সভ্যতার জননী আফ্রিকা
সভ্যতার জননী আফ্রিকা, সেটা আমাদের অনেকেরই জানার কথা। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার সূতিকাগার হচ্ছে মিশর। সুপ্রাচীনকাল থেকেই নীল নদ মিসরের জীবনযাত্রায় মূল ভূমিকা পালন করে আসছে। নীল নদের অববাহিকায় উর্বর সমতল চাষযোগ্য ভূমি এই অঞ্চলের অধিবাসীদের স্থায়ী কৃষি কাজ ও সেই সঙ্গে অর্থনীতির গোড়াপত্তনের পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীভূত সমাজ গঠনে সাহায্য করে। যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বহু বছর আগে থেকেই এই অঞ্চলে মানুষ বসবাস শুরু হয়েছিল। পরবর্তী যখন উত্তর আফ্রিকার শুষ্ক জলবায়ু আরও উষ্ণ ও শুষ্ক হতে শুরু করে তখন এই অঞ্চলের মানুষেরা নীল নদ উপত্যকায় ঘন জনবসতি গড়ে তুলতে বাধ্য হয়। উত্তর আফ্রিকার এই অঞ্চলে ছিল অফুরন্ত গবাদি-পশু ও জলজ পাখির অবাধ বিচরণ। প্রকৃতির এই উদারতাই মিসরীয় সভ্যতা বিকাশের প্রধান সহায়ক। এটা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল। আর সেই কারণে খাদ্য আহরণে তাদের আর আগের মতো সময় ব্যয় করতে হতো না। এই সুযোগে তারা তাদের মেধা বিকাশের নানা মাধ্যম খুঁজে বের করে। তারা দক্ষতা অর্জন করে কাপড় বোনা আর মাটির পাত্র তৈরিতে। এর পর হাতিয়ার তৈরিতে পাথরের বদলে শুরু করেছিল বিভিন্ন খনিজ দ্রব্যের ব্যবহার যেমন ব্রোঞ্জ, পরবর্তীতে তামা ও আরও মূল্যবান খনিজ দ্রব্য। এটা তাদের সভ্যতার উন্নয়নে রেখেছিল এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান।
প্রাচীন মিসরীয় হস্তলিপি অর্থাৎ হায়েরোগ্লিফিক মিসরীয় সভ্যতার আরেকটি মাইলফলক।খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার দু শ সালের দিকে প্রাচীন মিসরীয়রা সাত শতাধিক চিহ্ন দিয়ে উদ্ভাবন করেছিল ছবির মাধ্যমে লেখা বর্ণমালা বা হস্তলিপি। যা হায়েরোগ্লিফিক নামে পরিচিত। পৃথিবীর প্রাচীনতম এই বর্ণমালা যা আজও বিশ্বের এক বিস্ময়। নীলনদের তীরে জন্মানো এক রকম নলখাগড়া দিয়ে তৈরি কাগজ প্যাপিরাস ছাড়াও মাটির পাত্র ও বিভিন্ন পাথরে খোদাই করে লেখা হতো এই হস্তলিপি।
প্রাচীন মিশরে প্রথম ও উল্লেখযোগ্য রাজাদের মধ্যে রাজা মেনেস ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন প্রথম রাজবংশের প্রথম রাজা। তিনিই উত্তর ও দক্ষিণ দু ভাগে বিভক্ত মিসরকে একত্র করে মেমফীসে তার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার সময়ে মিসরের সমাজ ব্যবস্থাকে উন্নত ও সুসংগঠিত করার জন্য পুরো দেশটিকে প্রায় চল্লিশটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। প্রশাসনিক ভাবে বিভক্ত এই ভাগগুলোকে বলা হতো নোমোস। নোমোসের শাসনকর্তাদের বলা হতো নোমার্ক। মিসরীয় কৃষকেরা তাদের উৎপন্ন ফসলের নির্ধারিত অংশ রাজাকে কর হিসেবে দিত। সে সময় মিসরীয় রাজাদের বেশির ভাগ চিন্তা ধারাই ছিল পরলৌকিক জগৎকে কেন্দ্র করে। মৃত্যুর পরও তাদের দেহ যেন অবিকৃত থাকে এবং অক্ষত অবস্থায় যেন মৃত্যুর দেবতার সামনে উপস্থিত থাকতে পারে, সেই ভাবনার ফলশ্রুতিতেই তারা তাদের শবদেহকে সংরক্ষণ করত। যা মমি নামে পরিচিত। তাদের সমাধি সৌধগুলোই হলো পিরামিড।
বনে বনে শিকারের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো আফ্রিকানরাই কালের প্রয়োজনে শুরু করে কৃষিকাজ সেই সঙ্গে শুরু হয় অর্থনৈতিক গোড়াপত্তন। তৈরি করে আত্মরক্ষার হাতিয়ার ও প্রতিরক্ষা বাহিনী। উদ্ভাবন করে হস্তলিপি, কাগজ ও শিক্ষার উপকরণ। সংঘবদ্ধ ভাবে বাস করতে গিয়ে গড়ে তোলে সমাজ থেকে রাষ্ট্র। আর ধীরে ধীরে গড়ে উঠে এই সভ্যতা। সমসাময়িক প্রাচীন মেসোপোটেমিয়া, ভারত ও চীনা সভ্যতার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মিসরীয় এই সভ্যতা।
আফ্রিকান সভ্যতার সুবিশাল ইতিহাসকে মাত্র কয়েকটি লাইনে উপস্থাপন করা নিশ্চয়ই একটি ঔদ্ধত্যপূর্ণ কাজ। আর আমাদের মাননীয় সাংসদের বোধযোগ্য সহজ ও সাবলীল ভাষায় অতি সংক্ষেপে উপস্থাপনের বৃথা চেষ্টা মাত্র। তিনি সাধারণ কোনো নাগরিক নন। একটি দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যের মতো গুরু দায়িত্বে নিয়োজিত।
তিনি রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে এসে যখন সংসদের মিডিয়া সেন্টারে বসে বর্ণবাদী মন্তব্য করেন তখন সেটা আর তার নিজস্ব বক্তব্য থাকে না। তার সকল দায় রাষ্ট্রের ঘাড়ে বর্তায়। আমি জানি না আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে এটা কতটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেই সভ্য দেশে সাগর-রুনির বিচার হয় না, যেই সভ্য দেশে ত্বকি-রাজনদের নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়, যেই সভ্য দেশ অভিজিৎ-অনন্তকে কুপিয়ে মারে, যেই সভ্য দেশে বৈশাখী উৎসবে মাকে সন্তানের সামনে বিবস্ত্র করে,-সেই সভ্য দেশের সভ্য জনপ্রতিনিধির মুখের কথার যে কোনো বিচার হবে না সেটা আমরা ভালো করেই জানি। এমনকি তার বক্তব্যকে ব্যাকরণ শুদ্ধ করার জন্য দলীয় ভাবে নানা যুক্তি প্রদর্শন করা হবে সেটাও আমরা বুঝি। তবুও আফ্রিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। বিদেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি প্রেরণে এবং তা নির্বাচনে আরও বেশি সচেতন হওয়ার জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি।