সম্ভাবনার নতুন দরজা
অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটির মেরিন বায়োপ্রোডাক্টস ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ওয়েই ঝ্যাং দক্ষিণ কোরিয়ায় আমাদের ল্যাবে ভিজিটে এসেছিলেন। ডিপার্টমেন্টে দেওয়া তাঁর লেকচারের মধ্যে একটি কথা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেছিলেন, ‘খাদ্যপণ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার ও নির্দিষ্ট উপাদান–সংবলিত গুণগত মান ছাড়া পৃথিবীতে কোনো দেশ বা কোম্পানির জন্য খাদ্যপণ্যের বাজার ধরা অসম্ভব। পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া আমরা নিজেরাই জানি না আমাদের চারপাশে এমনকি ফেলে দেওয়া জিনিসের মাঝেও কত দামি কম্পাউন্ড লুকিয়ে আছে।’
উন্নত চাষাবাদ ও উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্যবিজ্ঞানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ বিশ্বের খাদ্যবাজারে বাংলাদেশকে অন্যতম প্রভাবশালী করে তুলতে পারে। প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত ভান্ডার আমাদের বাংলাদেশ। প্রয়োজন শুধু প্রায়োগিক গবেষণা আর মার্কেটিং।
মাছ ও চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের পর ফেলে দেওয়া অংশ যাকে আমরা বাই প্রোডাক্টস বলে থাকি, যেমন চামড়া, আঁশ, কাঁটা ও খোলস থেকে আমরা কী ধরনের বায়ো–অ্যাকটিভ কম্পাউন্ডস পেতে পারি, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। কয়েকটি দেশ এসব ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে অতি দামি প্রোডাক্টস যেমন ওমেগা-৩ সম্পন্ন অনেক দামি তেল, জিলেটিন, কোলাজেন, এস্টাজেন্থিনদ, কাইটিন, কাইটোসানসহ অন্য বায়ো–অ্যাকটিভ মেটেরিয়াল বের করে নিজেরা ব্যবহারের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করছে।
অন্যদিকে আমাদের চিংড়ি প্রসেসিং খাতে প্রতিবছর কমপক্ষে ৩০ হাজার টন চিংড়ির খোলস বাই প্রোডাক্টস হিসেবে উৎপন্ন হচ্ছে। আমাদের প্রযুক্তিজ্ঞানের অভাবে এসব বাই প্রোডাক্টস সর্বোচ্চ হাঁস–মুরগির খামারে ব্যবহৃত হচ্ছে। না হলে সরাসরি সার হিসেবে জমিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে অথবা সরাসরি নদীতে ফেলে দিয়ে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটানো হচ্ছে। অথচ এসব বাই প্রোডাক্টস দেশকে এনে দিতে পারত কোটি কোটি ডলার।
মজার ব্যাপার হলো, দক্ষিণ কোরিয়া আমাদের চেয়ে মাছ উৎপাদনে অনেক পিছিয়ে থাকলেও প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকায় মাছের আঁশ ও চামড়া থেকে প্রাপ্ত জিলেটিন ও কোলাজেন আমাদের মতো দেশে বিক্রি করে কোটি ডলার উপার্জন করছে।
অপ্রচলিত মৎস্যজাত পণ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ উপার্জন করতে পারে কোটি কোটি টাকা। সঙ্গে রয়েছে প্রকৃতি প্রদত্ত বিশাল এক সমুদ্র এলাকা। সম্প্রতি সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এর জীববৈচিত্র্য জানার পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা যাচাইয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ট্রপিক্যাল আবহাওয়ার জন্য আমাদের সমুদ্র হতে পারে সি-উইড উৎপাদনের এক অন্যতম এলাকা। সাধারণ সি-উইডের পাশাপাশি, বিভিন্ন সি-উইড থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রোডাক্টস হতে পারে দেশের মানুষের নিউট্রিশনে অবদান রাখার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম হাতিয়ার।
একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম জাতি গঠনে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। এক সেমিনারে গিয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। এ দেশে এসে মোটামুটি সব প্রকারের ফলের জুস খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেদিনের জুসটি ছিল ভিন্ন। ননি ফলের জুস! যা বাংলাদেশে আমরা বন্য ফল বলে ফিরেও তাকাই না।
স্পেসিফিকেশন দেখে অবাক হলাম। ফলগুলো ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা আর এই ফল নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ পড়াশোনা করতে গিয়ে অবাক হলাম। এই ফল তো পুষ্টির আধার। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি–এর পাশাপাশি এই ফলে রয়েছে অনেক অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট–সংবলিত ফেনোলিক কম্পাউন্ড। সমস্যা একটাই, পাকা অবস্থায় এই ফলের গন্ধ ভালো নয়। কিন্তু প্রসেসিংয়ের পর এটি হয়ে উঠেছে বহুমূল্য জুস।
দিনে দিনে বৈশ্বিক খাদ্যবাজারে টেকনোলজি এক অপরিহার্য জায়গা দখল করেছে। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে আমাদের কৃষকের সঙ্গে খাদ্যপ্রযুক্তিবিদদের সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। ফসলের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের বাজারে বাংলাদেশকে যোগ্য করে উপস্থাপনের জন্য কৃষিকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গণ্য করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। উর্বর জমি, পরিশ্রমী কৃষক, অনুকূল আবহাওয়া সবই আমাদের আছে। প্রয়োজন শুধু পরিকল্পনা, প্রণোদনা ও গবেষণার।
বিকাশ রায়: খাদ্যবিজ্ঞানে পিএইচডি গবেষক, বুসান, দক্ষিণ কোরিয়া।