সফল হতে করতে মানা
জীবনে সফল হতে কে না চায়? কিন্তু সফলতার পথে খুব কম ব্যক্তিই চলে বা চলার চেষ্টা করে। আবার অনেকে প্রবল ইচ্ছা ও পরিশ্রমের পরও সফলতার মুখ দেখতে পায় না। স্বাভাবিকভাবেই তারা হতাশ হয়। নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। অনেকে আবার নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতে শুরু করে। আসলে সাফল্যে ভাগ্যের প্রভাব খুব কম থাকে। সাফল্যের রহস্য পরিশ্রমের মধ্যে নিহিত। লটারি জেতা আর সফল হওয়া ভিন্ন বিষয়। কখনো কি শুনেছেন, কোনো ব্যক্তি লটারিতে জিতে সফল এক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে? যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, লটারিতে অর্থ পেয়ে অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়। সে যাক, অনেককে আবার দেখা যায় সব থাকার পরও কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দেখা পাচ্ছে না। তাহলে জীবনে সফলতা লাভের রহস্য কী? আজ সফলতার রহস্যের কথা না বলে অসফলতার রহস্য নিয়ে আলোচনা করব। সফলতা পেতে হলে কী কী করা যাবে না, তা নিয়ে কিছু কথা বলছি।
অতিরিক্ত ঘুমানো যাবে না—সফল ব্যক্তিরা প্রয়োজনের বেশি ঘুমায় না। স্বাস্থ্যবিদদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য দৈনিক সাত-আট ঘণ্টার ঘুমই যথেষ্ট। তাহলে নিজেকে প্রশ্ন করুন। আপনি দৈনিক কত ঘণ্টা ঘুমান? অনেকে বলেন, ‘আমি দৈনিক দশ ঘণ্টা ঘুমাই। তারপরও মাঝেমধ্যে অনেক ক্লান্ত লাগে। তাই আবার ঘুমিয়ে পড়ি।’
অনেকে রাতে ঘুমের পর দিনে অন্তত একবার ‘বিশ্রাম’ নেন। যারা শরীরের প্রয়োজনের মাত্রাতিরিক্ত ঘুমায়, তাদের ক্লান্তি অনুভব হওয়া স্বাভাবিক। অসময়ে বিশ্রাম নিলেও শরীর ক্লান্ত হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে—আপনি যত বেশি ঘুমাবেন আত্মোন্নতির জন্য তত সময় হারাবেন। দৈনিক আপনি দুই ঘণ্টা বেশি ঘুমালে, মাস শেষে তা ষাট ঘণ্টায় পরিণত হয়। তার মানে আপনি প্রতি মাসে প্রায় তিনটি দিন ঘুমিয়ে কাটালেন, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। মানুষের জীবনে ঘুমের আবশ্যকতা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সুস্থ থাকতে পর্যাপ্ত ঘুমানো উচিত। কিন্তু অতিরিক্ত ঘুম ক্ষতিকর। এতে শরীর ও মন দুই-ই খারাপ হতে পারে। খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প নিশ্চয় আপনার জানা আছে। মাত্রাতিরিক্ত না ঘুমালে খরগোশ সফল হতে পারত। কিন্তু সেটা সে করেনি। ফলে খরগোশের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কচ্ছপের বিজয় হয়।
হাতঘড়িবিহীন জীবনযাপন করা যাবে না—জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো একমাত্র আমাদের হাতের ঘড়িই মনে করিয়ে দেয়। যাদের হাতে ঘড়ি সব সময় থাকে না, তারা কোনো দিন সফল হতে পারে না। আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে ঘড়ি আবিষ্কারে আগে মানুষ কীভাবে সফল হয়েছিল? তখনকার মানুষ সূর্যের গতিবিধি বুঝে দিনের সময় নির্ধারণ করত। আপনি যদি তা পারেন, তাহলে আপনারও হাতঘড়ির প্রয়োজন নেই। তবে সমস্যা আছে।
আগের দিনের মানুষেরা দিনের বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে কাটাত। তাই তাদের জন্য সূর্যের গতিবিধি বোঝা সহজ হতো। কিন্তু বর্তমান যুগে অধিকাংশ মানুষ দালানের ভেতরে কাটায়। ফলে সূর্যের গতিবিধি বোঝা তাদের পক্ষে মুশকিল। তাই হাতে ঘড়ি থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঘড়ি থাকলেই চলবে না। আপনার দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রতিটি কক্ষে দেয়ালঘড়ি থাকা উচিত, যাতে সময়ের সঙ্গে আপনার বারবার সাক্ষাৎ হয়। এতে সময়ের অপচয় হবে না। সময়ের অপচয়ের চেয়ে বড় অপরাধ আর নেই। এর শাস্তি সারা জীবন ভোগ করতে হয়। সফল মানুষেরা সময়ের সঠিক ব্যবহার করেন। দিনের প্রতিটি ঘণ্টা তাঁরা পরিকল্পনা করে ব্যয় করেন।
সাফল্যের অতিরিক্ত উদ্যাপন করবেন না—সাফল্য পাওয়া অনেক কষ্টের। তাই কোনো কিছুতে সাফল্য পাওয়ার পর অনেকে তা উদ্যাপনের পেছনে প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করেন। সাফল্যের কোনো সীমানা নেই। উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে এর সীমা টানা হয়। সাফল্যের মই ওপরে ওঠার জন্য। উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে নিজের মধ্যে আত্মতুষ্টি আসতে পারে। সাফল্যের দালান বহুতলবিশিষ্ট। জীবনের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা) পূরণ করতে পারলে আমরা এর পাঁচতলায় উঠতে পারি। অনেকেই এই পাঁচতলায় বসবাস করে। জীবন উপভোগের নামে বৃথা সময় ব্যয় করে। তারা হয়তো ভাবে, ‘আমার এই জীবনে আর কি চাই? আমার তো সবই আছে?’ আসলেই কি সব আছে? এত আগে থেমে গেলে সাফল্যের সুউচ্চ সিঁড়ি বেয়ে ওঠা দুষ্কর হবে।
