সংগীত চর্চায় সাধনা থাকতে হয়

ফাতেমা তুজ জোহরা
ফাতেমা তুজ জোহরা

জাতীয় কবি নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার বোধকে বাঙালিদের মননে আরও বেশি জাগরুক করার লক্ষ্যে শুদ্ধ নজরুল সংগীত চর্চায় যে কয়জন নজরুল সংগীত শিল্পী নিজেদের নীরবে সম্পৃক্ত রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে শিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা অন্যতম। জয়পুরহাট জেলা সদরের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবারের সন্তান এই শিল্পী। বাবা ডা. সাইদ ফরিদ উদ্দীন নিজেও রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন। মা ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং রুচিশীল নারী, যিনি রত্নগর্ভা মায়ের খেতাব পান।
মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা বললেন, মা হালকা রঙের সুতি শাড়ি পরতেন। শাড়ি সব সময় পরিপাটি ও ইস্ত্রি করা থাকত। প্রতিটি সন্তানের প্রতি থাকত কড়া নজরদারি। পড়াশোনার প্রতি মায়ের দুর্বলতা ছিল ভীষণ। মেয়ে ফাতেমা তুজ জোহরার সঙ্গে একত্রে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে দুটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ফাতেমাতুজ জোহরার নজরুল সংগীতের প্রতি বোধ ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয় বাবার সাংস্কৃতিক চর্চার প্রতি মমত্ববোধ দেখে। তিনি বলেন, বাবার আগ্রহেই তিনি আজ প্রতিষ্ঠিত নজরুল সংগীতশিল্পী। পাশাপাশি আরও যাঁদের স্মরণ করলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ওস্তাদ হাবিবুর রহমান, জমিদার তনয় নগেন ঘোষ ও রফিকুল আলম। ফাতেমা তুজ জোহরা ১৯৬৩ সালে হাবীবুর রহমান সাথীর কাছে সংগীতচর্চা শুরু করেন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তাঁর কাছে সংগীতের তালিম চলে। পরে মিথুন দে’র কাছেও সংগীতের তালিম নেন।
গান শেখা প্রসঙ্গে এই গুণী শিল্পী বলেন, ‘আমার বাবা বা আমার গুরুরা, ওস্তাদ হাবীবুর রহমান, নগেন ঘোষ ও রফিকুল আলম—কেউ আমাকে বলেননি যে বড় শিল্পী হতে হবে। বরং তাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন, কীভাবে সঠিকভাবে গান করতে হয়।’
শৈশব থেকে ফাতেমা তুজ জোহরা বেড়ে ওঠেন একটি উচ্চমানের সাংস্কৃতিক আবহে, সাংস্কৃতিক পরিবেশে যা তাঁকে বাংলাদেশের সংগীত জগতে নিজেকে একজন আত্মবিশ্বাসী ও গুণী শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে অপরিমেয় সহায়তা করেছে। ছোটবেলায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বয়সভিত্তিক সংগীত প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত ফাতেমা তুজ জোহরা সমাজের অনাচার-অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন সদা সোচ্চার। শিল্পী এই স্বভাব পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। আলাপচারিতার একপর্যায়ে তিনি বললেন, মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। তিনি পুরো পরিবারের সব সদস্যের চাওয়া-পাওয়ার বিষয় খুবই ভালো বুঝতেন। মজার ব্যাপার হলো, কোনো হইচই না করে এই চাওয়া-পাওয়ার সবটাই তিনি নিজেই সমাধা করতেন। এমনকি আপন মেয়ের করা নোটের সাহায্যে মা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেন নিঃশব্দে।
