সাংবাদিক সেলিমের চলে যাওয়া

আজিজ আহমেদ (সেলিম)

আমার সাংবাদিকতা জীবনের সুদীর্ঘ সময়ের সহকর্মী, স্বজন আজিজ আহমদ (সেলিম) যিনি আমাদের কাছে সেলিম ভাই নামে পরিচিত ছিলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সিলেট সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রতিনিয়ত নামাজের আসনে বসলেই দুহাত তুলে মহান স্রষ্টার কাছে তার সুস্থতার জন্য দোয়া করেই যাচ্ছিলাম।

মাঝখানে সেলিম ভাইয়ের ভালো হয়ে ওঠার খবরও পেলাম। অক্সিজেন খুলে নেওয়া হয়েছে, হেঁটে বাথরুমে যেতে পারছিলেন। এমন খবর জেনে আশান্বিত হয়েছিলাম। প্রতিদিন তার খবর জানার জন্য দেশে ফোন করি। ফেসবুকের পাতায় আঁতিপাঁতি করে তাঁকে খুঁজি। ১৮ অক্টোবর ফজরের নামাজ শেষে একইভাবে ফেসবুকের পাতায় চোখ রেখে অনেকটা সময় কাটালাম। না, নতুন কোনো খবর নেই। সকাল হল।

বোধ হয় সাড়ে দশটা হবে। টেলিফোনের রিং টোনে জানান দিল, সেলিম ভাইয়ের চলে যাওয়ার খবর।

স্বয়ং স্রষ্টাই বলেছেন, ‘কুললু নাফসিন জা ইকাতুল মউত’। মৃত্যু অবধারিত, প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ লাভ করবে। এই যে এত দিন ধরে ধীরে ধীরে সেলিম ভাই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, এই যাওয়াটার খবর যে আমরা সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। কেবলই ভালো কিছু শোনার জন্য কান পেতেছিলাম। শেষ পর্যন্ত নির্মম সেই খবরটা শুনতে হল। সেলিম সিলেটের সাহিত্য সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার জগতের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

আমার সুদীর্ঘ সময়ের সহকর্মী। সিলেটের এক সময়ের প্রধানতম সংবাদপত্র, ত্রিশের দশকে জন্ম নেওয়া সাপ্তাহিক যুগভেরীতে একসঙ্গে কাজ করেছি। এই পত্রিকাটি ১৯৯৩ সালে এসে দৈনিকে উত্তরণ ঘটেছিল। যুগভেরীতে আমি আর সেলিম ভাই সংবাদকর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম ১৯৮৩ সালে। মাত্র মাস কয়েকের ব্যবধানে। এ নিয়ে তিনি একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলেন এভাবে ‘শামসাদ আমার শিক্ষা জীবনের সহপাঠী এবং কর্মজীবনে সহকর্মী ছিলেন। একই সালের খুব কাছাকাছি সময়ে আমাদের জন্ম।

আমরা একটি শ্রেষ্ঠ সময়ের প্রজন্ম। একাত্তর সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব গাথাকে জাগ্রত চোখে দেখেছি, হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। এবং এখনো স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণা করে চলেছি আপসহীন নির্ভীকতায়। খুব কাছাকাছি সময়ে আমরা দুজন যুগভেরীতে যোগ দিয়েছিলাম। যখন দেশে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের কোনো বালাই ছিল না। দেশে ছিল উর্দিপরাদের শাসন।

দেশের এই অপশাসনের বিরুদ্ধে যুগভেরী তখন আপসহীন ভূমিকা পালন করত। বিশেষ করে যুগভেরীর প্রাণপুরুষ আমীনুর রশীদ চৌধুরী পত্রিকাটিকে সব অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব‍্যবহার করতেন। এই সাহসী ভূমিকার খেসারত তিনি জীবন দিয়ে মিটিয়ে গেছেন।

পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের কারণে বাকি জীবন প্রায় পঙ্গু হয়ে ঘরবন্দী জীবন কাটালেও যুগভেরীর প্রতি ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। চাইতেন মুক্তবুদ্ধির মানুষ যেন পত্রিকায় কাজ করে। সেই চিন্তা থেকেই যুগভেরীতে সংবাদকর্মী নিয়োগ দেওয়া হতো।

