সন্তান দূরে চলে গেলে

মায়ের সঙ্গে লেখক

প্রবাদ আছে—অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর। জীবনের প্রয়োজনে মাকে ছেড়ে সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে যেদিন তাঁর বুক খালি করে পৃথিবীর অপর প্রান্তে চলে আসি, সেদিন মা বিমানবন্দরে লোহার গেটের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে, শুষ্ক চোখে আমার চলে যাওয়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। কতটা শোকে মানুষের অনুভূতি পাথর হয়ে যায়, কতটা কান্না লুকালে চোখ শুষ্ক হয়ে যায়, আমার মেয়েটা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে ডর্মে যাওয়ার পর তা বুঝতে পেরেছি।

অনেক বছর আগে মায়ের সেদিনের শুষ্ক চোখের জ্বালা আমি আজ উপলব্ধি করছি। ফোন করলেই মা বলতেন, ‘কেন যে তোরা বড় হলি? বড় হয়ে সবাই দূরে চলে গেছিস আমারে একা করে। ছোটবেলায় ছোট্ট ঘরটিতে তোরা আমার বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকতি। এখন এত বড় দালানে আমি একা, ভীষণ একা। তোর বাবাও নাই। কত দিন হয়ে গেছে ঘরের সামনের দরজা খোলা হয় না। এত বড় ঘরের পেছনের দরজায় একা একা আমার দিন কেটে যায়। খুব নিঃসঙ্গ লাগে রে মা।’

মেয়েটার শূন্য ঘরের দিকে তাকিয়ে মধ্যরাতের গাঢ় অন্ধকারে আমার মায়ের কথাগুলো অনর্গল কানে বেজে যাচ্ছে।

মেয়েকে ডর্মে রেখে ঘরে ফিরে আসার পর থেকে বুকের গহিনে সামুদ্রিক ঝড় বয়ে যায়। বাইরের ঝড় দেখা যায়, ভেতরের ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেলেও দেখা যায় না। সারাক্ষণ পায়ে-পায়ে জড়িয়ে থাকা মেয়েকে ছাড়া ভীষণ একা লাগে, অস্থির লাগে। এদিক-ওদিক কিছু সময় উদ্দেশ্যহীন পায়চারি শেষে আয়নার সামনে বসি। আয়নার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। গোরস্থানের নিস্তব্ধতা বইছে বুকে। আয়নায় মুখ দেখছি না, দেখছি আত্মাকে। নির্জনতায় ডুবে থাকা আমি আধো আলো-আধো অন্ধকারে আয়নায় আচমকা অস্পষ্ট মায়ের মুখ দেখতে পাই! দেখছি, মা একটা বৃত্ত আঁকছেন। বৃত্তের কেন্দ্রস্থলে মা। হঠাৎ দেখি, মা ধীরে ধীরে কেন্দ্র থেকে সরে যাচ্ছেন দূরে।

বৃত্তের কেন্দ্রে এবার আমাকে দেখতে পাই। বৃত্তের কেন্দ্র থেকে এবার মায়ের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাই, মা হাসছেন। আমি আনন্দিত হই মায়ের মুখ দেখে। মায়ের হাসিমুখের বিচ্ছুরণে অন্ধকার কেটে জ্বলজ্বল করছে চারপাশ। কত দিন পর মাকে দেখছি। আমি সব ভুলে শুধু মাকে দেখছি প্রাণভরে। মায়ের হাসিমুখ ক্রমশ মলিন হয়ে আসে। মা দুই হাত বাড়িয়ে করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মায়ের চোখজোড়া এতটাই করুণ, একবার তাকিয়ে দ্বিতীয়বার তাকানোর আর সাহস পেলাম না। কষ্টে মাথা নিচু করে দুই হাত দিয়ে আমি নিজের চোখ ঢেকে রাখি। চোখ খুলে আয়নায় আর মাকে দেখতে পাই না। হন্যে হয়ে মাকে খুঁজতে থাকি। এরই মধ্যে শুনতে পাই, মা আমাকে নাম ধরে ডাকছেন বুকে জড়িয়ে আদর করবেন বলে। মায়ের আওয়াজ শুনছি কিন্তু মাকে স্পর্শ করতে পাচ্ছি না। মায়ের গায়ের ঘ্রাণ পাচ্ছি কিন্তু মাকে দেখছি না।

মেয়ের সঙ্গে লেখক

মা যে বছর গত হলেন, সে বছর ছোট ভাই নিউইয়র্ক থেকে দেশে গেছে তাঁর সঙ্গে ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপনের জন্য। ছোট ভাই দেশে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর শবে কদরের রাতে মা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমার প্রতি মায়ের সর্বশেষ আকুতি মেশানো অনুরোধ ছিল, ‘সাজুর (ছোট ভাই) সঙ্গে তুইও দেশে আয়। আমাকে দেখে যা। কত দিন তুই বুকে আসছ না রে মা। কত দিন তোরে দেখি না। তোরে খুব দেখতে মন চাইছে। একবার দেশে এসে ঘুরে যা। তোর জন্য মন কাঁদে, বুক পোড়ে।’

সেবার মায়ের এমন মমতা মাখানো ডাকেও সাড়া দিয়ে তাঁর বুকে যেতে পারিনি। কথা দিয়েছিলাম, পরের বছর যাব। মা তার আগেই আমাকে ফেলে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

মনটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভেঙেচুরে পরবাসী বাতাসে কর্পূরের মতো মিলে যায়। বোবা আমি চুপচাপ বসে পড়ি বিছানায়। শরীর কাঁপছে থরথর করে বুঝতে পারি। গলা শুকিয়ে আছে, ডাইনিং টেবিলে গিয়ে পানি খাওয়ার শক্তি পাচ্ছি না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে দেখে ইনহেলার নিয়ে আরাম কেদারায় বারান্দায় গিয়ে বসি মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার জন্য। মনের বারান্দায় তখন মায়ের জীবন সায়াহ্নে আমাকে বলা কথাগুলো ঝড় তুলে যাচ্ছে একের পর এক। নিজেকে বড় অপরাধী লাগছে।

আমি বুঝতে পারি, আমার মায়ের জায়গায় বৃত্তের কেন্দ্রে এখন আমি। আমি যেভাবে মাকে ছেড়ে বহুদূর চলে এসেছি। আমার মেয়েও আমাকে ছেড়ে এভাবে একদিন জীবনের দরকারে হয়তো আরও দূরে চলে যাবে। ভাবছি কোন আগুনের তাপ বেশি? বাইরের নাকি ভেতরের? শুধু বুঝি, বাইরের আগুন দেখা যায়, বুকের আগুন দেখা যায় না।

ধীরে ধীরে মায়ের পথে হাঁটছি। প্রকৃতি সময় মতো সব হিসেব-নিকেশ বুঝিয়ে দেয়। সময়ও নির্বাক নয় সবাক, সময় কথা বলে সময়মতো। সময়ের কাছে মানুষ অসহায় এক প্রাণী। জীবনের এত গল্প, এত হাসি, এত সময়, এত প্রত্যাশা, এত আড্ডা, এত খুনসুটি, এত আনন্দ, এত প্রতিশ্রুতি, এত ভালোবাসাবাসি—দিন শেষে সব মানুষ নিজের মাঝে একা, ভীষণ একা।