সাসকাতুনে ঢাবির এক শ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান
‘পুরনো সেই দিনের কথা, ভুলবি কিরে হায়, ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভুলা যায়’। কবি গুরুর গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমাদের সত্যি সত্যি ফিরে যেতে মন চায় আমাদের ফেলে আসা তরুণ বেলায়, আমাদের গর্বের সময়টায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সব সময়ই ভীষণ একটা প্রাণের টান অনুভব করি। সেই প্রাণের টানেই ২৫ জুলাই সাসকাতুন শহরে অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান।
কানাডার সাসকাচেওয়ান প্রদেশের একটি ছোট্ট শহর সাসকাতুন। সাসকাতুনকে শীতের শহরও বলা যায়। শীতকালে এখানে বরফে ঠেকে থাকে শহরের অলিগলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী এই শহরে থাকেন। এখন গ্রীষ্মকাল, এ শীতের শহর এখন সবুজে ছেয়ে আছে। টলে টলে লেকের পানিতে রোদেলা আলোর ঝিকিমিকি। ২৫ জুলাই এ শহরে হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। একটি আলো ঝরা দিনে, পাইক লেকের সবুজ আঙিনায় ১০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৮৬ জন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের পরিবার।
সাসকাতুনের প্রাক্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন তরুণ অনেক দিন থেকেই ভাবছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এমন একটি প্রাণের সংগঠন করা যায় কি না, যা একটি ছোট্ট পরিবারের মতো হয়ে উঠবে। যেখানে সবাই কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও প্রাণ খুলে কথা বলতে পারবেন। মন ভরে হাসতে পারবেন। একজন আরেকজনের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবেন। কিংবা কখনো মানসিকভাবে শক্তি জোগাবেন। কিছু তরুণের অদম্য ইচ্ছা আর আন্তরিকতায় সেটি সম্ভব হলো। পুরোনো আর নতুনের মেলবন্ধনে যাত্রা শুরু হলো এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইয়ের পরিবারের।
সে কারণেই ভাবা হলো, তথাকথিত সংগঠনের মতো নেতানেত্রী দিয়ে এটি চলবে না। এটি চালাবেন সব অ্যালামনাই সদস্যরা, সবাই। ঠিক করা হলো, ছোট ছোট কমিটি করে দেওয়া হবে। তাঁরাই আয়োজন করবেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এর জন্য পাঁচজন ফোকাল পয়েন্ট (মুখপাত্র) বাছাই করা হলো। তাঁরা হলেন সাঈব শাহরিয়ার, দেবাশীষ ভৌমিক, তাহমীনা শাহিন, নাজিয়া আরিফা ও জাকির সরকার, যাঁরা অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন।
মাঝে মাঝে পুনর্মিলনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বনভোজন, চায়ের আড্ডা নিয়ে সারা বছরই এটিকে সক্রিয় রাখা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সব প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীর সেই চমৎকার ফেলে আসা দিনগুলোতে আবার ফিরে যেতে মন চায়। আবার সেই তরুণ ছাত্রটি হতে ইচ্ছা করে। আর সেটা যদি হয় দূর পরবাসে, কানাডার ছোট্ট শহর সাসকাতুনে?
