
মেসেঞ্জারে স্কুলবালিকাদের হুলস্থুল আড্ডা। বিশেষ করে বিকেলে বা রাত এগারোটা-বারোটা বাজলে জমে উঠে আড্ডা, মেসেঞ্জারই যেন তাদের জীবন। এসব স্কুলবালিকারা আসলে আর বালিকা নয়, জীবনের একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সবাই। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে বাস করে; কিন্তু এখন তাদের একটাই ঘর, এই মেসেঞ্জার। কয়েক দিন ধরে তাদের ঘর-সংসারে কোনো মন নেই, সব মনোযোগ স্কুলে। জীবনের মধ্যবয়সটা যেন কর্পূরের মতো কখন উড়ে গেছে, তারা এখন সেই শৈশব, কৈশোর বা তারুণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্মৃতির জানালা যেন হঠাৎ করে খুলে গেছে। কেউ নার্সারির গল্পে মত্ত, তো কেউ কৈশোরের, তারপর চলছে হই-হুল্লোড়, শুধু হাসির ইমোটিকন, আমি যেন ঝরনার মতো সবার হাসির কলরব শুনতে পাচ্ছি। অযথা হাসির কারণে স্কুলজীবনে শাস্তি পায়নি এমন মেয়ে খুব কম আছে। আহারে জীবন! তোকে যদি একবার পেছনে নেওয়া যেতো!
অনেক অনেক দিন আগের কথা, সিলেট শহরের সবচেয়ে নামকরা সিলেট সরকারি অগ্রগামী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়েকিছু বালিকা পড়াশোনা করত। যখন সিলেটের সব স্কুলে সাপ্তাহিক একদিন ছুটি থাকত, তখন এই একটি মাত্র স্কুল ছিল যা শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকত। সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে আজও স্কুলটি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে, শুধু নেই তারা। সিলেট পাঁচ পীর সাহেবের মাজার সংলগ্ন স্কুলটি কাউকে মনে রাখছে না, প্রতি বছর নবযৌবনা হয়ে উঠেছে নূতন শিক্ষার্থীর আগমনে। তারপর যা হওয়ার তাই হলো, সবাই স্কুল পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলো। দু দুটি বছর পাশাপাশি কলেজে থাকলেও এল ছড়িয়ে পড়ার পালা। কারও এসএসসি দিতে-না-দিতেই বিয়ের সানাই বেজে উঠল এবং বাজতেই থাকল, খুব ঘনিষ্ঠ কাছাকাছি ছাড়া বাকি সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।
আজ বহু বছর পর তাদের একত্র করার মহান দায়িত্ব পালন করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের প্রিয় ফেসবুক। কিন্তু ফেস তো আর চেনা যায় না, বালিকাদের সবারই সময়ে পরিবর্তন ঘটেছে। কেউ মুটিয়ে গেছে, কেউবা রয়ে গেছে শুকনা, কিন্তু চেনার উপায় নেই! তার মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকের চেহারার তেমন পরিবর্তন আসেনি, তাদের মধ্যে বোধ করি এ্যানি অন্যতম।
একদিন লন্ডনের মোনা একটা গ্রুপ তৈরি করে দাওয়াত দিতেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। দুই মাস ধরে এভাবে চলছে আড্ডা। সবারই প্রায় এক সংলাপ, এই আমাকে চিনতে পারছিস? আমি...ওমুক...তোকে তো চিনতে পারছি না! তোর পাশে এটা কে? ওহ আচ্ছা তুই? একেবারেই বদলে গেছিস, চিনতেই পারছি না।
‘হ্যাপী তুই গলায় ধরে আছিস যে ও স্যারের মেয়ে জুবলী না?’
‘নারে মনে হয় না’
‘আচ্ছা ছবিটা আয়শাকে পাঠাই; জুবলী হলে সে বলতে পারবে’।
মাকসুরা, ‘এইটা মনে হয় মিমি দত্ত’।
হ্যাপী, ‘নারে মাকছুরা সম্ভবত মিমিও না।’
‘আর মিমি তো গ্রুপে আছে। দেখা যাক সে কি বলে, ব্রেইন স্টর্মিং করতে থাক।’ এভাবে চলছে পাজল খেলা ।
এই কুইজের অবতারণা নিয়মিত হচ্ছে, তারপর একজন আরেকজনকে চিনিয়ে দিচ্ছে,
‘এই আমি ওই যে ওয়াসীমা, সবাই সীমা নামে চিনে।’
‘হ্যাঁ, আমি মাকসুরাদের সঙ্গে থাকতাম।’ অনেকেই গ্রুপ ছবি পোস্ট করেছে, আরে পুকুর পাড়ের ছবি-
‘মনে আছে আমরা পুকুর পাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম’, দূর থেকে বিলকিস আপা বলে উঠেছিলেন, ‘এই মেয়েরা তোমাদের ক্লাস নেই?’
