শেষটা একটু অন্য রকম হতে পারত

আজ অনেক দিন পর সোনিয়া কারও জন্য সাজতে বসেছে। গত চার দিন আগে অফিস থেকে বর এসে একটা ইনভাইটেশন কার্ড দিয়ে গেছে। এই বিয়েতে সস্ত্রীক আমন্ত্রিত সোনিয়ার বর কামাল। সদ্য জয়েন করা এক্সিকিউটিভ অফিসার তানিম সাহেবের বিয়ের অনুষ্ঠানে সন্ধ্যায় এক নামকরা পার্টি সেন্টারে যেতে হবে।

ইনভাইটেশন কার্ডে যখন বরের নাম মাজহারুল আনোয়ার তানিম, পিতার নাম দেওয়ান হাবিবুর রহমান দেখে, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না, এই তো সেই তানিম। একটা সময় তার স্বপ্নের আকাশজুড়ে তার ওড়াউড়ি ছিল। তার সঙ্গে কথা বললে নাওয়াখাওয়া সব ভুলে যেত। একটা মুহূর্ত তার ভাবনা ছাড়া চলতে পারত না। আজ তানিমের বিয়ে। সেই মানুষটি আজ অন্যের হতে যাচ্ছে, আর সে নিজেই অনেক আগেই অন্যের হয়ে আছে।

মানুষের জীবনে কত কিছুই তো হয়। বদলে যায় হুট করে। এই মেঘ এই বৃষ্টি। অযাচিত এই জীবনে বিশেষ কেউ হুট করে জড়িয়ে পড়ে। এতটাই জড়িয়ে পড়ে যে তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত আর চলে না। তাকে ছাড়া জীবনের একটা মুহূর্ত কল্পনা করা যায় না। সে যে কখনো এই জীবনে থাকবে না, এই সত্য মেনে নেওয়ার মানসিকতা তখন থাকেও না। মনে হয় তার জন্মটাই আমার জন্য। আমি ছাড়া তাকে এই জগতে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। তার সবকিছুতে আমার একক অধিকার। এই একটা মানুষকে পাওয়ার কী তীব্র নেশা। তাকে নিয়ে স্বপ্নে সাজানো হয় লাল–নীল–হলুদ রঙের মিশেলে একটা বর্ণিল সংসার। এই অল্প সময়টুকুতে তার সঙ্গে কথা বলার সময় কত স্বপ্ন জুড়ে থাকে। এই সংসারের নতুন অতিথি মেয়ে না ছেলে হবে। নাম কী হবে! কত কত রঙের স্বপ্ন। এই স্বপ্নের পরিধী পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সোনিয়ার জীবনে এভাবে একদিন জড়িয়ে গিয়েছিল তানিম।

সোনিয়ার বর কামাল একটা অফিসের সিনিয়র অফিসার। আয় বেশ ভালো। সোনিয়াকে অনেক কেয়ার করে ঠিক, তবে অনেক সময় চুপচাপ থাকে। বেশ শান্ত স্বভাবের। দেখা গেল, টেবিলে বসে মোবাইল টিপতে টিপতে নীরবে ভাত খেয়ে চলে যাবে। ভালো–মন্দ কিছু বলবে না। সোনিয়া অনেক সময় জিজ্ঞেস করবে, আজ কী রান্না করব।

সোনিয়ার দিকে না তাকিয়েই বলবে, যা মন চায়। খাওয়া নিয়ে আমার আলাদা পছন্দ বা অপছন্দ নেই। সারা দিন অফিস থেকে ফিরে হয় ঘুমিয়ে যাবে, নাহয় বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় যাবে।

সোনিয়ার তখন বড্ড একাকী কাটে। তানিমের কথা তখন ভীষণ মনে পড়ে।

তানিম থাকলে নিশ্চয় তাকে একা রেখে যেত না। দুজন নদীর কূল ঘেঁষে হাত ধরে হাঁটত। সূর্যাস্ত দেখে রোজ বাড়ি ফিরত।

