সত্যেন্দ্রনাথ বোস - এক বাঙালি নক্ষত্র

তরুণ সত্যেন্দ্রনাথ বোস
তরুণ সত্যেন্দ্রনাথ বোস

সত‍্যেন্দ্রনাথ বোস ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান। জাত মেধাবী। জন্মেছিলেন সৃষ্টি-জ্ঞান নিয়ে। তরুণ সত‍্যেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন ফিজিকস পড়াতে। প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক হলেন। সে সময়ে ইন্টারনেট ছিল না। উন্নত টেলিযোগাযোগ ছিল না। কিন্তু জ্ঞানই যার ক্ষুধা, তাঁকে রুধে কে! সত‍্যেন্দ্রনাথ শত বছর আগে ঢাকায় বসে, সেকালের গবেষণার খবর রাখতেন। সে সময়ের মহানায়কেরা হলেন ম্যাক্স প্লাংক, ম্যাক্স বর্ন, হাইজেনবার্গ, নীলস বোর, আইনস্টাইন, স্রোডিঙ্গার প্রমুখ। তারা নিউটনীয় ক্লাসিক‍্যাল যুগ থেকে বেরিয়ে এসে, কুড়ি শতকের শুরুতে বিজ্ঞানে এক বিপ্লব ঘটালেন। সেই বিপ্লবের হাওয়া দূর দক্ষিণের তরুণ সত‍্যেন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে গেল। তার কোনো আনুষ্ঠানিক পিএইচডি ডিগ্রি ছিল না। তিনি ইউরোপ-আমেরিকা থেকে গবেষণার দীক্ষা নিয়ে বিলেতফেরত কোনো যুবক নন। তবে তিনি যে শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন তারা সেকালে ভারতবর্ষের মহীরূহ—স্যার জগদীশ চন্দ্র ও আচার্য প্রফুল্ল রায় প্রমুখ।

যা হোক, সত্যেন বোস ঢাকায় বসে কাজ করছেন। নিরন্তর ভেবে যাচ্ছেন। গবেষণা করছেন বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের বিকিরণ তত্ত্ব (Plank’s Radiation Formula) নিয়ে। তার গবেষণাকর্ম তিনি আর্টিকেল রূপে লিখলেন। প্রকাশের জন্য প্রস্তুত তিনি। কিন্তু এই দূরপ্রান্তের বোসকে তো কেউ চেনে না! তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই কোনো বড় বড় বিজ্ঞানীর। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। বিনয়ী ভাষায় চিঠি পাঠালেন খোদ আইনস্টাইনকে। সঙ্গে পাঠালেন তাঁর গবেষণা কর্ম। আইনস্টাইন তখন পৃথিবী খ্যাত বিজ্ঞানী। তুমুল জনপ্রিয়তা তাঁর। কিন্তু তরুণ সত্যেন এসব কিছুই তোয়াক্কা করলেন না। আইনস্টাইনকে অনুরোধ করলেন, তার কাজ যদি প্রকাশের যোগ্য হয় তাহলে যেন জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়। সত্যেন বোসের সাহস ও আত্মবিশ্বাসের কথা ভেবে, আমি এখনো চমকে উঠি। শিহরিত হই।

জার্মান ভাষায় প্রকাশিত সত্যেন বোসের আর্টিকেলের প্রচ্ছদ
জার্মান ভাষায় প্রকাশিত সত্যেন বোসের আর্টিকেলের প্রচ্ছদ

আইনস্টাইন তার চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। সত্যেন বোসের কাজ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছিল Zeitschrift für Physik নামক জার্মানির খ‍্যাতনামা জার্নালে। সময়টা ১৯২৪ সালের আগস্ট মাস। বোসের বয়স তখন মাত্র ত্রিশ। তাঁকে চিনতে শুরু করল ইউরোপের শ্রেষ্ঠতম মেধাবীরা। বোস সুযোগ পেলেন ইউরোপ ভ্রমণের। ইউরোপ যাওয়ার আগে আইনস্টাইন হাতে লিখে একটি পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন তাঁকে। বোস সেই পোস্টকার্ড দেখিয়েছিলেন জার্মান দূতাবাসে। তাঁর কাছ থেকে ভিসা ফি নেওয়া হয়নি। তাঁকে ভিসা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সত্যেন বোস সেই পোস্টকার্ডকে পাসপোর্টের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বার্লিন যাওয়ার আগে প‍্যারিসে বিজ্ঞানী মারি কুরির ল্যাবে তিনি কাজ করেছিলেন ছয় মাস।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে লেখা সত্যেন বোসের চিঠি
বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে লেখা সত্যেন বোসের চিঠি

