সারথি দাদু

বাংলাদেশের সিনেমার স্মৃতি জাগানিয়া গান বইয়ে আবদুল গফুর সারথি সম্পর্কে লেখা
বাংলাদেশের সিনেমার স্মৃতি জাগানিয়া গান বইয়ে আবদুল গফুর সারথি সম্পর্কে লেখা

আজ এক হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের কথা বলব। যে নক্ষত্র তার উজ্জ্বল আলোরদ্যুতি দিয়ে আলোকময় করছে অসংখ্য আঁধারে ডুবে যাওয়া পথ। সে পথ কখনো বন্ধুর ছিল না। ছিল ভালোবাসায় সিক্ত এক সফেদ বিছানা। নিভৃতচারী সে নক্ষত্র কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে কিন্তু রেখে গেছে তার অনন্যসাধারণ কীর্তি।আবদুল গফুর সারথি। যে মানুষটির জন্য আজ দুকলম লেখার সাহস পাই। ছড়া আর কবিতায় খুঁজে পাই ছন্দ। তিনি আমার দাদু। আমাদের পথের সারথি।
দাদু ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচিত্র মুখ ও মুখোশের গীতিকার। এ ছাড়া গাজীকালু চম্পাবতী ও গাঁয়ের বধূ সিনেমায়ও গান লিখেছিলেন তিনি। দাদুর অসংখ্য গানের সংকলনে ভিন গেরামের নাইয়া নামের একটি গানের বই প্রকাশ করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে এই মানুষটি ছিলেন একজন উদার মনের প্রকৃতিপ্রেমী। ইট-পাথরে ঘেরা শহরে তিনি তাঁর বাড়িটি সাজিয়েছিলেন সবুজ বৃক্ষের সারি দিয়ে। উঠোনজুড়ে নানা রকমের গাছ যেন বৃক্ষপ্রেমী মানুষটিরই বন্দনা করত। সৃজনশীল এই মানুষটির পশু-পাখির প্রতিও ছিল গভীর ভালোবাসা। পুরো বাড়ি জুড়ে বিড়াল আর কবুতর ছিল তাঁর অবসরের সঙ্গী। সবার কাছে দাদু বলে পরিচিত আবদুল গফুর সারথিকে কেউ কেউ বিড়ালের বাবা বলেও ডাকতেন। মজার বিষয় ছিল, বিড়াল আর কবুতরের বাহারি নাম শুনে অনেকেই মুগ্ধ হতেন। দাদুকে দেখতাম তাঁর নিজের টেবিলের ওপর মাছের কাঁটা বেছে ভাতের সঙ্গে মেখে বিড়ালকে খেতে দিতে। কয়জন মানুষ এমন করতে পারে? হয়তো সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন বলেই মনটা ছিল সমুদ্রের মতো বিশাল। ঘুমন্ত দাদার বিছানা জুড়ে যখন বিড়াল আর কবুতর এসে বসে থাকত, তখন বুঝতাম পশু-পাখিও ভালোবাসার অর্থ বোঝে।
নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দাদার সম্পর্ক ছিল খুনসুটির। বুড়ো দাদুকে খেপিয়ে যে আমরা কত মজা পেতাম! আমাদের পরিবারের সব নাতি-নাতনিদের নাম দাদু রেখেছিলেন। শুধু নাম রেখেই ক্ষান্ত হননি, যেহেতু লেখক তাই প্রত্যকের নামে কবিতাও লিখেছিলেন।

