সাধারণের সর্বজনীন রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছবি: সংগৃহীত

গিন্নিকে বললাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লিখতে চাইছি। শুনে গিন্নি শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, তাঁকে নিয়ে লেখার লোকের অভাব নেই, তাই আপনার না লিখলেও চলবে। গিন্নির উত্তর শুনে আমার মনেও একই ভাবনা তৈরি হলো। তাই ব্যস্ততার অজুহাতে আর তাঁকে নিয়ে লেখার সাহস করলাম না। আসলে রবীন্দ্রভক্ত বা অনুসারী যা–ই বলি না কেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যুগ যুগ ধরে এমনভাবে সংরক্ষণ করে চলেছেন যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুই তাঁদের সম্পত্তি। ছোট জাতের মানুষের জন্য রবীন্দ্রনাথ নয়। ছোট জাতের লোক ছুঁয়ে দিলে রবীন্দ্রনাথ অশুচি হয়ে যাবেন। এভাবেই একসময় ওনার মৃত্যুবার্ষিকীও চলে এল। এভাবেই প্রতিবছর রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকী এবং মৃত্যুবার্ষিকী আসে এবং চলে যায়। আবার এর মধ্যেই শুরু হয়েছিল জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক। তখন মনে হয়েছিল আমার মতো ক্ষুদ্র একজন মানুষের রবীন্দ্রভাবনা সবার সঙ্গে শেয়ার করা যেতেই পারে। কিন্তু সময়ের অভাবে আর লেখা হয়ে ওঠে না। এবার ভাবলাম লিখেই ফেলা যাক।

শুরুতেই বলে রাখা ভালো, আমি বেড়ে উঠছি কুষ্টিয়ার শহরতলির একটা গ্রাম বাড়াদিতে। শহরের পৌরসভার সীমানা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে আমাদের গ্রাম শুরু হয়েছিল, এখন অবশ্য পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত। প্রাথমিকের পাঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল প্রথম ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার মাধ্যমে। তখনো জানা ছিল না কুষ্টিয়াতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি এবং কাছারিবাড়ি আছে এবং কবিতাটা কুষ্টিয়ারই একটা নদীকে দেখে লেখা। পরে জেনেছি, আমাদের ছোট নদী আসলে কুষ্টিয়ার গড়াই নদ, যেটা আসলে পদ্মা নদীর একটা শাখা। কুষ্টিয়ার তালবাড়ির নামক জায়গা থেকে শাখাটা বের হয়ে কুষ্টিয়ার কোল ঘেঁষে দক্ষিণে চলে গেছে। এ ছাড়া শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে দেখেছি, উনি যে বারান্দায় বসে লেখালেখি করতেন, সেখান থেকে পরিষ্কারভাবে পদ্মা নদী দেখা যায়। এরপর ‘বীরপুরুষ’ আর ‘আষাঢ়’ কবিতা দুটি পড়া হয়েছিল, কিন্তু ওনার সম্বন্ধে সেভাবে তেমন কিছুই জানতাম না। উনি কত বড় মাপের কবি বা সাহিত্যিক, সে বিষয়ে বিন্দুবিসর্গও ধারণা ছিল না, বরং গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষের কাছ থেকে উল্টোটাই শুনতাম। সেটা হলো উনি নাকি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা চুরি করে নোবেল নামের একটা দামি পুরস্কার পেয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছবি: সংগৃহীত

এরপর মাধ্যমিকে ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটার কথা স্মরণ হয় শুধু। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পাঠ্যবইয়ের ‘হৈমন্তী’ গল্পটা সিলেবাসে ছিল, তাই পড়া হয়েছিল। হৈমন্তীর কাহিনির গুণেই গল্পটা হৃদয়ে দাগ কেটেছিল। হয়তোবা হৈমন্তীর করুণ পরিণতি আমার কিশোর মন নিতে পারেনি। এরপর আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। তবে মাঝেমধ্যে কাউকে ধীরলয়ের রবীন্দ্রসংগীত শুনতে দেখলে ঠাট্টা করে বলতাম, আপনার বয়স বেড়ে গেছে। আপনি প্রৌঢ় হয়ে গেছেন। রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে সেই বয়সের গান, যে বয়সে মানুষের আর কিছুই করার থাকে না। তখন বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে মৃদু মৃদু দুলবে আর সারা দিন ধরে রবীন্দ্রসংগীত শুনবে। আর রবীন্দ্রসংগীতকে আমার কেন জানি প্রেমের গান মনে হতো। বাস্তব জীবনের ক্ষুধা–দারিদ্র্যের স্থান সেখানে নেই, তাই আরও বেশি বিরক্ত হতাম।

