সফিকুল হক চৌধুরী: আমার স্যার

কলম্বিয়ায় সফিকুল হক চৌধুরীর সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

তিনি ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান আশার প্রতিষ্ঠাতা। সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে তিনি ‘সামাজিক প্রগতি সংস্থা’ বা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট’ (আশা) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে সফিকুল হক চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত এই আশাকে বিশ্বদরবারে নিতেও সক্ষম হয়েছিলেন।

অতিশয় স্মার্ট ও সুদর্শন মানুষ ছিলেন সফিকুল চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। কিন্তু চলনেবলনে আবার ছিলেন অতিশয় সাধারণ। বিশেষ কোনো ডিগ্রি ছিল না তাঁর, কিন্তু সাধারণ-দরিদ্র মানুষের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা থাকায় আমৃত্যু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।

আমি ১৯৯১ সালে ইউনিট সুপারভাইজার পদে যখন আশায় প্রতিষ্ঠানে যোগ দিই, তখন দেশে এর ইউনিটের সংখ্যা ছিল সম্ভবত ৫৪। ইউনিটের স্থলে ব্রাঞ্চ পদবি ধারণ করে আশা বর্তমানে গ্রাম-গ্রামান্তরে বিস্তৃত। আশা এখন আর শুধু বাংলাদেশের গ্রামান্তরে বিস্তৃত হয়েই ক্ষান্ত নেই, বরং এশিয়া ও আফ্রিকার ১৩টি দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে বিস্তৃত হয়ে আছে।

সফিকুল হক চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

মানুষ আশাকে মন থেকে স্মরণ করে, প্রার্থনা করে। দেশের মানুষের পক্ষে, সরকারের পক্ষে আশার বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এ আশাকে দেখে আসছি, সফিকুল চৌধুরীকে দেখেছি। তাঁর কথার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বাড়ন্তের এমন সমন্বয় দেখেছি, যা অধিকাংশ মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই আজকাল দেখা যায় না। আমাদের মতো অনেক সাধারণ গুণ-মানের মানুষকে তিনি বিভিন্নভাবে সম্মানিত করেছেন। আমরা হাজারো উপকারভোগী আজ সমাজ-সংসারে সম্মানের সঙ্গে দিনাতিপাত করছি একমাত্র তাঁর কারণে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের কারণে।

১৯৯৯ সালে আশা ইউএনডিপি-এমএসপি প্রজেক্টের অধীন ফিলিপাইন ও নাইজেরিয়াতে কাজ করার সময় ফিলিপাইন টিমের একজন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাই। পরে বিভিন্ন দেশে কাজ করার সুযোগ হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আরও কাছে আসার, তাঁর নেতৃত্ব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমরা যারা দেশের বাইরে আশার হয়ে কাজ করেছি বা করছি, তাদের প্রতি ওনার যে সহযোগিতা বা প্রেরণা পেয়েছি, নমনীয় মনোভাব দেখেছি, তা এককথায় অসাধারণ। তিনি আমাদের সীমাবদ্ধতা বুঝতেন এবং সেভাবেই নিরন্তরভাবে পরামর্শ দিতেন। এ কারণেই আমাদের অনেকের মতো সাধারণ মানের কর্মীও অসাধারণ সব কাজ করতে সক্ষম হয়েছি বা চলমানভাবে হচ্ছি।

সফিকুল চৌধুরীসহ আমরা বিশটি পরিবার ২০০৬ সাল থেকে শ্যামলী এলাকায় একই ভবনে বাস করে আসছি। তিনি অবশ্যই গুলশান-বারিধারা বা অন্য কোনো বিশেষ এলাকায় বাস করতে পারতেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি অন্যত্র যেতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে বাস করতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন এবং আমৃত্যু তা–ই করেছেন।

কর্মক্ষেত্রে সফিকুল চৌধুরী যেমন তাঁর অধীন কর্মীদের ভালোমন্দ দেখেছেন, ঠিক তেমনি আবাসিকে বাস করা অন্য সবার জন্যও ছিল তাঁর তেমনি মমতা, ভালোবাসা। কারও কোনো অসুখ-বিসুখ বা সমস্যার কথা তাঁর কানে এসেছে আর তিনি তা এড়িয়ে গেছেন, এমন কোনো নজির কখনোই চোখে পড়েনি। যেকোনো সমস্যা অকপটে তাঁর নজরে আনা যেত, কি অফিশিয়াল, কি ব্যক্তিগত। হয়তোবা অনেক কিছুই তৎক্ষণাৎ বিবেচিত হতো না, কিন্তু কোন এক সময় ঠিকই কোনো না কোনোভাবে বিবেচনা করতেন।

২০০৮ সাল। আমি তখন পশ্চিম আফ্রিকার ঘানাতে আশা ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছি। এক কোরবানি ঈদে কেন জানি মনে হলো একটা গরু চেয়ে আবেদন পাঠালে কেমন হয়। যেই মনে আসা, সেই কাজ। অর্থাৎ আবেদন করে ফেলা হলো। শুনেছিলাম তিনি আমার আবেদন পেয়ে খুব হেসেছিলেন। অবশ্য আবেদন পাঠানোর পরে আমি নিজেও হেসেছিলাম, কারণ এমন আবেদন কেউ করতে পারে কখনো?

লাখো জনের ভালোবাসার মানুষ, প্রেরণার মানুষ আজ আমাদের মধ্যে নেই। গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, লখো শুভাকাঙ্ক্ষীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে অন্তিমযাত্রায় রয়েছেন। আল্লাহ আমার স্যারকে বেহেশতের শ্রেষ্ঠতম প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করুন, এ প্রার্থনা করছি।