আজ কত দিন পর সাজতে বসছে কারও জন্য, ঠিক মনে করতে পারে না। প্রথম প্রথম বরের জন্য সাজত কিন্তু বর অফিস শেষে এসে খেয়ে দিব্যি ঘুমাত। তার দিকে তাকানোর সময় ছিল না। তাই অনেক দিন সে এ রকম করে সাজে না। তবে আজ তানিমের জন্য সে সাজবে। আয়নায় বেশ লম্বা সময় ধরে সাজে সোনিয়া। ওয়ার্ডরোব খুলে শাড়ি দেখতে লাগল। এরপর আসমানি রঙের শাড়িটা টেনে বের করল। শাড়িটার ওপর কালো ও রুপালি সুতো দিয়ে কাজ করা। আসমানি রঙের শাড়িটার সঙ্গে কালো রঙের ব্লাউজ পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টেনে টেনে চোখে কাজল দিল। গাঢ় নীল রঙের একটা টিপ পরল কপালে। ঠোঁটে লাল লিপস্টিকের ছোঁয়া, খোঁপায় টকটকে লাল গোলাপ ফুল ও পরে। তানিমের পছন্দের ফুল। আজ সবকিছুতে তানিমের পছন্দকে কেন সে প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে কী আজও তাকে সে খুব ভালোবাসে নাকি তানিমকে বুঝিয়ে দিতে চাইছে, তাকে হারিয়ে সে মস্ত বড় ভুল করেছে।

আজ বিয়ের আসরে তানিম তার দিকে বারবার ফিরে দেখুক। নিশ্চয় তানিম জানে না, সে আসবে। কার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, সে খবর নিশ্চয় তানিম রাখেনি।

ছেলেরা এত নিষ্ঠুর হয়। এত দিনের ভালোবাসা নির্দ্বিধায় ফেলে কী করে চলে যেতে পারল। আজকে সুযোগ পেলে জিজ্ঞেস করতে হবে, কেন সেদিন তাকে ছেড়ে হারিয়ে গিয়েছিল। কী তার অপরাধ ছিল!

সে দেখতে তো বেশ সুন্দরী ছিল। কলেজে ছেলেরা লাইন দিত প্রেমের জন্য। অথচ সে তানিমকে পছন্দ করে বসল।

আজ এত দিন পর কেন তবে তানিমের চোখে আরও সুন্দরী হওয়ার প্রয়াসে সে নিজেকে আয়নায় মেলে ধরেছে।

মোবাইল ফোন বেজে ওঠে এই অসময়ে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বরের আওয়াজ।

তুমি রেডি থেকো। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায়, আমি নিচে আসব। ফোন দিলে তুমি নিচে চলে এসো।

আচ্ছা ...ছোট্ট করে জবাব দিয়ে সোনিয়া ফোনটা রেখে দেয়। বিয়ের আজ চার বছর হলো। তাদের একটা বাচ্চা হয়নি। সোনিয়ার বরের সেদিকে খুব আকুলতা নেই। সে তার অফিস বন্ধুবান্ধব আর তার পরিবারের অন্য সদস্যদের ভালো–মন্দ নিয়েই আছে। তার কথা আল্লাহ যখন চাইবে, তখন দেবে। অনেকের নাকি দেরিতে বাচ্চা হয়। অথচ একজন সাথি থাকলে সোনিয়ার সময় ভালো কাটত। সারা দিন একা একা বাসায় থাকা খুব কঠিন হচ্ছে দিন দিন তার জন্য।

আজ তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে দেখানোর জন্য সাজছে। যাকে সে খুব বেশি ভালোবাসত কিংবা ভালোবাসে। আসলে যখন কেউ অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যায়, তখন নতুন করে আর কাউকে ভালোবাসা যায় না।
যা করা যায়, তা হলো সংসার।

সোনিয়া পার্টি হলের এক কোণে এসে টেবিলে একা বসে পড়ল। পুরো হল লোকে লোকারণ্য। যে যার মতো ব্যস্ত। কেউ সেলফি তোলায়, কেউ আড্ডা-গল্প, কেউ ফোনের স্ক্রিন দেখে বারবার ফাউন্ডেশন, লিপিস্টক ঠিক করা ইত্যাদিতে ব্যস্ত।

বর কোন এক বন্ধুকে নিয়ে অন্যদিকে গেছে। প্রধান ফটকের দিকে ফটোগ্রাফারদের জটলা দেখে বুঝতে পারল বর–কনে এসে গেছে। খুব মন চাচ্ছে তানিমকে দেখতে। কতটা বছর ওকে দেখিনি। কী এক অদ্ভুত তৃষ্ণা তার চোখজুড়ে। তানিমের কী এমন হয়!