আসলে ধর্মশিক্ষা ক্লাসের শিক্ষক আসেননি, তাই সে সুযোগে বের হয়েছিলাম ক্লাস থেকে। সেই পুকুর পাড়, বাঁধানো ঘাট, মুখটা বাড়িয়ে উঁকি দিলেই কিশোরীর নিজের মুখ। কোথায় সে দিন? টিফিনে এক টাকার ঝাল চানাচুর। সাদা স্কুল ইউনিফরম, দুই বেণি করা চুল, কচি কচি চেহারার মেয়েগুলো বহু বছর পর এক সঙ্গে হয়েছে। কত গল্প জমা, শেষ হয় না। বৃষ্টির পানি, ক্লাসে শিক্ষিকা না এলে গলা ছেড়ে গান বা খাতার কাগজ ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া। শ্রেণিকক্ষ থেকে বারান্দা—এসব দৌড়-ঝাঁপ দেখে, পাশের ক্লাসের আপার চিৎকার, ‘এই মেয়েরা, এখনই প্রধান শিক্ষিকার কাছে বিচার দিচ্ছি, তোমাদের জন্য ক্লাস নিতে পারছি না।’ আহ কী মধুর স্মৃতি! আজ আপাদের বকাও আনন্দের মনে হচ্ছে, অথচ কত-না কি নাম দিয়েছি শিক্ষকদের মেজাজ-মর্জি বিচার করে। কে কী হাস্যকর কাণ্ড করত, তা বলেই হাসির ঝড়!
আমার মনে আছে, পান্না আপা সেভেনের ক্লাসে এসে পেলেন আমি ডেস্কে বসে শিস দিচ্ছি, প্রথমে একটু রাগ দেখালেও নিমেষে হাসি দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের বলেই কী হবে, নাইন-টেনের মেয়েরাই এসব করে।’ আমি খুব লজ্জা পেলাম। উনি হাসার পাত্রী নয়, কড়া শিক্ষিকা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আমার সঙ্গে একটু খাতির ছিল, কারণ আমার বাংলা নোটগুলো ওনার খুব পছন্দ এবং এগুলো উনি ওনার একই ক্লাসের ক্যাডেট স্কুলে পড়ুয়া ছেলের জন্য নিতেন। এটা একমাত্র নেলী জানত, তাই ও আমাকে খুব পচাতো। বলত, ‘এ জন্য তো আপা তোকে খাতির করে, তুই গ্রামার ভুল করলে বুঝিয়ে দেয় আর আমাদের বকে।’
স্কুলে সবার একটা নিজস্ব বন্ধু গ্রুপ ছিল, কেউ কেউ পড়াশোনায় ভালো তাদের একটা গ্রুপ, কেউবা গান বাজনা, খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত—তাদের একটা গ্রুপ। কিন্তু জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সব মিলেমিশে একাকার।
প্রথম দফায় কয়েকজন মিলে স্পাইসি রেস্তোরাঁয় গিয়ে একটা মিলন মেলা করে এসেছে। সেখানেও শুধু স্মৃতি রোমন্থন। এর-ওর বাসায় একত্রিত হচ্ছে, আমরা যারা বিদেশে মনে মনেই যেন সারাক্ষণ তাদের সঙ্গে আছি। যাদের সঙ্গে কথা হয়নি কখনো, এখন তারাও সরব। হুসনা বলছিল, বোঝা গেল আমরা এখন যথেষ্ট ম্যাচিউরড হয়েছি। সে আগে যে রকম মজার কথা বলত, এখনো বলে—সবাই হাসতে বাধ্য। ও এখনো মজা করেই কথা বলে। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় ওদের ছেলেমেয়ে অনেক বড় এখন।
ছোট্টবেলার স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গে সবার সুখ-দুঃখ অল্পবিস্তর শোনা হলো, জীবনে পূর্ণতা যেমন আছে, অপূর্ণতার স্বাদও কম নয়। কারও বা স্বামী খুব ভালো কিন্তু ঘর আলোকিত করার মত প্রদীপই জুটল না। বিধাতাও যেন মাঝে মাঝে কার্পণ্য করতে ছাড়েন না। কারওবা শরীর ঠিকমতো চলছে না, অসুখ-বিসুখ স্পর্শ করেই আছে। একজনকে বলছিলাম, নিজের যত্ন কর। বলে আরে জীবন থেকে হতাশাই যায় না, যত্ন করব কি? বেঁচে আছি এই ভালো। অথচ স্বামী সংসার সবই তো ঠিক আছে। আমি আর বলতে পারি না, ‘সখী ব্যথাটা কোথায়?’ দুজনের স্বামী অকালে চলেও গেছেন। এমনি সুখ-দুঃখ আমাদের স্পর্শ করে আছে।
এখনো অনেকের সঙ্গে দেখা হয়নি। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম এই সেদিন। এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। নিশু আর ওর স্বামীর ছবি পোস্ট করেছে একজন, ভাবলাম ভালো নাম নিশুর।
মেসেজ দিলাম,
‘Hey Nishu how are you, This is ....’
