শ্রম, রক্ত, অশ্রুনায়কদের খবর কি কেউ রাখে?

প্রবাসী শ্রমিকেরা যে পদে পদে হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন, প্রতারিত হচ্ছেন—সে খবর নীতিনির্ধারকেরা কতটা রাখেন?
ফাইল ছবি

প্রতিক্ষণে প্রবাস থেকে দুঃসংবাদ আসছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বাংলাদেশকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কয়েক দিন পরেই ওমান, ইতালিসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশি  প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। গত বছরের মতো গত কয়েক দিনে করোনাভাইরাস প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে। অনেকে দেশে এসে আটকা, অনেকে ধারদেনায় জর্জরিত, অনেকে কাজ হারিয়ে দিশেহারা।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ রেমিট্যান্স আয়। সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধানতম খাত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এ প্রবাসীদের শ্রম-ঘাম, অশ্রুর সঙ্গে দেশের উন্নয়ন মিশ্রিত।

করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বজুড়ে বিধিনিষেধ এবং অচলাবস্থার কারণে বহুমাত্রিক সংকটে পড়েছে শ্রমশার্দূলরা। প্রবাসে বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা বেতন পাচ্ছেন না, আবার অনেকে ছাঁটাই এবং মজুরি হ্রাসের কবলে পড়েছেন। ১৬৯টি দেশে বাংলাদেশের হাজারো মানুষ কাজ করেন।

কয়েকটি দেশের প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের ঈদে চাকরি হারানো প্রবাসীদের অনেকেই এখন বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছেন না। দুবাইপ্রবাসী আবদুল্লাহ মিয়া জানান, প্রায় তিন মাস ধরে বেকার। আগে একটি কোম্পানিতে কাজ করতেন। মালিক একদিন এসে জানান, ‘আমার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না, তুমি অন্যত্র চাকরি দেখ। সে থেকে আমি বেকার জীবন কাটাচ্ছি।’ ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছেন না তিনি। তিনি আরও জানান, স্ত্রী ফোন করে বলেছেন সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

কুয়েতে কর্মরত আলাউদ্দিন গত মে মাসে জানান, কয়েক মাস ধরে তিনি দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। অনেক দিন ধরে বেতন–ভাতাও দিচ্ছেন না মালিক। কারণ, তিনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেটির ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। সৌদিপ্রবাসী রুবেল বলেন, ‘আমার পরিবার গ্রামে থাকে। টাকার জন্য মা ফোন দেন, আমি বলেছি কর্জ করে সংসার চালানোর জন্য।’ তিনি বলেন, গত বছর ঈদে কারও জন্য কিছু কিনে দিতে পারিনি, এ বছর আরও বড় সমস্যায় আছি। সৌদি আরবে আর কদিন থাকতে পারব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

কথা হচ্ছিল দক্ষিণ কোরিয়াপ্রবাসী মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, গত বছর কোরিয়া থেকে এসেছেন, এখনো দেশে কিছু করতে পারছেন না। জমানো টাকা খরচ করে সংসার চলছে, এভাবে জমানো টাকা খরচ করলে বেশি দিন টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। কোরিয়াপ্রবাসী আরেক প্রবাসী জহিরুল বলেন, ‘কোরিয়া থেকে এসে ১৪ মাস ধরে আটকে আছি, যা টাকা ছিল সব খরচ করে ফেলছি। অনেক ধার দেনাও করেছি। চরম অস্থিরতায় আমার দিন কাটছে।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিধিনিষেধ আর কড়াকড়িতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সব শ্রেণির প্রবাসীরা। এ ছাড়া ইউরোপের দেশেও মহামারির প্রভাব চরমে। কিছুদিন আগে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জার্মানপ্রবাসী জানান, দেশটিতে তিনি রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করেন। তাঁর দুটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, চলমান বিধিনিষেধে করোনাভাইরাসে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না, বছরখানেক ধরে বড়ই লোকসান দিচ্ছেন। দুবাই থেকে ব্যবসায়ী হাসান জানান, তিনি অনেক লোককে চেনেন, যাঁরা অর্ধেক বেতনে চাকরি করছেন। অনেকেই চাকরি হারিয়ে চরম সংকটে আছেন।

মোহাম্মদ নুরে আলম জর্ডানপ্রবাসী পোশাক ব্যবসায়ী। তিনি গত মে মাসে বলেন, ‘আমার নিজের কোম্পানি, প্রচুরসংখ্যক শ্রমিক আছে। জর্ডানে আমার কোম্পানি চালাতে সমস্যা হচ্ছে না। করোনাকালের প্রথম দিকে মনে করেছিলাম কর্মী ছাঁটাই করতে হবে, কিন্তু জর্ডান সরকারের সহযোগিতার কারণে তা করতে হইনি। বরং গত মাসে আরও ১৫০ জন নিয়োগ দিয়েছি।’

করোনাভাইরাস মহামারি এবং অচলাবস্থার কারণে বহুমাত্রিক সংকটে পড়েছে রেমিট্যান্স–শার্দূলরা। তাঁদের বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে এই খাতের সংশ্লিষ্ট সবাইকে।