সরকার থেকে দলকে আলাদা রাখতে হবে

বাংলাদেশে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে স্পষ্ট কোনো বিভাজন রেখা নেই। যখন যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে, তখন সেই দল ও সরকার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। জাতি, রাষ্ট্র ও সরকারকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। সরকার পরিবর্তনের পর সবকিছুর মালিক বনে যায় ক্ষমতাসীন দল। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভোগদখলের একচেটিয়া দাবিদার রাজনৈতিক দলগুলো এভাবেই জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছে। ক্ষমতা ধরে রাখতে সরকার রাষ্ট্রের মূল তিনটি স্তম্ভ প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগকে করে তোলে ভারসাম্যহীন। সর্বক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ ঘটায় দলীয়করণের। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দুর্বল করে দিতে কুণ্ঠিত হয় না। ফলে আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব অনুভূত হয় সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। বিস্তার ঘটে লাগামহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারের। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে এসবের সংমিশ্রণে সমাজে এক ধরনের সংকট ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষ করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক দেশ ও জাতিকে অধিকতর সংকটে নিমজ্জিত করতে পারে। সরকার ও জাতীয় সংসদ বহাল রেখে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়লাভের বিষয়টিতে আর যাই হোক, সত্যিকারের আত্মতৃপ্তি লাভের কোনো সুযোগ নেই। এবারের নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব হয়েছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের এক ও অভিন্ন সত্তা এবং কর্মকৌশলের ফলশ্রুতিতে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করেছে মহাজোটের ব্যানারে। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন চতুর্থবারের মতো। দলটির সাধারণ সম্পাদকও চতুর্থবারের মতো শপথ নিয়েছেন মন্ত্রী হিসেবে। অনেক প্রভাবশালী নেতা ছিটকে পড়েছেন মন্ত্রিসভা থেকে। এতে দল ও মহাজোটে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হওয়ায় মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলকে সরকার থেকে পৃথক অবস্থানে রাখতেই এমনটি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর এ মন্তব্য তখনই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োচিত হবে যদি তিনি সরকারের মন্ত্রিত্ব রেখে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদটি ছেড়ে দেন অথবা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বহাল থেকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান, তেমনি প্রধানমন্ত্রিত্ব রেখে শেখ হাসিনা যদি দলীয় সভাপতির পদটি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে কোনো জ্যেষ্ঠ নেতার ওপর অর্পণ করতেন। ‘যিনি হেড মাস্টার তিনিই সেক্রেটারি’ বহুল প্রচলিত প্রবাদটি আমাদের জানা। সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলেও এই রেওয়াজ চলে আসছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এ ধরনের ‘টুইন ওয়ান’ পদ্ধতির অবসান প্রয়োজন।
একজন সরকার প্রধানের পক্ষে একই সময়ে একটি বড় রাজনৈতিক দলের দেখভাল করার এত সময় কোথায়? সাধারণ সম্পাদকের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
এ ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রীকেও দলের দায়িত্বশীল পদ থেকে রেহাই দিতে হবে। সুযোগ করে দিতে হবে অন্য নেতাদের। সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দল বা দলগুলো সরকার পরিচালনার মধ্য দিয়ে অবশ্যই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করবে। কিন্তু মন্ত্রিসভা গঠন করার পর সরকারের দায়বদ্ধতা গোটা দেশ ও জনগণের প্রতি, বিশেষ কোনো দলের কাছে নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সরকার নিজ দলের বাইরে কাউকে কোনো আমলে নেয় না। মন্ত্রীরা রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে দলীয় সভা সমিতিতে অংশ নেন। সারাক্ষণ গালমন্দ করেন বিরোধী দলের নেতাদের। কুৎসা রটান বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে। ভাবটা এমন, বিরোধী দলকে জব্দ করার জন্যই তাদের মন্ত্রীই বানানো হয়েছে।
প্রশাসনিক এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীতি নির্ধারণী সভায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তুলোধুনো করেন স্বয়ং সরকার প্রধান। এ ছাড়া সরকারের মন্ত্রীকে দলীয় মুখপাত্র নিয়োগ করার বিষয়টিও সঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের যেমন মুখপাত্র থাকবে, তেমনি দলীয় মুখপাত্র থাকবে—সরকারে যার কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। নির্ধারিত মুখপাত্র ছাড়া যখন-তখন যেকোনো মন্ত্রী গণমাধ্যমে ফ্রি-স্টাইল মন্তব্য করে জনমনে যেমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, তেমনি বেকায়দায় ফেলে সরকারকে। সরকারি অফিস ও বাসভবন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ন্যূনতম নীতি-নৈতিকতা মানা হয় না। গণভবনসহ সরকারি বিভিন্ন কার্যালয়ে দলীয় সভা সমাবেশ ও আনন্দানুষ্ঠান কোনোভাবেই বৈধতা পেতে পারে না। রাষ্ট্রীয় অর্থে বিশেষ শ্রেণির মানুষকে গণভবনে আপ্যায়ন করা হবে কেন? কারণ জনগণের বিশেষ শ্রেণি এই সুযোগ পেতে পারে না।
সরকারের দায়িত্বশীল আমলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের টেলিভিশন টক-শোতে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে দলীয়করণের বিস্তৃতি ঘটছে। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোতে কর্মরত অনেক কূটনীতিক প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় ইউনিটের সভা সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীরা বিদেশে গিয়ে নিজ দলীয় সভায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করছেন। ফলে প্রবাসীদের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। সরকারের জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করে সব দলমতের মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারকে ভিন্ন অবস্থান ও দলকে দলের জায়গায় রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ব্যক্তির চেয়ে দল, আর দলের চেয়ে বড় দেশ ও জাতি।