সাহসী মেয়ের গল্প
আমি তখন সবে মাত্র একটা নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি। শুরুতেই কাজের জন্য কম্পিউটারে কিছু গৎবাঁধা সেটআপ করতে হয়, সেগুলো জানার জন্য টিমের পুরোনো একজনের কিউবে গেছি। তার সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল না, সেদিনই প্রথম দেখা। কিউবে ঢুকতেই পেছন থেকে প্রথমে যেটা চোখে পড়ল, ছেলেটা গড়পড়তা ভারতীয় ছেলেদের তুলনায় বেশ লম্বা, যদিও বসে আছে, কিন্তু অনায়াসেই ছয় ফিটের কাছাকাছি হবে। আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ঘুরতেই দেখতে পেলাম এক হ্যান্ডসাম যুবক, গভীর চোখ। কথা বলে আরও বুঝতে পারলাম, তার চেয়েও গভীর তার কাজ সম্পর্কে জ্ঞান। অত্যন্ত ভদ্র। কিন্তু কি যেন একটা খটকা লাগছিল, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ছেলেটা এক হাতে টাইপ করছে। অন্য হাতটা কেন যেন ব্যবহার করছে না। সেদিন খটকাটা নিয়েই ফেরত এলাম, কিন্তু প্রথম দিন থেকেই ওর সঙ্গে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার। হবে নাই বা কেন, এত ফ্রেন্ডলি আর হেল্প ফুল হলে? ধরে নেই ওর নাম দেব।
কয়েক দিনের মধ্যেই আবার ওর সঙ্গে কোথায় যেন দেখা হয়ে গেল, করিডরে বা ক্যাফেতে। ওর সেই হাতটা পকেটে ঢোকানো। হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য হাতটা বের করতেই আমি চমকে উঠলাম, কনুইয়ের পর থেকে সরু হয়ে একটু পরেই শেষ, কোনো পাঞ্জা নাই। সঙ্গে সঙ্গে দেবের হাত আবার পকেটে।
এই একটি হাত নিয়ে দেব দিব্যি কাজ করছে, গাড়ি চালাচ্ছে, সবই করছে। এমনকি ক্রিকেটও খেলছে। বেশ অনেক বছর আমরা এক সঙ্গে কাজ করেছি। ইতিমধ্যে ওর বয়সী অন্য বন্ধুরা সব বিয়ে টিয়ে করে বাচ্চার বাবাও হয়ে গেছে। কিন্তু বেচারা দেব একা একাই দিন কাটাচ্ছে। কেউ বিয়ে করতে যাচ্ছে শুনলেই, টিমের অনেকেই দুষ্টামি শুরু করে, তুমি কবে যাচ্ছ? ও মুখ শুকনা করে উত্তর এড়িয়ে যায়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে ভারতে এখনো সেটল ম্যারেজই বেশি, জাত পাতের পরীক্ষায় পাস করাটাই যেখানে কঠিন, সেখানে দেবের পঙ্গুত্ব পাস করা আরও অনেক বেশি কঠিন। ওর জন্য খুব মায়া লাগত, খালি মনে মনে দোয়া করতাম কেউ যেন ওর সুন্দর মনটাকে দেখতে পায়। একমাত্র ভালোবাসারই ক্ষমতা আছে এই সব অসম্পূর্ণতাকে উপেক্ষা করার।
আরও কিছু সময় গেল, তারপর সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল ঠিকই। আমাদের টিমেই নতুন একটা মেয়ে জয়েন করল, শ্বেতা। সেও দেবের মতো বিনয়ী, আবার বেশ হাসিখুশি, আধুনিক মেয়ে। একদিন দেখা গেল, দেব হাসিমুখে শ্বেতাকে নিয়ে ক্যাফেতে যাচ্ছে। ওকে বেশ আত্মবিশ্বাসী আর সুখী দেখাল। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই জানাল ওরা বিয়ে করতে ভারতে যাচ্ছে।
তারপর ওরা বিয়ে করে ফিরেছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম দেবের সেই হাতটা আর পকেটে নেই, ওর চোখদুটোতে খুশির ছটা আর আত্মবিশ্বাসের আলো। ও নির্দ্বিধায় রুম ভর্তি মানুষের সামনে মিটিংয়ে সেই হাতটা বের করে কিছুটা হলেও টাইপের সাপোর্ট নিচ্ছে।
শ্বেতার ভালোবাসা দেবের জীবনটাকে বদলে দিয়েছে। আমি জানি দেব এখন অনেক দূর যেতে পারবে। যেটা ও একা একা হয়তো পারত না। শ্বেতা একজন সাহসী মেয়ে। জীবনসঙ্গী হিসেবে একটুখানি অসম্পূর্ণ একজন মানুষকে খুশি মনে ভালোবেসে সবাই গ্রহণ করতে পারে না। পরিবার, সমাজের সামনে দাঁড়ানোর সাহস করতে পারে না। শুধুমাত্র সাহসী মানুষেরাই পারে, যারা মানুষের ভেতরের মানুষটা দেখতে পায়। এ রকম একেকজন সাহসী মানুষের জন্য এই পৃথিবীতে অন্য একজন মানুষের জীবন সুন্দর হয়, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। আসুন আমরা নিজেরা সাহসী হতে না পারলেও অন্তত এই সব সাহসী মানুষদের অভিনন্দন জানাই।