সহোদর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শীত প্রায় চলেই এসেছে। কাঁথাগুলো সব ট্রাঙ্কের মধ্যে তুলে রেখে মা লেপ নামিয়ে দিয়েছেন। সাঁঝ সকালে লেপ মুড়ি দিয়ে সকালের ঘুম আরও দীর্ঘ করতে চায় নয়ন। অনেকক্ষণ ধরে মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম প্রায় চলেই গেছে। জেগে থেকেও মায়ের ডাকের জবাব দিচ্ছে না নয়ন। এই শীতের মধ্যে এত ভোরে ওঠার কোনো ইচ্ছে নাই। পাশের ঘরে অয়নের পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে সাঁঝ সকালে উঠেই পড়তে বসেছে। মাকে ডাকাডাকি করতে হয়নি। সময়মতো নিজের পড়া সব নিজেই শেষ করে। রেজাল্টও ভালো করে। থাক পড়ুক। সবাই যদি ভালো রেজাল্ট করে, তবে খারাপ করবে কে! এই কথা ভেবে নয়ন কোলবালিশটা ভালো করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আরেকটু ঘুমানোর চেষ্টা করে।

মা ছেলেদের জন্য খোলা জালি পিঠা বানিয়েছেন। খেজুরের গুড় দিয়ে ভাপা পিঠারও আয়োজন করেছেন। বড় ছেলে নয়ন খেতে চেয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে মা ডাকছেন, নয়ন উঠছে না। পড়ার জন্য না উঠুক অন্তত পিঠা খাওয়ার জন্য তো উঠবে। ছেলেটা যে কী!

পড়ার ঘর থেকে অয়নের পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। নয়নটা এখনো উঠছে না। পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। বকাঝকা করেও লাভ হয় না। বাবা বেঁচে থাকতে মারধরও করেছে। কোনো লাভ হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর এই দুই সন্তানকে আগলে রেখেছেন, মা। ছেলেরাও বাড়ন্ত। নয়ন দশম শ্রেণিতে পড়ে। অয়ন অষ্টম শ্রেণিতে। এরই মধ্যে দুজনে বেশ লম্বা হয়ে গেছে, ওদের বাবার মতো।

বাজারের ওপরে দুইটা দোকান আছে। চলনশীল দোকান। আপাতত ওদের মামা দোকানের দেখভাল করছে। বাবা মারা যাওয়ার সময় এই মামাই কাছে ছিলেন। মারা যাওয়ার সময় মামার কাছেই স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে যান। নয়ন ও অয়নকে ডেকে বলেন, কখনো মামার অবাধ্য হসনে। এই মামার অনেক অবদান আছে, এই সংসারে। নয়নের তখন জগৎ সংসার বোঝার মতো বয়স না হলেও এই কথা বোঝার বয়স হয়েছে। অয়নের তখনো সেটা হয়নি।

সেই থেকে এই মামাই বোন ও ভাগনেদের দেখেশুনে রাখছেন। প্রায় প্রতিদিনই মামা একবার এসে বাজার থেকে শুরু করে, ঘরের যা যা দরকার সব করে দিয়ে যান। মাঝে মাঝে বোন, ভাগনেদের নিজের বাড়িতেও নিয়ে যান। মামার বাড়িতে দুই ভাইয়ের ভালো সময়ই কাটে। মামাতো ভাই-বোনগুলো ছোট ছোট। শুধু মল্লিকা একটু বড় হয়েছে। মল্লিকার সঙ্গে দুই ভাইয়ের মোটামুটি ভালো বন্ধুত্ব আছে। এই বাড়িতে এলে মল্লিকার সঙ্গে আর পাশের বাড়ির কিছু ছেলেমেয়ে এলে ওদের সঙ্গে খেলে। দুই ভাই মল্লিকাকে নিজের দলে নিতে চায়। এই নিয়ে শুরু হয় টানাটানি। পরে টস করে যার ভাগ্যে আসে সে নিজের দলে মল্লিকাকে নেয়। ছেলেবেলায় বউছি খেলার সময়ও মল্লিকা বউ হলে, দুই ভাইয়ের মারামারি শুরু হয়ে যায় কে বর হবে। পরে সবাই মিলে নয়নকে বর বানাত। নয়ন বড় আর বরের মতো খেলতে পারে। অয়ন ছোট, ঠিকমতো খেলতে পারে না।

এখন মল্লিকা আগের চেয়ে একটু বড় হয়েছে। এখন আর বউছি খেলে না। নয়নদের বাড়িতে এলেও দুই ভাই মল্লিকাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। নতুন নতুন সব জিনিস দেখায়। মেলা থেকে নতুন কী জিনিস কিনেছে, সেটা দেখায়। চার গুটি, ষোলো গুটি, লুডু। ওরা মল্লিকাকে নিয়ে খেলে। মাও খুশি থাকেন। ছেলে দুটোর বোন নেই। যেন বোন পেয়েছে তারা।

ক্রমেই দিন যেতে থাকে। নয়ন কোনো রকমে এসএসসি পাশ করে। ভালো রেজাল্ট না করুক, পাস করেছে, এটাই বড় কথা। মা আল্লাহর কাছে কত দোয়া করেছেন। কত কিছু নিয়ত করেছেন। আল্লাহ মায়ের দোয়া কবুল করেছেন। এ বছরটা ভালোই কেটেছে। অয়নও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছে। নবম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। আল্লাহর কাছে মায়ের শুকরিয়ার শেষ নেই।

নয়ন কলেজে ভর্তি হয়। পড়াশোনায় এখনো তেমন মনোযোগী নয়। কলেজে যায়, আসে। ঘরে তেমন পড়ে না। এইচএসসি পরীক্ষাও হয়। কিন্তু মায়ের দোয়া বা নিয়ত এবার আর সুফল দেয় না। নয়ন এইচএসসিতে ফেল করে। নয়ন পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু মা অনেক বোঝায়, মামা এসেও বোঝান। পরেরবার আবার পরীক্ষা দেয়। কিন্তু এবারও পাস করতে পারে না। নয়ন এবার পুরোপুরিভাবেই পড়ালেখা ছেড়ে দেয়।

মামা নয়নকে অনেক স্নেহ করেন। নয়ন সেটা জানে। অয়নের থেকেও নয়নের ওপর সবকিছুতে ভরসা করেন। নয়ন পড়াশোনা না করলেও কী হবে, নয়ন সৎ। মামা মাকেও সব সময় বলেন, আমি না থাকলেও চোখ বন্ধ করে নয়নের ওপর সংসারের সব ভার দেওয়া যাবে। নয়ন এই বয়সেই অনেক গাম্ভীর্য পেয়ে গেছে। ওর বাবার মতো। এটা মামার বেশি ভালো লাগে।

যেহেতু এখন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, তাই মামা এসে মাকে বুঝিয়ে নয়নকে দোকানে নিয়ে যান। আস্তে আস্তে দোকানদারি শেখাতে থাকেন। নয়ন নিয়মিত দোকানে আসে। বাবার মতো পুরো সংসারী হয়ে উঠেছে। মায়ের দেখতে ভালোই লাগে। এখন আর মামার ওপর তেমন নির্ভর করতে হয় না। কিন্তু মামা তবুও মাঝেমধ্যে আসেন। ভাগনের উন্নতি দেখেন।

ক্রমেই দিন যেতে থাকে। এদিকে অয়নও এসএসসি, এইচএসসি পাস করে ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছে। এখন বাড়িতে কম আসে। পড়ার চাপ নাকি বেড়েছে। এমনিতে যোগাযোগ সব সময়েই রাখে। মামাও অনেক সাহায্য করেন। অয়নের পড়াশোনার অনেক খরচ অনেক সময় মামাই দিয়েছেন। এখনো সময় অসময়ে, সুবিধা অসুবিধা জেনে নিয়ে সাহায্য করেন।

মল্লিকাও এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। খুব সুন্দরী হয়েছে। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই নয়ন–অয়নের সঙ্গে কম মেশে। মেয়েলি লাজুকতা। কিন্তু মল্লিকাদের বাড়িতে গেলে খুব আপ্যায়ন করে। মামির চেয়েও মল্লিকা খুব বেশি আপ্যায়ন করে। ঈদের সময় তাদের বাড়ি যখন সবাই যায়। অয়নের সঙ্গে তেমন কথা না বললেও নয়নের সঙ্গে চোখাচোখি হলে দু–একটা কথা বলে, আবার লজ্জায় পালিয়ে যায়।