খোলা হলো ফেসবুক পেজ। যেখানে নতুনদের চাকরি, বাসস্থান, পড়াশোনা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হবে। একজনের সঙ্গে অন্যজনের যোগাযোগ রাখা হবে।
এক শ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আমরা ফিরে গিয়েছিলাম, ঠিক সে রকমই দিনগুলোর মতোই আরেকটি প্রাণোচ্ছল দিনে। ফিরে গিয়েছিলাম টিএসসির বারান্দায় কিংবা সবুজ ঘাসে। মনে মনে কল্পনা করেছি আমরা আছি ডাসের অপারেজয় বাংলার সামনে কিংবা টিএসসির অডিটরিয়ামে। প্রাণের টানে পাইক লেকের সবুজ চত্বরে উপস্থিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। কয়েক ঘণ্টার জন্য আবার আমাদের জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণালি সময়ে ফিরে গিয়েছিলাম। নতুন করে আবার প্রাণের মেলায় প্রাণ জুড়িয়ে এক সাথে গলা মিলিয়েছি, গান গেয়েছি, কবিতা পড়েছি আর প্রাণভরে গল্প করেছি।
সেদিন সবাই এসেছিলেন, চমৎকারভাবে সেজেগুজে। সবার পরনে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম লাগানো গেঞ্জি। সবার মুখেই চমৎকার হাসি। ভীষণ সুখী সুখী চেহারা। ছোট্ট মিলনায়তন সত্যিই যেন এক টুকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠল। সত্যি বলতে কি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়টাই তো ছিল আমাদের জীবনের অন্যতম সুন্দর সময়। সে রকমই একটি সুন্দর সময়কেই ফিরিয়ে আনার অব্যর্থ চেষ্টা ছিল সবার মধ্যে।
প্রথমেই চা-শিঙাড়া দিয়ে আপ্যায়িত হলেন অতিথিরা। তারপরই শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথমেই আমাদের নতুন প্রজন্ম কানাডায় বড় হওয়া বাচ্চাদের অনুষ্ঠান। এরপর প্রাক্তন ঢাবিয়ানদের নিয়ে প্রাণবন্ত আয়োজন। নতুন করে আবার প্রাণের মেলায় প্রাণ জুড়িয়ে একসঙ্গে গলা মেলাল, গান গাইল, কবিতা পড়ল আর প্রাণভরে গল্প করল।
তার পরই শুরু হলো একসঙ্গে সবার গানের সঙ্গে নাচ, ফটো সেশন ও খেলাধুলা। সেই রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের মাঠে বসে বাদাম খেতে খেতে গল্প আর গল্প, টিএসসির বারান্দাতে বসে কবিতা আবৃত্তি, ডাসের মঞ্চে গান গাওয়া কিংবা রোকেয়া হলে বা শামসুন নাহার হলের সামনের রাস্তায় অলস হাঁটাহাঁটি। কতই না স্মৃতি আর ভালো লাগা আর গর্ব জড়িয়ে আছে সেই সময়কে ঘিরে।
অনুষ্ঠানটির সাংস্কৃতিক সমন্বয়কারী ছিলাম আমি ভিকারুন নিসা, সঙ্গে ছিলেন রহমত মুন্সি, শাহরীমা তাহসীন। অনুষ্ঠানের সাউন্ড সিস্টেম এবং কম্পিউটারের সমন্বয় করেছেন সাঈব শাহরিয়ার। খাদ্যের দায়িত্বে ছিলেন মাসুদ আল মামুন দেবাশীষ ভৌমিক গৌতম, খেলাধুলায় ছিলেন নুরুল হুদা পলাশ এবং নাজিয়া আরিফা। আরও অনেক ছোট ছোট কমিটি অনুষ্ঠানটি সার্বিকভাবেই সার্থক করে তুলেছিল। আসলে সবাই কিছু না কিছুতে অংশ নিতে চেয়েছে। সবার নাম আর না-ই লিখলাম। অনুষ্ঠানের শিল্পীরা আসলে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন বারবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনায়, সংস্কৃতিতে, নেতৃত্বে মেধাবীদেরই সূতিকাগার।
অন্যদিকে খাদ্য কমিটি তৈরি করেছিল খাসির বিরিয়ানি, কোক, আর সালাদ। বড়দের চাঁদা ছিল সতেরো ডলার, ছোটদের পাঁচ ডলার, আর পাঁচ বছরের নিচে ফ্রি। দেবাশীষ ভৌমিক গৌতম, মাসুদ আল মামুন, সাইব শাহরিয়ারকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয় এমন মজাদার খাবার পরিবেশনের জন্য।
ঝকঝকে রোদ্দুরে খোলা আকাশের নিচে এক শ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানটি ভীষণ উষ্ণতা ছড়িয়ে যেন ফুরিয়ে গেল ভীষণ দ্রুত। সবার মুখেই তৃপ্তির হাসি। খাবারদাবার, গল্প, হাসি আনন্দ, গান-বাজনা কোনো কিছুরই তো কোনো কমতি ছিল না অনুষ্ঠানে। সবচেয়ে বড় কথা, সবাই ছিল ভীষণ রকম আন্তরিক, প্রাণোচ্ছ্বল আর আবেগে আপ্লুত।
আবারও নতুন আরেকটি পুনর্মিলনীর স্বপ্ন নিয়ে আর একমুঠো সুখস্মৃতি নিয়ে সবাই ফিরে গেল ঘরে। এভাবেই শেষ হলো প্রাক্তন ঢাবিয়ানদের পুনর্মিলনীর চমৎকার ‘এক শ বছর পূর্তি’ অনুষ্ঠানটি।