মানুষের জীবন ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার মতো। যে দৌড়তে থাকবে, তার সাফল্য একদিন আসবেই। তাই কালক্ষেপণ না করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সঠিকভাবে ব্যয় করা উচিত। তবে বিনোদনেরও প্রয়োজন আছে। তা না হলে জীবনে একঘেয়েমি চলে আসবে, মন অবসাদগ্রস্ত হবে। শরীরের যেমন প্রতিদিন ঘুমের প্রয়োজন, তেমনি মনেরও বিনোদন প্রয়োজন। সফল হতে হলে মানসিকভাবে চাঙা থাকতে হবে।
অতীত বা পেছনে ফিরে তাকাবেন না—মানুষ স্মৃতিকাতর। অতীতকে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকতে পছন্দ করি। এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার বর্তমানে অতীতের মাত্রাতিরিক্ত স্থান কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়। সে অতীত যত সুখেরই হোক না কেন। একজন চালক যখন গাড়ি চালায়, মাঝেমধ্যে তাকে রিয়ারভিউ মিররে তাকাতে হয়।
কিন্তু রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়েই শুধু গাড়ি চালানো যায় না; দুর্ঘটনা হবে। চালকের বেশির ভাগ সময় সামনের দিকে তাকিয়ে এগোতে হয়; এটাই নিয়ম। অতীতকে একেবারে ভুলে গেলে চলবে না। কারণ, এতে পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা কমবে। তবে অতীতের ভুলের কথা বারবার স্মরণ করে বর্তমানকে কলুষিত করা ভবিষ্যতের জন্য অপরাধের শামিল। অনুশোচনা করে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। বর্তমানের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। বর্তমানে কীভাবে ভালো করতে হবে, সে বিষয়ে কাজ করে যেতে হবে।
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবেন না—মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। সবার জীবনে নানা স্বপ্ন থাকে। স্বপ্নের পথটিও হয়তো জানা। কিন্তু সব জানা সত্ত্বেও অনেকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে অনেক ভয় কাজ করে। এই ভয় অসফলতার ভয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত যে, কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার চেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক হিতকর। আপনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে জীবনে এগোতে পারবেন না। সিদ্ধান্ত ভুল হলে সে ভুল থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবেন, যা ভবিষ্যতে অনেক কাজে আসবে। তাই বলে জেনেশুনে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না।
কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সে বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা নেওয়া উচিত। সে বিষয়ের ভালো ও মন্দ দিকগুলোর বিশ্লেষণ করা উচিত। যথার্থ বিশ্লেষণের পর সিদ্ধান্ত নিন। সংসারে এমন কোনো সিদ্ধান্তই নেই, যা থেকে আপনি শতভাগ উপকৃত হতে পারেন। আপনি যে সিদ্ধান্তই নেন না কেন, তাতে আপনার বা আপনার আশপাশের মানুষের কিছু না কিছু ক্ষতির কারণ হতে পারে। সব সিদ্ধান্তেই কিছু না কিছু খারাপ দিক থাকে। তাই বলে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাওয়া উচিত না।
কাউকে বিশ্বাস করবেন না—সফল ব্যক্তিরা সবসময় তাদের নিজেকে ও তাদের কর্মকে বেশি বিশ্বাস করে। মানুষ মানেই দোষ ও গুণে পরিপূর্ণ এবং দিন শেষে সবাই আপনার বিশ্বাসের প্রতি মর্যাদা রাখতে পারবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। মানুষ স্বভাবতই একে অন্যের ভালো দেখতে পারে না। সফল ব্যক্তির ক্ষতি করতে চাওয়া লোকের সংখ্যা কম নয়। এমন পরিস্থিতিতে মনে কষ্ট পাবেন। একে গুরুত্ব দেবেন না। নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাস রেখে কাজ করে যান। সাফল্যের পথ নিঃসঙ্গতার পথ। এ পথে সবসময় সবার সমর্থন পাওয়া যায় না। কিন্তু নিজের কাজের প্রতি আস্থাবান হলে সফলতা একদিন আপনার হাতে এসে ধরা দেবে। তার মানে এই নয় যে, আপনি অন্যের সহযোগিতা ছাড়াই সফলতা পাবেন। সফলতা পেতে আপনার অন্যের সহযোগিতা দরকার। কিন্তু তাদের সহযোগিতার প্রতি আপনার পূর্ণ নির্ভরতা থাকলে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সফল না হওয়ার প্রস্তুতি নিন—সফল ব্যক্তিরা সফলতার পথে হাঁটার সময় সফল না হওয়ার প্রস্তুতিও নেন। সব কাজে বা সব সিদ্ধান্তে মানুষ সফল হয় না। বরং অসফল হওয়ার আশঙ্কাই থাকে প্রবল। অনেকেই দুই বা ততোধিকবার কোনো কাজে অসফল হলে চেষ্টা বন্ধ করে দেয়। মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারে না। সে জন্য শুরুতেই ব্যর্থতা নিয়ে ভাবা উচিত। এতে আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবেন এবং ভবিষ্যতে সফলতার পথে হাঁটার শক্তি পাবেন।