সে বলল, আমি তো নিশু না উর্মি ।
Oh Sorry Dear.
It’s ok.
‘দুর্ভাগ্যবশত আমি তোকে এখনো চিনতে পারিনি’। সেও না।
আমরা চিনতে না পারলেও খুব আন্তরিকতা নিয়ে কথা বললাম, ওর মা-বাবা ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন। কথা প্রসঙ্গে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ঈশায়ার আব্বু কী করেন? বললাম এবং ভদ্রতা করে পাল্টা প্রশ্ন করলাম। বলল, ওর স্বামী আর্মির কর্নেল ছিল কিন্তু বেঁচে নেই। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ, উনি পিলখানার দুঃখজনক ঘটনায় নিহত হন। কষ্ট আগে পেয়েছি, কিন্তু কথাটা যেন ভেতরে কোথাও তীব্র আঘাত করেছে। হঠাৎ মৃত্যুগুলো মেনে নেওয়া কষ্টকরের চেয়েও বেশি কিছু। ওকে দেখতে আমার চেয়েও অনেক কম বয়স মনে হয়, ছেলে দুটি বড় হয়ে গেছে বেশ। না বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।
আমাদের চ্যাটিংয়ে আরও কিছুক্ষণ কথা হলো,
একটা সময় বলল, ‘খুব একাকি লাগে সেলিনা, নয়টা বছর ধরে একা।’
ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখের গ্লাস ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমি ওকে অনেক কিছু বোঝালাম, অনেকের স্বামী কাছে থাকার পরও পাশে নেই, কত অত্যাচার! জীবন বড় অদ্ভুত যেখানে ভালোবাসা আছে, সেখানে কাছে নেই, যেখানে কাছে আছে, সেখানে ভালোবাসা নেই। তবু বললাম, দেখ ছেলেরা ভালো পজিশনে চলে গেছে, ওরা বুঝবে। তুই পছন্দ করে একটা বিয়ে কর। বিদেশে এ বয়সে অনেকে জীবন শুরু করে। যদিও এসব আমার মুখে মানায় না।
বলল, ‘ভয় পাই জীবন অন্য রকম হবে, সেটা চিন্তা করিনি।’
হ্যাঁ, ভয়! হারানোর ভয় একবার ঢুকে গেলে তা থেকে বের হওয়া যায় না। সেটা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। আমি ওকে শুধু বলতে পারিনি, ‘নিঃসঙ্গতার তুই কী দেখেছিস? আমি দেখেছি প্রহরের পর প্রহর, বছরের পর বছর প্রতীক্ষা, তোর নয় বছর। আর কিছুদিন পার হলেই আমার হবে নিঃসঙ্গতার ২৭ বছর। যাকে জীবনে শুধু স্বপ্নের মতো পেয়েছি, যার সঙ্গে কোনো খারাপ স্মৃতি নেই, যাকে আমি ভালো মানুষ বললেও পৃথিবী একবাক্যে প্রতারক বলে। নিজের প্রিয় মানুষটিকে না পাওয়া, হারিয়ে ফেলা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর, নাকি এখন এই পৃথিবীতে সে আছে—এটাই সান্ত্বনা? আমি চাইলেই আমার ভালোবাসা জীবিত রাখতে পারি। আশায় থাকতে পারি, চেনা পথে কভু দেখা হয়ে যাবে। শারমিন পারে না। আমি কাছে আসতে গিয়ে কবে বহু দূর চলে গেছি, আবার দূরে যেতে গিয়েও পারিনি। ভাগ্য আবার এক শহরে এনে দাঁড় করিয়েছে। আমি যেন কিছু ভাবতে পারছিলাম না, কার জন্য? ঊর্মির না নিজের জন্য সারা দিন মনটা খারাপ হয়েই রইল, আমি ওকে ভেবে ভেবে বারবার শুনেছি রবি ঠাকুরের গান —
‘সখী, ভাবনা কাহারে হলে
যাতনা, কাহারে বলে....’।
যে মেয়ে নিমিষে আমার ভেতরে ঢুকে গেছে, তাকে মনেই করতে পারছিলাম না। তার নামে ঊর্মি, যেন সাগরের এক ঢেউ এসে আমার সব তছনছ করে চলে গেছে। অবশেষে হঠাৎ মনে হলো চোখটা পরিচিত। হালকা-পাতলা গড়নের একহারা চেহারা। ওকে বললাম, তারপর ওর টাইম লাইনে গিয়ে খুঁজে ছবি বের করলাম, হ্যাঁ এর সঙ্গে মাঝেমধ্যে গল্প হতো। আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ছাড়াও অনেকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল, ও সে রকম একজন। উর্মিদের দেওয়ার মতো সান্ত্বনা আসলে কারও কাছে নেই। পৃথিবীতে ভালোবাসার মতো মানুষের অভাব নেই। কিন্তু তুমি যাকে ভালোবাসো সে মানুষ কই পাই?