পশ্চিম বাংলার আনন্দমেলা পত্রিকা আমাদের খুবই প্রিয় ছিল। সেই পত্রিকার মাধ্যমেই অন্য অনেক লেখকের সঙ্গে পরিচয় হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। আর গোয়েন্দা উপন্যাস, কল্পকাহিনি বা থ্রিলারধর্মী বইগুলোই বরাবর আমাকে বেশি টানে। পশ্চিম বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশে যে গল্পগুলো প্রচলিত আছে, সে কারণেই আমি কখনোই সমসাময়িক সাহিত্যগুলোকে পড়তে আগ্রহ পেতাম না। বারবার মনে হতো, যেহেতু ওপারের সঙ্গে এপার বাংলার মানসিকতার অনেক তফাত, তাই ওদের সাহিত্যে আমাদের জীবনের ছোঁয়া খুব একটা পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে এপারের বাংলা সাহিত্য পড়াই শ্রেয়। যদিও বাড়িতে মেজ ভাই ইউনুস সমসাময়িক পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের অনেক বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সূত্র: উইকিমিডিয়া কমনস

ওর কাছেই একদিন দেখলাম ‘প্রথম আলো’ নামের ঢাউস আকৃতির একটা বই। যদিও জানি এ বই পড়ে শেষ করার মতো ধৈর্য আমার নেই, তবু হাতে যেহেতু অন্য কোনো বই নেই, তাই সময় পার করার জন্য পড়তে শুরু করলাম। কিছু দূর পড়ার পরই বইটা আমাকে চুম্বকের মতো আটকে ফেলল। সংসারের কাজকর্ম করব, নাকি এই বই পড়ে শেষ করব। আবার আমি যেহেতু অনেক ধীরে ধীরে পড়ি, তাই পড়াটাও সেইভাবে এগোচ্ছিল না। ধীরে ধীরে পড়ার কারণে বই পড়ার সময় আমার চোখের সামনে বইয়ের চরিত্রগুলো চলাফেরা শুরু করে। এটা আমি খুবই উপভোগ করি। এমনকি বই পড়া শেষ হয়ে গেলেও বইয়ের চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে থেকে যায়। এ বইটা যদিও উপন্যাস আকারে লেখা, তাই লেখককে অনেক কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে তবুও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে পড়া আমার প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষ বই। ভবিষ্যতে ওনার ওপরে লেখা আরও কোনো ভালো বই হয়তোবা পড়া হবে।

এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি একধরনের শ্রদ্ধা কাজ করতে শুরু করল। একজন মানুষ পুরোপুরি সমাজ–সংসার, সেই সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করে কীভাবে এত কিছু লিখে গেছেন। এরপর এক আত্মীয়ের বাসায় ওনার লেখা ‘গল্পগুচ্ছ’ পেয়ে গেলাম। যতবারই পড়ি, ততবারই মুগ্ধ হই। উনি এত সহজ ভাষায় ছোটগল্পও লিখে গেছেন। এরপর নাগরিক ব্যস্ততায় ওনার আর কোনো লেখা তেমন একটা পড়া হয়নি, কিন্তু মনের মধ্যে ক্ষুধা তৈরি হয়ে আছে ওনার লেখা পড়ার। একদিন পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, পাঠক সমাবেশ নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকাশিত অপ্রকাশিত সকল রচনা, চিত্রকর্ম এমনকি চিঠিপত্রের সমাহারে পঁচিশ খণ্ডের রবীন্দ্রসমগ্র বের করতে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনটা দেখে খুবই খুশি হলাম কিন্তু আবার দমেও গেলাম কিছুটা কারণ সমগ্র পঁচিশ খণ্ডের দাম রাখা হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা। একটা তারিখ উল্লেখ করে দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। গিন্নিকে বললাম বুকিং দেওয়ার জন্য কিন্তু তিনি রাজি হলেন না আর আমিও ভুলে গেলাম।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এরপর দেখি আবার সেই একই বিজ্ঞাপন। বুকিং দেওয়ার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এবার গিন্নিকে রাজি করিয়ে ফেললাম। এবং এক ছুটির সকালে আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে বুকিং দিয়ে এলাম। এরপর থেকে পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতাম কবে থেকে বের হওয়া শুরু হয় সেটা জানার জন্য। প্রথম খণ্ড বের হওয়ার পর দ্রুতই গিয়ে সেটা সংগ্রহ করে আনলাম এবং বইয়ের আলমারিতে একটা খোপ ওনার জন্য আলাদা করে ফেললাম। সেই খোপে শুধুই ওনার বই রাখা হবে। একটা করে খণ্ড বের হয় আর পত্রিকা মারফত সেই খবর পাওয়া মাত্রই সেটা সংগ্রহ করে আনি। দেশ ছেড়ে আসার আগপর্যন্ত যত দূর মনে পড়ে আঠারো খণ্ড বের হয়েছিল এরপর বাকি খণ্ডগুলো বের হয়েছে এবং আমার শ্যালক সেগুলো নিয়ে এসেছে। এরপর পঁচিশ খণ্ডের দাম বেশ কয়েক ধাপে বেড়ে গিয়ে বর্তমানে সেটা দাঁড়িয়েছে পঁয়তাল্লিশ হাজারে। এখন মনে হয় ভাগ্যিস তখন বুকিং দিয়েছিলাম, না হলে জীবনেও রবীন্দ্রসমগ্র আমার কেনা হতো না। এখন রাস্তা খুঁজছি কীভাবে কম খরচে পঁচিশ খণ্ডকে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসা যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে শুরু করে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উনি শুধু আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতাই নন, ওনার গান ছাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব পয়লা বৈশাখ পালন করা অসম্ভব। যদিও এখন জাতীয় সংগীত এমনকি ওনার পয়লা বৈশাখ নিয়ে রচিত গানেরও বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা হচ্ছে। খুঁজে বের করা হচ্ছে উনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উনি পক্ষে না বিপক্ষে ছিলেন। এসব ব্যাপারই খুবই দুঃখজনক হলেও আমার কাছে অবাক লাগেনি, কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কখনোই জনমানুষের কাছে সেভাবে পৌঁছাতে দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানিরা সেটা করেছিল আইন করে আর স্বাধীন বাংলাদেশে সেটা করা হয়েছিল শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। এখানে পথেঘটে–অলিগলিতে বিভিন্ন সংগীতশিল্পীর চটুল ছন্দের এবং সুরের অশ্লীল গান বাজতে শোনা গেলেও রবীন্দ্রসংগীত বাজতে শোনা যায় না হয়তোবা রবীন্দ্রসংগীতের ধীরলয়ের কারণে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

পয়লা বৈশাখের সবচেয়ে বড় উৎসব রমনার বটমূলের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় হামলা ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আঘাত। এরপর থেকে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় ধীরে ধীরে একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। আমি জানি না আমাদের সমাজ গবেষকেরা সেদিকটা খেয়াল করেছেন কি না? বটমূলে হামলার পর মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠের দেশে সবাই হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে শিখল যে পয়লা বৈশাখ পালন আসলে হিন্দুয়ানি একটা ব্যাপার। ৯০ শতাংশের ওপরে যে দেশের জনগোষ্ঠী মুসলিম, সেখানে এসব বিদাতি কাজকর্ম বরদাশত করা হবে না, যদিও অধিকাংশ মুসলিম অনেক বেশি উদারনৈতিক মানসিকতাসম্পন্ন। এরপর একদল দাঁড়িয়ে গেল পয়লা বৈশাখের গানটার ব্যবচ্ছেদ করতে। তাদের অনেক ব্যাখ্যার একটি হচ্ছে ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ কথাটার মানে হচ্ছে অগ্নি পূজা করা। যেহেতু হিন্দুরা পূজা করে, তাই তারা অগ্নিস্নানে এ পৃথিবীকে পবিত্র করতে চাইছে। ব্যাখ্যাটা অদ্ভুত শোনালেও অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষ ছাড়াও অনেক শিক্ষিত মানুষ মনে মনে এই ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছে।