দোকানে মাঝে মাঝে মামা এলে নয়ন একথা সেই কথার ফাঁকে সবার কথা জিজ্ঞেস করার অছিলায় একবার মল্লিকার কথাও জিজ্ঞেস করে নেয়। মল্লিকা বড় হওয়ার পর থেকে নয়নদের বাড়িতে কম আসে। হয়তো নিজেই আসে না বা মামি আসতে নিষেধ করেছেন। নয়ন–অয়নের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেছেন।

রাতে বাড়ি এসে খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত মল্লিকার কথা ভাবতে নয়নের ভালো লাগে। মল্লিকার একটা ফটোগ্রাফও আছে। মানিব্যাগে সব সময় থাকে। একবার ঈদের সময় নয়ন ক্যামেরা দিয়ে সবার ছবি তুলেছে। নয়ন একফাঁকে চট করে মল্লিকার একটা ছবি তুলে নেয়। সেই থেকে ছবিটা সব সময় মানিব্যাগে রাখে। আর রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত দেখে। কত কিছু ভাবে, চোখ, নাক, ঠোঁট সবকিছু পরখ করে।

ছেলেবেলার বউছি খেলার কথা, নয়নের বর হওয়া, মল্লিকার বউ হওয়ার কথা নয়ন ভাবতে থাকে। নিজের আনমনে হেসে ওঠে। নয়ন জানে না, মল্লিকার মনেও তার জন্য এমন অনুভূতি জাগে কি না। অনুভূতি না জাগতে পারে কিন্তু অপছন্দ নিশ্চয়ই করে না। সেটা মল্লিকার চলনে, বলনে, তাকানোর ভঙ্গিতে বোঝা যায়।

মল্লিকার সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলার, দেখা হওয়ার কোনো সুযোগই কখনো হয় না। মল্লিকা খুব বেশি শরমিন্দা। ছেলেবেলায় এমন ছিল না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাজ-শরমও বেড়ে গেছে। মাথার ঘোমটাও তেমন পড়ে না। চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো দিন কথাও বলে না।

মাও মল্লিকাকে খুব পছন্দ করেন। নয়নের কাছে সব সময় মল্লিকার কথা বলেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে আকারে-ইঙ্গিতে নয়নের মতামত জানতে চান। নয়নও আকারে-ইঙ্গিতে নিজের পছন্দ বোঝাতে চায়। মা বোঝেন কি না সেটা নয়ন জানে না।

দিন যেতে থাকে। বাড়িতে ঘটক আসা শুরু করে। নয়নের মতো ভালো ছেলে আশপাশের কয়েক গ্রামেও পাওয়া যায় না। পাড়াপড়শিরাও তাই দুই এক জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আনতে থাকে। মা কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। এদিকে ছেলেরও বিয়ের বয়স হয়েছে। অয়নেরও আর দুই বছর পর পড়া শেষ হয়ে যাবে। তাকেও বিয়ে করাতে হবে। অয়ন অবশ্য এখনো ওসব কিছু বলে না। শহরে পড়ে, নিজের পছন্দও থাকতে পারে। বাড়িতে এখন আর তেমন আসেও না। পড়ার ব্যস্ততা।

মা শুধু ভাবেন আর ভাবেন। এই সংসারে বাইরের মেয়ে আনার চেয়ে নিজের ভাইয়ের মেয়েকে আনলেতো সবার জন্যই ভালো হয়। ভাইতো নয়নকে নিজের ছেলের মতোই জানেন। মল্লিকাও নিজের মেয়ের মতোই। লক্ষ্মী মেয়ে, যেই সংসারে যাবে৷ সংসারকে আলোকিত করবে। এই মেয়ে হওয়ার পর থেকে ভাইয়ের সংসারেও আয় উন্নতি বেড়েই চলছে। চালের আড়ত থেকে ব্যবসা বেড়ে সবজির আড়ত ও ফলের আড়ত হয়েছে। ভাইয়ের কপাল খুলেছে। রান্না বানা, অতিথি আপ্যায়ন, মুরব্বির খেদমতে এই মেয়ের তুলনা হয় না। যেমন শান্ত তেমন ঘরকন্না।

