল সাময়িক ক্ষতির দিকে না তাকিয়ে সম্ভাবনাগুলো খুঁজে বের করে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে আমাদের পোশাকশিল্পের সুদিন আবার ফিরে আসবে।