সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং আজকের বাংলাদেশ
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যেকোনো ধরনের হামলায় জনগণের মনে নানাবিধ প্রতিক্রিয়া হয়। সেটা অমূলকও নয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো খুবই তাৎক্ষণিক এবং অনেকটা আবেগনির্ভর। বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বেশির ভাগ সময় আসল কথাটিই বলা হয়ে ওঠে না, কিংবা অনেক লতাপাতার ভিড়ে শিকড় খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে ওঠে।
আমাদের সস্তা আবেগের তোড়ে অনেকেই সুন্দর সুন্দর কিছু কথা বলি, ফেসবুক হ্যায় না? এখানে এসে সবাই কিছু ক্ষোভ প্রকাশ করে দায় সেরে ফেলি। আমিও দেখুন দুই লাইন পাণ্ডিত্য ঝেড়ে যাচ্ছি। বস্তুত, সবারই এক দশা, বুঝি। অসহায়ত্ব! নিদারুণ অসহায়ত্বে অন্ধকারের ভেতর তলিয়ে যেতে যেতে আমরা কেউ কেউ অরণ্যে রোদন করতেই থাকি।
কেউবা বলি, এমন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমাদের (!) যে এখানে এমনটি তো হয়ই না। হয়নি অতীতে। এসব গুটিকয় কুলাঙ্গারের কাজ কিংবা অধর্মের কাজ কিংবা তারা সত্যিকারের মুসলিম নয়। তারা এমন কাজ করতে পারে না। কেউবা একে সাম্প্রদায়িক হামলা বলার জন্য মরিয়া হয়ে প্রমাণের চেষ্টায় নিরলস পরিশ্রম করে যেতেই থাকি। কেউবা এতে রাজনীতির গন্ধ খুঁজি। এ খোঁজাখুঁজিই সার, আবার বছর ঘুরে যেই লাউ সেই কদু—থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর। আমরাও ভুলে যাব, প্রতিমা আবার ভাঙা হবে সোৎসাহে, আগুন আবার জ্বলবে।
প্রকৃত অর্থে সমস্যাটা কোথায়? এত মতামতের পেছনের মোদ্দাকথাটি কী? এটি কি আদতেই কোনো সমস্যা? ইয়েস অর নো? যদি একে সমস্যা হিসেবেই গুরুত্ব দিয়ে থাকি, সেই বিবেচনায় এর কারণ খোঁজা যেমন জরুরি, তেমনি একইভাবে সমাধানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণও অতি অত্যাবশ্যকীয় কাজ। অতি অবশ্যই আইনানুগভাবে সেই পদক্ষেপের সব দায়ভার রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সংগঠন প্রশাসনের ওপরই বর্তায়। একটি স্বাধীন দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের জানমাল, সম্পদ নিয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে, ধর্মপালনসহ যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করবে, সেটা তাঁর নাগরিক অধিকার। এখানে কে শ্রেষ্ঠ, কে বড়, কে ক্ষুদ্র এ–জাতীয় কোনো আলোচনার অবকাশ নেই। আর এই বক্তব্য সুস্পষ্ট করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের; তাঁর আইন, কাজ ও ন্যায়ানুগ আচরণ দিয়ে।
আর এ কথা বলাই বাহুল্য যে এ বাংলাদেশে প্রশাসন চাইলে কী কী করতে পারে, মাত্র কিছুদিন আগের পরীমণিসংক্রান্ত ঘটনাই তার দুর্দান্ত, জ্বলন্ত উদাহরণ। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সদিচ্ছায়, যৌথ উদ্যোগে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন অচিরেই বন্ধ করা সম্ভব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা দেখছি, এতগুলো ঘটনার পরও (সেই নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রামু, কুমিল্লা) রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকেও একটি আশ্বাস কিংবা হুঁশিয়ারি আসেনি নির্যাতিতের পক্ষে। কেন গুটিকয় সন্দেহভাজন, কুলাঙ্গার বারবার প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে একই কাজ করে পার পেয়ে যায়, সেটাই ভাবনার উদ্রেক করে অনেক বেশি। হতাশায় ডুবে যায় বাকি পথ, হারিয়ে যায় সামনে চলার যত শক্তি। ম্লান হয়ে যায় অন্য সব অর্জন। মহাকালের অন্ধকার জাঁকিয়ে বসে ভয়ের আঁধার হয়ে প্রাণের গভীরে।
কেউ কেউ অতি দুঃখে হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলেছেন। বস্তুত ঘটেছেও তা–ই। কিন্তু কেন? তারা কি এ মাটির সন্তান নয়? বাপ-দাদার চৌদ্দ পুরুষের মাটি ছেড়ে কেন পালাবেন সুধাংশুরা? এ দেশের মুক্তির লড়াইয়ে তাঁদেরও কি নেই অবদান? কেন ভীরুর মতো রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাবেন তাঁরা?
রাষ্ট্রের কাছে এর বিচার চাইতেই হবে। ন্যায্যতার অধিকার নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। মার যখন খেতেই হবে, তখন ঘরে বসে মুখ বুজে মার কেন খাবেন? শান্তির পথে, আইনের পথে, ন্যায্যতার পথে কাজ না হলে আসুন, কথা বলুন, শান্ত কথায় কাজ না হলে অশান্ত হউন, চীৎকার দিন, সমস্বরে আওয়াজ তুলুন।
রাষ্ট্রকে এর দায় নিতেই হবে। এর জবাবদিহি করতেই হবে যে রাষ্ট্র নিজেই নিজের কপালে ধর্মের টিকিট লাগিয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তাকেই প্রমাণ করতে হবে, এখন সব ধর্মের অধিবাসীরাই তার সন্তান। আইন তার নিরপেক্ষ গতিতে সবার জন্যই সমান বিচার করে। সেখানে দল-মত-ধর্ম কিছুই প্রাধান্য পায় না।
কেননা, দিন শেষে জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা নিশ্চিতভাবেই ‘সব’ জনগণের আওতাভুক্ত, এ কথা আশা করি রাষ্ট্র-প্রশাসনও বিশ্বাস করেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি—ধর্মনিরপেক্ষতায় বলা আছে, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা বিলোপ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার বিলোপ, কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে। তাহলে কী আমরা দেখছি, এই মূলনীতির প্রয়োগ হচ্ছে? না হলে কেন নয়? একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে সেই প্রশ্ন রেখে গেলাম।
পরিশেষে, এটুকুই বলতে চাই, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আজকের এ বাংলাদেশ দেখতে চাই না আমরা। আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। কাজ করতে হবে হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। বিশ্বের দরবারে টিকে থাকার লড়াইয়ে ধর্মবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার এ রকম নিন্দনীয় কর্মকাণ্ড আমাদের কেবল পেছনেই টেনে নেয়। পথ রোধ করে সামনে চলার পথে প্রাচীর তুলে দাঁড়ায় শক্ত হয়ে।
‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা,’
‘আলোহীনে আলো দাও প্রভু—জ্ঞানহীনে জ্ঞান।
জ্ঞানই পুণ্য, পুণ্য সে দানে—করো ধনবান।’
লেখক: সঙ্গীতা ইয়াসমিন, টরন্টো, কানাডা।