মা আর কিছু ভাবতে পারেন না। নয়নের সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা করার আগে ভাইয়ের সঙ্গেই আলোচনা করতে হবে। নয়ন কখনো মায়ের কথার এক চুলও নড়ে না।

মা পরদিন নয়নকে নিয়ে মামার বাড়ি যান। ভাইয়ের সঙ্গে জরুরি কথা আছে। নয়নকে বসার ঘরে রেখে মা, ভাইয়ের সঙ্গে ভেতরের ঘরে যান। নয়ন আড়ি পেতে দরজার কাছে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে সবকিছু শুনতে থাকে।

মরিয়ম বেগম ভাইকে বলেন, ভাইজান, আমি খুব জরুরি কথা বলার জন্য আজকে আসছি। আমি গত কয়দিন যাবৎ অনেক চিন্তাভাবনা করে, তারপর আপনার কাছে আসলাম। ছমির হোসেন বোন মরিয়মের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।

মরিয়ম বলেন, ভাইজান নয়নের এখন বিবাহের বয়স হইছে। চারদিক দিয়ে সবাই তার বিবাহের কথা বলছে। আমাদের মল্লিকারতো অনেক আগেই বিয়ের বয়স হয়ে এখন পেরিয়েও যাচ্ছে। আপনার যে সে নিয়ে কোনো ভাবনা দেখছি না। যাইহোক, আমি নয়নের জন্য মল্লিকাকে চাইতে এসেছি। এই নিয়ে আপনার কী মতামত?

ছমির হোসেন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন। খুব বিচক্ষণের মতো বোনের দিকে তাকান। তারপর বলেন, নয়ন খুব ভালো ছেলে। আমি তাকে খুব পছন্দ করি। তার মতো ছেলে হয় না। তুমি নিশ্চয়ই জান যে, অয়নের পড়ালেখার ব্যাপারে আমি সব সময় তোমার চেয়ে বেশি খোঁজ-খবর রাখি। তার পড়ালেখার অনেক খরচ আমি দেই। তাকে ডাক্তারিতে আমি ভর্তি করেছি, নিজ খরচে। তাকে ডাক্তারিতে ভর্তি করিয়ে আমি তাকে বলেছি, পাস করে বের হও। তারপর তুমি মল্লিকাকে বিবাহ করবে। মল্লিকাকে আমি তোমার হাতে তুলে দেব।

মরিয়ম বেগম স্তম্ভিত হয়ে যান। ভাইজান, আপনিতো আমাকে কখনো এসব বলেননি!

: সময় হলে বলব ভেবে রেখেছিলাম।

: তাহলে এখন আমার নয়নের কী হবে?

: নয়নের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। ওর বিবাহের দায়িত্ব আমি নিলাম।

নয়ন এসব কথা শুনে আর এক মিনিট ও সেখানে থাকে না। হুড়মুড় করে ঘর থেকে বের হয়ে দোকানে চলে আসে।

পেছন দিয়ে মামা দোকানে এসে হাজির হন। একটা ফটো নয়নের হাতে দেয়। নয়ন ছবির দিকে তাকায়। মামা বলেন, দেখ মেয়েটা যেমন রূপবতী তেমনি গুণবতী, সবদিক দিয়ে মল্লিকার চেয়ে ঢের ভালো। তোমার মা, আমি তোমার জন্য পছন্দ করেছি। মল্লিকার খালাতো বোন। আজ বিকেলে আমরা সবাই মল্লিকার খালার বাড়িতে যাব, বিয়ের পাকা কথা বলব। তুমি তৈরি হয়ে থেকো।

নয়ন চোখের জল লুকানোর জন্য নিচের দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলে, জি মামা। নয়নের আনুগত্য দেখে খুশি হয়ে মামা চলে যান।

নয়ন মানিব্যাগ বের করে নেয়। মল্লিকার ছবি সরিয়ে ওই মেয়ের ছবি রাখে। দুই হাত দিয়ে চোখের জল মুছে মল্লিকার ছবি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে। নিজে নিজে বলে, বাবা আমি তোমার কথা রেখেছি, আমি মামার অবাধ্য হইনি।
...

নূর নাজমা: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।