১৯৯২ সালে ফাতেমা তুজ জোহরার প্রথম কবিতার বই ‘যেখানে ভালোর বাস’ প্রকাশ করেন। তিনি নিয়মিত শব্দ ঘর সাময়িকীতে কলাম লিখতেন। পরে সেই কলামের সংকলনসহ কয়েকটি গল্প নিয়ে ‘কিছু কথা’ প্রকাশিত হয়। তিনি ছড়ার ওপর দুটি বই ‘তাল বাহারি ছড়া’ ও ‘ছড়ায় গড়ে বোল’ প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক একটি উপন্যাসও তিনি লেখেন। ২০১৭ সালে অমর একুশে মেলায় নজরুলগীতির ওপর তাঁর রচনা ‘গীত ও সুরের ভিন্ন ঊর্মিমালায়’ নামের নজরুল সংগীত বিষয়ক বই প্রকাশিত হয়। অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় বইটি।
নজরুলের গানে ফাতেমা তুজ জোহরা তাঁর আত্মিক সম্পৃক্ততার কথা বলতে গিয়ে বলেন, নজরুলের জীবনী পড়লে মানবতাবোধ বৃদ্ধি পাবে। সমাজে একা একা ভালো হয়ে চললে হবে না। সমাজবদ্ধ হয়ে সবাইকে নিয়েই চলতে হবে। কবি নজরুল উদার মুসলিম ছিলেন। তিনি সব সময় অন্য ধর্ম এবং ধর্মাবলম্বীকে সম্মান করতেন। নজরুলকে পড়লে সামাজিক চেতনা, মূল্যবোধ, রাজনৈতিক চেতনা, ধর্মীয় চেতনার বিকাশ ঘটবে। মানবতাবোধ জাগ্রত হবে।
নজরুল সংগীত চর্চার পাশাপাশি ফাতেমা তুজ জোহরা প্রায় ১১টি নাটকে অভিনয়ও করেছেন। এর শুরু ১৯৮৪ সালে। খ ম হারুনের পরিচালনায় ‘লাগুক দোলা’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর নাট্য জগতে অভিষেক হয়। ঠিক তেমনি গানের শুরুটা হয়েছিল আরও অনেক আগে ১৯৭৫ সালে রংপুর বেতার কেন্দ্র থেকে। এর ঠিক দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনে নজরুল গীতি পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু করেন আরেক পর্ব। তারপর থেকে আজ প্রায় ৪৩ বছর ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে নিয়মিত নজরুল সংগীত ও আধুনিক গান পরিবেশন করে চলছেন এই বরেণ্য শিল্পী।
এই যাবৎকাল সংগীত জগতে সফল পদচারণার স্বীকৃতি হিসাবে মোট ১০টি সম্মাননা লাভ করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ছিল সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৬ সালে একুশে পদক এবং ২০১৫ সালে পান বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ। এ ছাড়া আরও যে সব সম্মাননা পান তার মধ্যে রয়েছে, প্রেসক্লাব পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কার, থিয়েটার সম্মাননা, শেরে বাংলা স্মৃতি পুরস্কার, স্বাধীনতা ফোরাম সম্মাননা, লন্ডন থেকে শুদ্ধ মঞ্চ পুরস্কার, ব্রিটিশ কলম্বিয়া সম্মাননা পুরস্কার ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার।
চার দশকের বেশি সময় ধরে সংগীত জগতের সঙ্গে নিজের এই সম্পৃক্ততার স্বীকৃতি আর সম্মাননা প্রাপ্তির পর এই মুহূর্তে নিজের অনুভূতি কী? এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘আমি তৃপ্ত, ভীষণ তৃপ্ত। কারও ওপর আমার কোনো অভিযোগ যেমন নেই, তেমনি নেই কোনো কাল্পনিক অনুযোগ। তবে হ্যাঁ, বর্তমানের ইউটিউব নির্ভর এবং মার-মার, কাট-কাট টাইপের গানের আগ্রাসন বৃদ্ধি রোধে এই প্রজন্মের শিল্পীদের দায়িত্ব নিতে হবে। সস্তা ও অশালীন কথা সংবলিত গানের জোয়ারে ভেসে যাওয়া চলবে না।
শুদ্ধ সংগীতের প্রসারে শিল্পীদের আরও বেশি আন্তরিক হওয়া খুবই জরুরি। পাশাপাশি শর্টকাট পথে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়ে দ্রুত জনপ্রিয় শিল্পী হওয়ার বাসনা ত্যাগ করতে হবে। গুণী শিল্পী হতে হলে সাধনা করে হতে হবে নিয়ম মেনে, যার কোনো বিকল্প নেই!