সর্বজনীন মানবাধিকার ও ফাঁসির দাবি

আমরা অনেকেই সর্বজনীন মানবাধিকারের বিষয়টি খুব একটা ভালো বুঝি না। বুঝলেও বাস্তব জীবনে তার চর্চা করি না। তাই দেখা যায় সামান্য কিছুতেই আমরা একজন মানুষের ফাঁসির দাবি করে বসি। পান থেকে চুন খসলেই আমরা মানুষের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে বসি। তা ছাড়া আমাদের রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থা দুর্বল এবং সেটা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। তাই বিচার ব্যবস্থার ওপর আমাদের যতটা আস্থা থাকার কথা, ততটা নেই। এই আস্থা না থাকারও হয়তো আমাদের যৌক্তিক কারণ আছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দিন শেষে সবাইকে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার ওপরই আস্থা রাখতে হবে। এই আস্থা না থাকার কারণে বা সর্বজনীন মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি না বোঝার কারণে দেখা যায়, আমরা শাস্তি চাওয়ার বদলে ফাঁসির দাবি করে বসি। অপরাধীদের পক্ষে আইনজীবী না দাঁড়ালে আমরা খুশি হই!

আমরা একজন ধর্ষকের বা একজন খুনির বা একজন যেকোনো অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি চাইতে পারি। এই চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক এবং এটা আমাদের নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। তবে খেয়াল রাখতে হবে সেটা যেন রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে না হয়, যেন কোনোভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে। একজন ধর্ষক বা খুনিকে ‘ক্রসফায়ার’ করাটা যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, ঠিক তেমনি প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার অবমাননাও। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই দুটির কোনোটিই মেনে নেওয়া বা সমর্থন করা উচিত নয়। মনে রাখা জরুরি যে, একটা বেআইনি কাজ দিয়ে কখনোই কোনো সমাজে আইন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এটা বরং উল্টো অপরাধের পথ প্রশস্ত করে।

অবশ্যই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আমাদের সবার আছে। একটা মানুষ যদি দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ মানুষও হয়, তারও সেই অধিকার আছে। আর এটাই হলো সর্বজনীন মানবাধিকার। মানবতায় আস্থা রাখলে এই সর্বজনীন মানবাধিকারের প্রসঙ্গটিকে আমলে নিতে হবে। মনে রাখা দরকার—আমরা কেউই বিচারক নই। তাই আমরা কেউ কোনোভাবেই কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে পারি না। এটা নির্ধারণ করবেন আদালত। একজন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধী নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে তার অপরাধ প্রমাণিত না হয়। একজন মানুষকে শুধুমাত্র সন্দেহ করে বা আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে শাস্তি দেওয়া যায় না। সাক্ষী-প্রমাণ থাকলে আদালতই তার ভিত্তিতে তাকে শাস্তি দেবেন।

সবারই মনে থাকার কথা কিছুদিন আগে সিলেটের এমসি কলেজে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা? ওই যে এক লোক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এমসি কলেজে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এমসি কলেজের ছাত্রলীগের আটজন নেতা তাঁদের দুজনকে ধরে ছাত্রাবাসে নিয়ে প্রথমে মারধর করে। পরে স্বামীকে বেঁধে তাঁর স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে! পরে এই ঘটনায় আটজন আটক হয়। এখন কোনোভাবে যদি এই আটজনের মধ্যে একজন এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকে, আর তার শাস্তি হয়ে যায়, তাহলে তার দায়ভার কে নেবে? মনে রাখা জরুরি একজন অপরাধীর শাস্তি হওয়া যতটুকু জরুরি, তার চেয়েও বেশি জরুরি কোনো নিরপরাধ মানুষ যাতে বিনা দোষে শাস্তি না পায়—সেটা নিশ্চিত করা। এখন যদি বিচারের দায়িত্ব আদালতকে না দিয়ে ওসি প্রদীপের মতো পুলিশ সদস্যকে বা র‍্যাব বাহিনীকে দিয়ে দিই, তাহলে আমরা কীভাবে বুঝব সে অপরাধী ছিল কি, ছিল না? একদিকে ওসি প্রদীপের শাস্তির দাবি করব, আবার রিফাতের হত্যাকারী নয়ন বন্ডের ‘ক্রসফায়ারে’ উল্লাস করব; ব্যাপারটা বেশ দ্বান্দ্বিক হয়ে যায় না?

সর্বজনীন মানবাধিকারের বিষয়টি বুঝলে এবং প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখলে এই ব্যাপারে নিজের অবস্থান পরিষ্কার হওয়া উচিত। আর সেটা হলো—কোন অপরাধীর শাস্তি আদালতের মাধ্যমে যেন নিশ্চিত হয়। তবে অপরাধীর সেই শাস্তিটা যেন সর্বোচ্চ ও দৃষ্টান্তমূলক হয়, সে ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে। কারণ, একটা অপরাধের সঠিক শাস্তি না হলে সমাজে একই রকম অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা যে বা যারাই অপরাধীর শাস্তি আদালতের মাধ্যমে চাই না, যারাই বলি ‘এসব পশুদের প্রতি কোনো রকম দয়ামায়া দেখানো উচিত নয়’, তারা মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল এবং দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সর্বজনীন মানবাধিকারে আস্থাশীল; আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন মানুষ। তাই যেকোনো অপরাধের বিচারের দায়িত্ব আদালতকে দিতে চাই। প্রতিষ্ঠিত প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে ডিঙিয়ে বা বাইপাস করে বিচারের দায়িত্ব পুলিশ বা র‍্যাবকে দিতে আমি রাজি নই। আমি চাই আদালতের মাধ্যমে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হোক। আর আমার এই দাবি করাটা কোনোভাবেই অপরাধীর প্রতি দয়ামায়া দেখানোর মতো বিষয় নয়। একজন অপরাধীর অপরাধ করার পেছনেও কারণ থাকে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ সে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। আর এখানেই একজন অপরাধীর সঙ্গে অন্যদের মৌলিক পার্থক্য। এখন যদি বাকিরা সেই পার্থক্যটা বজায় না রাখে, তাহলে তো অপরাধীর সঙ্গে তার আর কোনো পার্থক্য থাকল না। তাই আসুন সর্বজনীন মানবাধিকার ও প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমরা আস্থাবান হই। এতে সমাজে অপরাধের মাত্রা অনেক কমে যাওয়ার জোর সম্ভাবনা থাকে।