ইউরোপে তিনি কাজ করার ও সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন অনেকের সঙ্গে। সেসব মানুষেরা হলেন লুই ডি ব্রগলি, মারি কুরি, আলবার্ট আইনস্টাইন, ফ্রিৎজ হাবার, অটো হান, লিসা মাইটনার। তাঁরা পৃথিবীর ইতিহাসের চিরস্থায়ী নক্ষত্র। দুই বছর অবস্থান শেষে ১৯২৬ সালে বোস ফিরে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকায় ফিরে আবেদন করলেন প্রফেসরশিপের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তখন স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন প্রফেসর হওয়া যেত না। সত্যেন বোসের মতো মেধাবীর প্রফেসরশিপ অনিশ্চিত হয়ে রইল। বোস তখন আইনস্টাইনের শরণাপন্ন হলেন। বোসের পক্ষ হয়ে হার্টগের কাছে রিকোমেন্ডেশন লেটার পাঠালেন খোদ আইনস্টাইন। হার্টগ ছিলেন পণ্ডিত লোক। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী যার পক্ষ নিয়েছেন, হার্টগ তার বিপক্ষে যেতে পারেন না। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়াই সত্যেন বোস অধ্যাপক হলেন। ফিজিকস ডিপার্টমেন্টের প্রধানের দায়িত্ব পেলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। সত্যেন বোসের দীপ্তি ছড়িয়ে গেল বাঙলায় ও ভারতবর্ষে। ভারত সরকার তাঁকে সেদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননাসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। বোসকে দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় বহু দায়িত্ব। ভারতের বিজ্ঞান প্রসারে সত্যেন বোসের নাম অগ্রগণ্য।
সত্যেন বোস বেঁচে ছিলেন আশি বছর। জীবনভর বিজ্ঞানের প্রচার, প্রসার ও উন্নতির জন্য কাজ করেছেন। ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি জন্মেছিলেন কলকাতায়। সে হিসেবে এ বছর তার ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের মহাকাশে এক বাঙালি নক্ষত্র। যার নাম জড়িয়ে আছে খোদ আইনস্টাইনের সঙ্গে। উচ্চতর বিজ্ঞানে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটেসটিকস বা বোস-আইনস্টাইন ডিস্ট্রিবিউশন পরিচিত। বিজ্ঞানী বোসের নামে দেওয়া হয়েছে পরমাণুর বোসন কণার নাম। এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জগদীশ বোস, জ্ঞান ঘোষ, মেঘনাদ সাহাসহ অন্যদের সঙ্গে সত্যেন বোস (পেছনে বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
জগদীশ বোস, জ্ঞান ঘোষ, মেঘনাদ সাহাসহ অন্যদের সঙ্গে সত্যেন বোস (পেছনে বাঁ থেকে দ্বিতীয়)


একটি প্রদীপ থেকে অন্য প্রদীপ জ্বলে ওঠে। আলো পায়। দীপ্তি ছড়ায়। বোসের দীপ্তি ছড়িয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা এই বাংলায়ও। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। এই দীপ্তি ক্ষীণ হতে থাকে ধীরে ধীরে। এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারিনি আমরা। কালে কালে আলোর দখল চলে যায় নষ্টদের হাতে। আমাদের লাল-নীল দীপাবলিগুলো নিভে গেলেও, রয়ে গেছে লাল-নীল দল! সত্যেন বোস ও অন্যান্যদের আলোকপ্রভা থেকে ধারাবাহিকভাবে সেরকম আলোকিত শিক্ষক খুব বেশি আসেনি আর। এক শ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক হওয়া যেত না, তবে এক শ বছর পর সেটা আজ সম্ভব!
পৃথিবীর এক শজন মেধাবীর জীবনী যদি আপনি পড়েন, তাহলে দেখবেন, নব্বই জনই সেরকম আলোকিত শিক্ষক পেয়েছেন। দীপ্তিমান শিক্ষকদের অন্বেষণে বুঁদ হয়ে থাকে যে সমাজ, সেটাই উন্নত। তেমন অন্বেষণে আমাদের প্রচেষ্টা কতটুকু? আমরা কী সেই দীপ্তির ধারাবাহিকতা ফিরিয়ে আনতে পারব? যে দীপ্তি ছড়িয়েছেন সত্যেন বোস ও অন‍্যান‍্যরা।

ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>; ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>