সৃষ্টিশীল এই মানুষটির মাঝে কখনো অহমিকাবোধ কাজ করেনি। বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচিত্রের গীতিকার হওয়া সত্ত্বেও কোনো দিন গর্ব করেননি। খ্যাতির পেছনে ছুটে কখনো তারকা হওয়ার চেষ্টাও করেননি। নীরবে-নিভৃতে তিনি তাঁর শিল্প সত্তাকে বিকশিত করে গেছেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি মুখ ও মুখোশের গীতিকার হয়েও কোনো সম্মানী নেননি। সাংস্কৃতিক জগতের অনেক বড় বড় তারকাও দাদুর হাত ধরে আকাশ ছোঁয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এমনও শুনেছি টেলিভিশনের পর্দার অনেক খ্যাতনামা শিল্পী একটু সুযোগের জন্য দাদার কাছে দিনের পর দিন অনুরোধ করেছেন। দাদা তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছেনও। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, তারকা হওয়ার পর তারার জগৎ থেকে অন্তরালে থাকা সারথি দাদুকে কেউ মনে রাখেননি। কেউ না। নিভৃতচারী দাদুর এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিল না। দাদুর লেখা অনেক কবিতাও অনেকে নিজের নামে পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে ছাপিয়েছে, তিনি এ ব্যাপারেও কোনো অভিযোগ করেননি। তিনি সৃষ্টির পেছনে আনন্দকে খুঁজে বেরিয়েছেন, খ্যাতিকে নন। দুধের মাছির মতো সুসময়ে যারা পাশে ছিল, দুঃসময়ে তাদের ছায়াও দেখা যায়নি।
জীবন সায়াহ্নে এসে দাদু কেবল একটা কথাই বলতেন, আজ আমার বন্ধুরা অনেক ব্যস্ত তাই আমার খোঁজ নেওয়ার সময় পায় না, কিন্তু আমি যেদিন মারা যাব, সেদিন সবাই আসবে...! অনেকেই এসেছেন কিন্তু দুধের মাছিরা আর আসেননি। হয়তো পত্রিকা আর টেলিভিশনের খবর দেখে সারথি দাদুর জন্য দু–একটা অহেতুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন।
১৯৯৯ সালে দাদু আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। সাংস্কৃতিক জগতের সোনালি–রুপালি ও সাদা–কালো কোনো জগৎ নিয়েই আমরা কেউ মাথা ঘামাইনি কারণ মানুষ যখন খ্যাতির উচ্চশিখরে থাকেন তখনই সবাই তাকে মূল্যবান ভাবে, তারই গুণকীর্তন গায়। অন্তরালের মানুষেরা অন্তরালেই পড়ে থাকেন। কিন্তু মেঘের আড়ালে উজ্জ্বল নক্ষত্র ঢাকা পড়লেও, মেঘ সরে গেলে আবারও তার উজ্জ্বল দীপ্তি সবার চোখে ধরা পড়ে।
আজ এতগুলো বছর পর মেঘে ঢাকা সেই নক্ষত্রকে আবারও মেঘমুক্ত স্বচ্ছ আকাশে টেনে আনলেন আসলাম আহসান। যে মানুষটাকে সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, সেই মানুষটাকে নিয়ে তিনি ফিচার করেছেন। আসলাম আহসান তাঁর বাংলাদেশের সিনেমার স্মৃতি জাগানিয়া গান বইটি দাদাকে উৎসর্গ করেছেন এবং দাদার অনেক অজানা তথ্য বইটিতে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর এই বইটি নিজে এসে আমার বাবাকে শুভেচ্ছা উপহার দিয়ে গেছেন। তাঁর কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের খোঁজে পথে নামা এই মহান ব্যক্তির আল্লাহ মঙ্গল করুন। আমাদের দীর্ঘদিনের ক্ষীণ আক্ষেপ কিছুটা হলেও প্রশমিত হলো।
সবার কাছে দাদু বলে পরিচিত সারথি দাদু আজ নেই। তিনি আজ সীমার বাইরে। হয়তো তিনি তাঁর যোগ্য প্রতিদানটুকু পাননি কিন্তু আমাদের আকাশে তিনি আজীবন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন। আলোকবর্ষ দূর থেকে আমাদের আলোকিত করে যাচ্ছেন। সেই আলোয় আমরা পথ চলি। আমরা জানি, আমাদের পথের সারথি কখনই আমাদের ছেড়ে যাবেন না।
আমাদের অন্তরে সারথি দাদু বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল!