সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ন্যাটো ঘরে বসে বাগ্যুদ্ধ করছে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চটজলদি শেষ হয়ে যাবে বলে যাঁরা ভেবেছেন, তাঁরা এখন চিন্তিত, যুদ্ধ কি দীর্ঘস্থায়ী হবে? রাশিয়া ও ফ্রান্সের পাল্টাপাল্টি পারমাণবিক সমরাস্ত্র ব্যবহারের হুমকি পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের চিন্তাকে দুশ্চিন্তায় পরিণত করেছে। ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, কোনো দেশ ইউক্রেনের ওপর বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে মস্কো তা সরাসরি সামরিক সংঘাত বলে মনে করবে। ন্যাটো বলেছে, নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। যাঁরা ভেবেছেন যে ন্যাটো সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে, তাঁরাও হতাশ হচ্ছেন। তাঁরা বুঝতে চাননি যে ন্যাটো করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাক্যুদ্ধ করবে!
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি ঠিক যুদ্ধ, নাকি যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা? পুতিন কী করতে চাচ্ছেন? ইতিমধ্যে তিনি ইউক্রেনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং চেরনোবিলসহ ইউরোপের বৃহৎ পারমাণবিক স্থাপনা কেন্দ্র দখল করে নিয়েছেন। ইউক্রেনে ১৫টি পারমাণবিক কেন্দ্র আছে, হয়তো তিনি সব কটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বা নেবেন। অনেকে ভেবেছেন যে পুতিন সহজে ইউক্রেন দখল করবেন এবং দেশটিকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করবেন। রাশিয়া তা করছে না, বরং গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে। পুতিনের লক্ষ্য হয়তো ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করা বা নিরপেক্ষ করা। রাশিয়া হয়তো ইউক্রেনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সুইজারল্যান্ডের মতো নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়? বিশ্বের সব ধরনের সংঘাতে সব সময় নিরপেক্ষ থাকা ইউরোপীয় দেশ সুইজারল্যান্ড এবার ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান ত্যাগ করে সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে।
রাশিয়ার পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো দখল নেওয়ার কারণ হয়তো ওগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে সেগুলো কখনো পারমাণবিক সমরাস্ত্র তৈরিতে সক্ষম না হয়। রাশিয়া হয়তো ইউক্রেনকে দুর্বল করার জন্য তিন ভাগে বিভক্ত করবে এবং কিয়েভে মস্কোপন্থী সরকার বসাবে? আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত ইউক্রেনের সাবেক মস্কোপন্থী প্রেসিডেন্ট রাশিয়ায় আছেন। রাশিয়া সফলভাবে ইউক্রেনের অবকাঠামো অনেকটাই ভেঙে দিয়েছে। কিউবায় যে কারণে আমেরিকা ওয়ারশর সমরাস্ত্র ঘাঁটি করতে দেয়নি, একই কারণে রাশিয়া তার দোরগোড়ায় ন্যাটোর ঘাঁটি গড়তে দেবে না। হয়তো এ কারণে যুদ্ধ শুরুর আগমুহূর্তে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেন।
ইউক্রেনে রাশিয়া কী করবে, এটি কঠিন প্রশ্ন? আফগানিস্তানের কথা রাশিয়া ভুলে যায়নি, সেখানে আমেরিকা নিজে যুদ্ধ জড়ায়নি, মুজাহিদদের দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে, ইউক্রেনে কি তাই হবে? পর্বতসঙ্কুল আফগানিস্তান আর ইউক্রেন এক নয়? এবারও আমেরিকা বা ন্যাটো যুদ্ধে যাবে না, ইউক্রেনিয়ানদের নিয়ে গেরিলাযুদ্ধ চালাবে? ইতিমধ্যে প্রায় ২০ লাখ ইউক্রেনিয়ান দেশ ছেড়েছেন, অধিকাংশ পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। মিডিয়া জানাচ্ছে, এঁদের কেউ কেউ নাকি গেরিলাযুদ্ধ করতে দেশে ফিরে গেছেন? পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনের জনগণের কান্নায় তিনি বিচলিত নন। কারণ তিনি ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তানের মানুষের কান্না দেখে বড় হয়েছেন? ইউরোপিয়ানদের খণ্ডিত মানবতার জন্য মায়াকান্নার তিনি ধিক্কার জানান।
যাঁরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন, তাঁরা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে পুতিনের পরাজয় দেখতে পাচ্ছেন? তা কি সম্ভব? এ যুদ্ধে রাশিয়া হারবে? তেমন ঘটলে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ওয়ারশ জোটের পতনের পর সেটি হবে রাশিয়ার জন্য আরেক বিপর্যয়কর অধ্যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার জন্য মিখাইল গর্বাচেভ ও ইয়েলৎসিনকে দায়ী করা হয়, পুতিন কি রাশিয়াকে ন্যাটোর হাতে তুলে দেবেন? গণমাধ্যমে অনেক অবিশ্বাস্য সংবাদ আসছে। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ‘হাসিয়া উড়াইয়া’ দেওয়াটা ঠিক হবে না। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, ‘যে পৃথিবীতে রাশিয়া থাকবে না, সেই পৃথিবীর অস্তিত্বের প্রয়োজন কী? ১৯৯৯ সালে পুতিন চেচনিয়াকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। ২০০৮-এ নির্মমভাবে জর্জিয়ার অবস্থার কথাও নিশ্চয়ই মনে আছে। ইউক্রেনের এখন ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা। মিত্ররা জেলেনস্কিকে মই বেয়ে ওপরে উঠিয়ে দিয়েছে, পুতিন এখন টেনেহিঁচড়ে নামাবেন।
রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। সাময়িক ক্ষতি পোষাতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ইন্টারেস্ট রেট’ সাড়ে ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেছে। এ মুহূর্তে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ব্যক্তি পুতিন ও তাঁর ‘ইনার সার্কেল’-এর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। যুদ্ধে যাওয়ার আগে কি রাশিয়া এসব ভাবেনি? নিশ্চয় ভেবেছে, এর ডিপোজিট অর্থের পরিমাণ ৬৩০ বিলিয়ন ডলার। ইইউ যতই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিক না কেন, নিজেদের প্রয়োজনেই এরা বেশি দিন তা চালু রাখতে পারবে না। রাশিয়া সারা পৃথিবীতে ১০ শতাংশ এবং ইউরোপে ২০ শতাংশ তেল ও ৩০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে, অর্থনৈতিক অবরোধে এসব বন্ধ হয়ে গেলে ইউরোপ, বিশেষত বাল্টিক দেশগুলো সমস্যায় পড়বে। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন আলোচনা চলছে, যুদ্ধবিরতি নিয়ে কথা হচ্ছে, যুদ্ধও চলছে। বেলারুশ এ যুদ্ধে সরাসরি রাশিয়ার পক্ষে নেমেছে। ব্রিটেন, জার্মানি, কানাডা, স্পেনসহ ৩৬টি দেশ আকাশসীমা বন্ধ করেছে। ওয়াশিংটন-মস্কো হটলাইন চালু হয়েছে।
অনেকে এ যুদ্ধকে হিটলারের চেকোস্লোভাকিয়া দখলের সঙ্গে তুলনা করতে চাইছেন, এবং পুতিনকে হিটলার? ওই অঞ্চলে শান্তি স্থাপনে ২০১৫ সালে মস্কো-ইউক্রেন ‘মিনস্ক চুক্তি’ স্বাক্ষর করে, এক্ষনে ওই চুক্তি লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ যুদ্ধে জাতিসংঘ একটি ‘অনাথ আশ্রমের’ ভূমিকা পালন করে। এ সময়ে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্নটি হচ্ছে, ১৯৯৪ সালে ইউক্রেন যদি এর পারমাণবিক সমরাস্ত্র ধ্বংস না করত তাহলে কি এ ঘটনা ঘটত? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন আপনা–আপনি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে যায়। কিন্তু অর্থাভাবে পারমাণবিক সমরাস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপ তখন পরামর্শ দেয় ওই সব সমরাস্ত্র ধ্বংস করে ফেলতে। একই সঙ্গে এরা ইউক্রেনের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি দেয়। ইউক্রেন এর সব পারমাণবিক সমরাস্ত্র ধ্বংস করে দেয়। গ্যারান্টি দেওয়া একটি দেশ রাশিয়া এখন ইউক্রেন গিলে খাচ্ছে, অন্যরা কেটে পড়েছে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি থাকলে এমনটা ঘটত না?’ আমেরিকানরা ইউক্রেনে ব্যর্থতার জন্য বাইডেনকে দায়ী করছেন, বলছেন, অতিবৃদ্ধ বাইডেন এত বড় আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য নেই। বাইডেন অবাস্তব স্বর্গীয় ভালোবাসার গল্প শোনাচ্ছেন। উল্টো বক্তব্যও আছে। ইউরোপ-আমেরিকা স্যাংশন জোরদার করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব নিষেধাজ্ঞায় তেমন প্রভাব ফেলবে কি? আমেরিকা কি পুতিন সাম্রাজ্যকে ভেনেজুয়েলার মতো ‘ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ’ হিসেবে গণ্য করতে পারবে? যুদ্ধের পরিস্থিতিতে আমেরিকায় তেলের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। অপর একটি মত হচ্ছে, এ যুদ্ধে সবচেয়ে লাভবান হবে আমেরিকা। অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে রাশিয়া দুর্বল হবে, ইউরোপ পিছিয়ে পড়বে। লাভ আমেরিকার। অন্যভাবে চিন্তা করলে রাশিয়া ও ইউক্রেন যদি ইইউ বা ন্যাটোতে ঢুকে পড়ে বা তাদের নেওয়া হয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকা ও চীন? চীন কিন্তু তলে তলে কলকাঠি নাড়ছে!
এটি ঠিক, ১৯৭১ সালের রাশিয়া আর ২০২২ সালের পুতিনের রাশিয়া এক নয়। ১৯৭১ সালে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, এখন রাশিয়া? এই ৫০ বছরের ব্যবধানে রাশিয়ার মিডিয়া কখনোই স্বাধীন ছিল না। বরং রাশিয়ার মিডিয়া এরশাদ আমলের মতো সর্বদাই ‘মিয়া-বিবি’র বাক্স’ ছিল? এবার পশ্চিমা মিডিয়া কার বাক্স? বিশ্ববাসী এবার পশ্চিমা মিডিয়ার চেহারাটাও দেখল। উভয় পক্ষ এখন একে অপরকে ‘গুজবের বাক্স’ হিসেবে অভিহিত করছে। রাশিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে, কারারুদ্ধ বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন। পশ্চিমা মিডিয়ায় সেটা বহুল প্রচার পেয়েছে, আসলে কি তাই? যুদ্ধের ডামাডোলে অনেক খবর আসছে, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়, আল-জাজিরা এর ক্রেডিবিলিটি হারিয়েছে। শুনলাম, বাংলাদেশি নাবিকের মৃত্যুতে রাশিয়া দুঃখ প্রকাশ করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এক ভদ্রলোক এ যুদ্ধকে বিবাহিত জীবনের সঙ্গে তুলনা করেছেন এভাবে যে—এ ক্ষেত্রে ইউক্রেন হচ্ছেন স্বামী, বউ রাশিয়া আর পরিবার হচ্ছে ‘ন্যাটো’!