সন্তানের ব্যর্থতার দায়ভার কি বাবা-মায়ের?

প্রখর গ্রীষ্মের উত্তপ্ত এক সকালে ফ্রান্সের ভার্সাই প্যালেসের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি সপরিবারে। তাপমাত্রা ৩২ বা ৩৩ ডিগ্রির কাছাকাছি। বিশাল খোলা চত্বরে এক ফোঁটা ছায়া নাই। মাথার ওপরে ঝকঝকে নীল আকাশ। লাইনে যারা দাঁড়িয়ে আছেন বেশির ভাগই টুরিস্ট, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন। লাইনটা একটা বিশাল সাপের মতো এঁকেবেঁকে আছে অজস্র বাঁক নিয়ে। বেশির ভাগ দর্শনার্থীদের হাতে ছাতা রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্য। রোদের তাপে পুড়ছি আর মনে মনে নিজের বোকামিতে বিরক্ত হচ্ছি। আমরা কেউ ছাতা আনিনি। বাচ্চাদের জন্য মায়া লাগল। দেড় ঘণ্টা ধরে সবাই মিলে এই গরমে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। ওদের দূরে এক কোনায় একটু ছায়া দেখে বসিয়ে আমি আর ওদের বাবা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।
লাইন থেকে প্রাসাদটাকে মনে হচ্ছে সোনায় মোড়া। বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম দূর থেকেই। সেলফিও তোলা শেষ। মনে মনে ভাবছি কে জানে ভেতরে কী আছে? টিকিটের দাম অনেক বেশি। তার চেয়েও বড় কথা এই রোদে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা সার্থক হতে হলে সেরকম আশাতীত কিছুই থাকা দরকার। দাঁড়িয়ে থাকার একঘেয়েমি দূর করার জন্য লাইনের অন্যান্য মানুষকে খেয়াল করতে শুরু করলাম। এক বেলজিয়ান ভদ্রলোকের সঙ্গে কোরীয় এক মেয়ে। ভদ্রলোকের অনেক বয়স, মেয়েটা বেশ অল্প বয়সী, উপরন্তু ইংরেজি ভালো বলতে পারে না। মনে মনে ওদেরকে নিয়ে এক দফা গল্প সাজালাম। আসলে এদের সম্পর্কটা কী? একটু আলাপ জমাতেই বুঝলাম, এরা প্রেমিক–প্রেমিকা। দুজন দুই মহাদেশে থাকে, কালেভদ্রে দেখা হয়। কত বিচিত্র প্রেমই যে হয় জগতে। এর পরে কানে গেল ইংরেজি কথা। এক জোড়া বয়স্ক নারী কথা বলছেন স্কুল সিস্টেম নিয়ে। বোঝা গেল দুজনই স্কুল শিক্ষিকা। আমেরিকা থেকে এসেছেন, আমেরিকান স্কুলের ভালো মন্দ নিয়ে তর্ক–বিতর্ক চলছে। সাধারণত, বিদেশের মাটিতে নিজের দেশ বলতে সব সময় বাংলাদেশের কথাই মনে হয়। নিজের ভাষা বলতে বাংলাকেই মনে হয়। ভুলেও কোনো দিন আমেরিকাকে নিজের কিছু মনে হয় নাই। কিন্তু এই প্রথম বেশ কিছুদিন অস্ট্রেলিয়া আর ইউরোপে কাটিয়ে হঠাৎ করে কেন যেন নিজের আবাসভূমিকেও বেশ আপন আপন মনে হচ্ছিল। আমেরিকান দেখে মনে হলো এরা তো ঘরের কাছের আপন মানুষ। বয়স্ক মানুষ, তার মানে হয়তো কোনো গ্রুপের সঙ্গে এসেছেন। দুই বৃদ্ধা নিজেদের নিয়েই দারুণ ব্যস্ত। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই।
চোখে পড়ল তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন হাসিখুশি আরেক বৃদ্ধা। মনে হলো একই গ্রুপের। আমি তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। আমার মায়ের বয়সী নারী। দীর্ঘদিন ক্যালিফোর্নিয়ায় ছিলেন, তার মানে আমার আরও আপন। তাঁর মায়ের দিকের আত্মীয়স্বজন আছেন ফ্রান্সে। প্রতি দুই বছরে তিনি একবার আসেন এখানে। প্রাসাদের ভেতরে কী কী দর্শনীয় বললেন। তার কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলাম যে, কষ্টটা বৃথা যাবে না আশা করি। এ কথা সে কথার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার ছেলেমেয়ে কজন? ‘আগে চারজন ছিল, এখন তিন।’ আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। কোনো মায়ের মুখে মৃত সন্তানের গল্প শোনা খুব কষ্টের। কিন্তু এর পরের গল্পটা আরও করুন। তাঁর বড় মেয়ে, যে বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ঠিক আমার সমান, সে কয়েক বছর আগে মারা গেছে। মেয়ে অন্য শহরে থাকত। মেয়ে ও মেয়ের স্বামী দুজনই অতিরিক্ত মদ্যপান করত। মা–বাবা বাকি পরিবার দূরে থাকায় কেউ কোনো দিন ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। মদ্যপান থেকেই কলহের শুরু, তারপরে ডিভোর্স। ডিভোর্স এ দেশে খুব সাধারণ ঘটনা। মা–বাবা খুব বেশি নাক গলাতে পারেন না, তাদের সেই অধিকার দেওয়া হয় না। তারপরেও তিনি মেয়েকে সাহায্য করতে চেয়েছেন। তখনই তিনি মেয়ের বদ অভ্যাসের কথাটা জানতে পারেন। তত দিনে অনেক দেরি গেছে। মেয়ের লিভারে পচন ধরেছে। এই দেশের সেরা ডাক্তারেরাও আর কিছু করতে পারেননি।

বৃদ্ধা নারী তার বড় সন্তানকে অকালে হারিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, সন্তান হারানোর কষ্ট, অনেক বড় একটা কষ্ট। আমি বুঝি, আমিও মা। আমি আমার মায়ের মেয়ে, বড় মেয়ে। ঠিক ওই নারীর মেয়েটির মতো। আমাকে ছাড়া আমার মায়ের পৃথিবী কল্পনা করা অসম্ভব। সবকিছু ছাপিয়ে আমার বাঙালি মন অবাক হচ্ছিল যে, একজন অপরিচিত মানুষকে ওই নারী অবলীলাক্রমে তাঁর মেয়ের মদ্যপানে মৃত্যুর মতো একটা স্পর্শকাতর ঘটনার কথা খোলাখুলি বলছেন। আমরা বাঙালিরা সন্তানের সমস্ত সাফল্য বিশেষ করে ব্যর্থতার দায়ভার চাপাই তাদের বাবা–মায়ের ওপর। একজন মানুষ উঁচুতে উঠলেও যেমন বলি অমুকের ছেলে বা মেয়ে এত ভালো, খারাপ কিছু করলে তো আর কথাই নাই। মদ্যপান, ড্রাগস, পরীক্ষায় ফেল, ঘুষখোর, চরিত্র খারাপ থেকে জঙ্গিবাদ, নারীঘটিত সমস্যা, পালিয়ে বিয়ে, বেকার সবকিছুর ব্যর্থতা বাবা–মায়ের। এমনকি মেয়ের বিয়ে হয় না, ছেলের ডিভোর্স হয়েছে, ছেলে–মেয়ের সংসারে নাতি–নাতনিগুলো বেয়ারা, ছেলের বউ মুখরা, মেয়ের জামাই বেয়াদব সেই ব্যর্থতাও বাবা–মায়ের।
প্রতিটা বাবা মা–ই সন্তানের মঙ্গল চান। নিজের মতো করে চেষ্টা করেন ছেলেমেয়ের জীবন গড়ে দিতে। কিন্তু শুধু তাদের চেষ্টাই সবকিছুর জন্য যথেষ্ট না। প্রতিটা মানুষের নিজের জীবনের দায়ভার মূলত তার। বাবা–মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তারপরেও যার জীবন তারই। বিশেষ করে একটা বয়সের পরে সন্তানের ওপরে বাবা–মায়ের অধিকার বা আধিপত্য কতটুকুই বা থাকে? তাই সন্তানের সাফল্য বা ব্যর্থতা দিয়ে নয়, বাবা–মার জীবনের সাফল্যকে মাপুন তার ব্যর্থতা বা সাফল্য দিয়ে। না হলে তাদের ওপরে বিরাট অবিচার হয়, তাদের হাতে যে জিনিস নেই, সে জিনিসের দোষও তাদের ঘাড়ে পড়তে পারে। যে বাবা–মায়ের সন্তান কোনো কারণে পিছিয়ে যায়, ভুল করে, ভুল পথে হাঁটে তাদের এমনিতেই অনেক মন কষ্ট। তাদের আঙুল তুলে সেই কষ্ট আরও বাড়িয়ে না দিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের দুঃখের কথা ভাগ করে নিতে দিন। তাহলে আমাদের, আপনাদের আরও অনেক বাবা–মায়ের মন থেকে অনেক বোঝাই নেমে যাবে। তারাও একদিন আমেরিকান ওই নারীর মতো মন খুলে কাউকে তাঁর ড্রাগে আসক্ত সন্তান, ফেল করা সন্তান, বেকার সন্তানের কথা বলতে পারবে। এই সব কথা লুকিয়ে রাখার বোঝা বড় একটা বোঝা।