এ ছাড়া এখন রমনার বটমূলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাটা হয় পুলিশি প্রহরায়। একবার রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান শেষে সন্‌জীদা খানম খুব দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে পুলিশি প্রহরার ব্যাপারটা বললেন। উনি বললেন, এভাবে ধরেবেঁধে করা এই সমস্ত অনুষ্ঠানে আর যাই থাকুক প্রাণের পরশ থাকে না। আর যেখানে প্রাণের পরশ থাকে না, সেটা কখনোই জনমানুষের অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে না। একই মত আমারও। ওরা এই কর্মকাণ্ডগুলোয় জনবিচ্ছিন্ন করতেই হামলাটা চালিয়েছিল এবং তারা সর্বাংশে সফল হয়েছে। আমি বেশ কয়েকবার মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও গিয়েছি। সেখানেও দেখেছি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়ি।

অনেকটা চিড়িয়াখানার পশুকে খাঁচায় ভরে জনগণের সামনে প্রদর্শন করার মতো। আমার কথা হচ্ছে হামলার ভয়ে এই অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজনে কোনো ধরনের কড়াকড়ি আরোপ না করাই ভালো। তাতে জনমানুষের অংশগ্রহণ অনেক বাড়বে আশা করি। যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যদি শুধু সেনাবাহিনী বা প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের দিয়ে লড়া হতো, তাহলে বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীন হতো কি না, আমার সন্দেহ আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সবাই অনুভব করেছিলেন এবং যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে এসেছিলেন বলেই আমরা বাংলাদেশ নামে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছিলাম। ঠিক একইভাবে এখন এসব গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সোচ্চার করতে না পারলে অনুষ্ঠানগুলো যেমন একদিকে সৌন্দর্য হারাবে, অন্যদিকে আমার কেন জানি মনে হয় একসময় এগুলো বন্ধ করে দেবে বাংলাদেশের সরকার। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো মূল্যবোধের চেয়ে ভোটারের সংখ্যাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি।

আমার রাগ বা দুঃখটা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন সাহিত্যিককে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি বা করতে চাইনি। আর ওনার গানের বা কবিতার সৌন্দর্য হরণ হয়ে যাবে বলে কিছু অতিমাত্রায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সেটাকে নিজেদের সম্পদ হিসেবে কুক্ষিগত করে রেখেছে। অবশ্য শান্তিনিকেতনের বিধিনিষেধের পর অনেকেই রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কাজ করছেন এবং সেগুলো আমাদের তরুণ প্রজন্ম শুনছেও, সেটাই আশার কথা। একবার যখন সেটা শুনবে, তখন সে সেটার উৎস অনুসন্ধান করবে এবং একসময় অরিজিনাল ভার্সনটাই শুনে ফেলবে। তখন সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা তার ওপরই ছেড়ে দিতে হবে, সে কোনটা শুনবে বা ধরে রাখবে। কিন্তু শুরুতেই যদি আমি বিধিনিষেধের জালে বেঁধে ফেলি, তাহলে সেটা আর শোনা হবে না। প্রবাসজীবনেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গোষ্ঠীভিত্তিক কাজ হলেও সামগ্রিক কোনো কাজ হচ্ছে না তাই দেশের মতো প্রবাসে রবীন্দ্রনাথ কিছু মানুষের উত্তরাধিকার হয়ে রয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র হয়তোবা একসময় পড়তে শুরু করলে ওনার মেধার আরও অনেক দিকের সন্ধান পাব। কিন্তু আমার একসময় ধারণা ছিল উনি শুধু আঁতেল জনগোষ্ঠীর জন্যই লিখে গেছেন। আমার এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন আমাদের প্রতিবেশী নাজমুল ভাই। উনি একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। শুনে আমি খুবই খুশি হলাম কিন্তু তখনো জানতাম না যে এমন লেখাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন। পাঠকের জন্য লেখাটা এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছে আশা করি সবাই বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বজনীনতার একটা উদাহরণ পেয়ে যাবেন।

‘ভালো মানুষ নই রে মোরা ভালো মানুষ নই-
গুণের মধ্যে ওই আমাদের, গুণের মধ্যে ওই॥
দেশে দেশে নিন্দে রটে, পদে পদে বিপদ ঘটে-
পুঁথির কথা কই নে মোরা, উল্টো কথা কই॥
জন্ম মোদের ত্র্যহস্পর্শে, সকল অনাসৃষ্টি।
ছুটি নিলেন বৃহস্পতি, রইল শনির দৃষ্টি।
অযাত্রাতে নৌকো ভাসা, রাখি নে, ভাই, ফলের আশা-
আমাদের আর নাই যে গতি ভেসেই চলা বই॥’