আমি ও সেলিম ভাই যখন পত্রিকায় যোগ দিলাম, তখন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুবুর রহমান। তিনি এক সময় জাতীয় দৈনিক সংবাদের সিলেট প্রতিনিধি ছিলেন। যুগভেরীর তখন স্বর্ণযুগ। আমীনুর রশীদ চৌধুরী তখনো জীবিত। তাঁর স্ত্রী বেগম ফাহমিদা রশীদ চৌধুরীও পত্রিকার ভালো–মন্দের সঙ্গে জড়িত।

সিলেট বিভাগ আন্দোলন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন নিয়ে সিলেটের মানুষ তখন রাজপথে। তাদের সহযোগীর ভূমিকায় তখন যুগভেরী। ওই সময়ে পত্রিকার টেবিলে কাজ করছিলেন টিপু মজুমদার ও হামিদ মোহাম্মদ। এর আগে গিয়াস উদ্দিন ছিলেন। আমরা যোগ দেওয়ার পরে হামিদ ভাই লন্ডনে চলে গেলেন, গিয়াস সম্ভবত ঢাকায়। ঠিক তার পর আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন আবদুল মালিক (জাকা)। যুগভেরীর অফিস প্রাঙ্গণ প্রতিদিন নামী নামী মানুষের পদভারে মুখরিত থাকত। যুগভেরীতে তখন ইলাস্ট্রেটরের কাজ করতেন কবি হোসনে আরা হেনা।

আশির দশকের শেষের দিকে আমীনুর রশীদ চৌধুরী মারা গেলেন। পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন যদিও বেগম ফাহমিদা রশীদ চৌধুরী, কিন্তু মূল দায়িত্বে ছিলেন মাহবুবুর রহমান। যদিও পদবি তাঁর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তাঁর নেতৃত্বে আমরা তখন পত্রিকার এক ঝাঁক উজ্জ্বল পায়রা। সিলেট প্রেসক্লাব থেকে সাহিত্যের ভুবন, সব জায়গায় যুগভেরীর উজ্জ্বল উপস্থিতি। আশির দশকের শেষ দিকে তাপস দাস পুরকায়স্থ যুগভেরীতে যোগ দিলেন এবং আরও পরে অপূর্ব শর্মা।

১৯৮৯ সালে মাহবুবুর রহমান অভিবাসী হয়ে নিউইয়র্কে চলে এলেন। যুগভেরীতে তার মেয়াদ কাল ছিল প্রায় সতেরো বছরের মতো। তিনি চলে যাওয়ার পরে সেলিম ভাই ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেন। ’৯৩ সালে যুগভেরী তার সত্তর বছরের পথ পরিক্রমা শেষ করে দৈনিকে উত্তরণ ঘটে, আমরা তিন সহযোদ্ধা তখন প্রধান ভূমিকায়। সেলিম ভাই যথারীতি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, তাপস দা বার্তা সম্পাদক এবং আমি সহকারী সম্পাদক। দৈনিক হওয়ার পর নতুন আরও কয়েকজন যোগ দিয়েছেন।

এমনি সময়ে হঠাৎ করে টিপু মজুমদার মারা গেলেন। জমজমাট পত্রিকা অফিসের দিনের শিফটে আমি থাকি। রাতের শিফট চালান সেলিম ভাই আর তাপস দা। কত স্মৃতিময় অতীত। ’৮৩ সাল থেকে ২০০৬, প্রায় ২৩ বছরের মতো যুগভেরীর টেবিলে কেটে গেল আমাদের।

২০০৬ সালের ডিসেম্বরে আমি চলে এলাম নিউইয়র্কে। তবে আসার আগে কোনো একটা কারণে আমি, সেলিম ভাই আর তাপস দা তিনজন একযোগে যুগভেরী থেকে পদত্যাগ করলাম। এ নিয়ে এখন আর কিছু মনে করতে চাই না আমি। আমি চলে আসার পর সেলিম ভাই আর তাপস দা সদ্য প্রকাশিত দৈনিক উত্তর পূর্ব পত্রিকায় যোগ দিয়েছিলেন। আওয়ামী ঘরানার পত্রিকা। নীতির সঙ্গে আপস করতে হবে না। শুনেছিলাম মোটামুটি ভালোই আছেন। তা ছাড়া সেলিম ভাই নানা সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ব্যর্থ জীবন কাটাচ্ছিলেন।

টানা দুইবার সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। ছিলেন বিটিভির সিলেট প্রতিনিধি। এ ছাড়া বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থারও সিলেট প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সহসভাপতি ছাড়াও সনাক–এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। তিন কন্যার জনক সেলিম ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন ১৮ অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সিলেটের সুধী মহলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা কখনো পূরণ হবে না।