না হওয়ার কথা। যে কোনো কারণ ছাড়া সব ছেড়ে যেতে পারে, তার নিশ্চয় এমন হওয়ার কথা নয়।

একটু অদূরে দাঁড়িয়ে বর–কনেকে দেখতে লাগে। আজ অনেক বছর পর তানিমকে দেখছে। কেমন যেন অস্থির লাগছে। এ অস্থিরতা কাউকে বোঝানো যাবে না।

তানিম যাকে বিয়ে করছে, দেখতে সে দারুণ। সোনিয়ার মনে হয় অল্প বয়সী মেয়েটা তার থেকে বেশ সুন্দরী। সুন্দরী না হলে কী তানিম বিয়ে করত।

হয়তো এই মেয়েটার সঙ্গে তার প্রেম ছিল। হয়তো ওর জন্য তাকে ছেড়ে গেছে। অবচেতন মনে হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু কে দেবে উত্তর।

আচ্ছা তানিম তো সে সময় গল্প–কবিতা লিখত। তাকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছে। এখনো কি সে লেখে?

জানতে মন চায় সোনিয়ার।

এই লোকারণ্যের মাঝে তানিমের মুখোমুখি হওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য। দেখা করা কী আদৌ ঠিক হবে কিছুই ভেবে পায় না সোনিয়া।

ইতিমধ্যে সোনিয়ার বর এসে গেছে, কই তুমি? কী কর একা একা?

কিছুই না। কাউকে চিনি না তো তাই এদিক–সেদিক ঘুরে দেখছি।

আচ্ছা চলো কনে দেখে আসি। তোমার সঙ্গে পরিচয়ও হয়ে যাবে।

বুকটা কেঁপে ওঠে সোনিয়ার। এত দিন পর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। পারবে কী নিজেকে ধরে রাখতে, কিছুই বুঝতেছে না।

এই তুমি কী এত ভাবছ, চল যাই। স্বামীর ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় সোনিয়া...হ্যাঁ, চলো।

তানিম আর কনে হাসিমুখে ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত। ক্যামেরা আর লাইটের আলোয় বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাকে।

সোনিয়ার বরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে তানিম...এ আমার স্ত্রী। সোনিয়ার বরের কথায় পাশে দাঁড়ানো সোনিয়ার দিকে এবার তানিম চোখ ফেরায়...হ্যালো, ভাবি কেমন আছেন?

হাসিমুখে জবাব দেয় সোনিয়া ভালো আছি।

অবাক করা বিষয়, তানিম তাকে চিনতে পারছে না। এ কী করে সম্ভব! মানুষ এত নিষ্ঠুর কী করে হয়। অন্তত চোখের দিকে তাকিয়ে হলেও তো চেনা যায়। তানিম একেবারে ড্যাম কেয়ার। না চেনার তীব্র চেষ্টা। বেশ অপমান লাগছে সোনিয়ার। এখান থেকে সরে যেতে পারলেই সে বাঁচে।

ভাগ্য ভালো, খাবারের জন্য কেউ একজন তাদের ডাকছে।

খাওয়াদাওয়া কোনো রকম করেই পার্টি সেন্টারের একেবারে ব্যালকনির দিকে এসে দাঁড়ায় সোনিয়া। বর অন্য কলিগ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মত্ত। সোনিয়ার মন ভারাক্রান্ত। কী করে পারল তানিম এভাবে ভুলে যেতে। সামান্য চিনতেও পারল না। ছেলেরা এত সহজে বদলে যায় কীভাবে।

কারও গলার আওয়াজে ফিরে তাকায় সোনিয়া।

ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে...তানিম তার সামনে দাঁড়িয়ে।

একনজর দেখেই আবার বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সোনিয়া...

মিনিট দু–এক কোনো কথা নেই। একদম চুপ। বোধ হয় দুজন দুজনকে বুঝতে সময় নিচ্ছে। তানিম নীরবতা ভাঙে...

তুমি কি এখন উল্টো আমাকেই চিনছো না, সোনিয়া!

সোনিয়া অভিমানভরা দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়, কত দিন পর তানিম নাম ধরে ডেকেছে...একটু আগে তুমি তো আমাকে চিনতে পারনি।

কামাল সাহেব যে তোমার বর, সেটা আমি জানতাম না।

জানলে নিশ্চয় দাওয়াত দিতে না। আমাকে দেখে হয়তো ভাবছ, বিপদে ফেলব, তাই না। ভয় নেই তানিম। আমি কাউকে কিছু বলছি না।

হু হু করে হেসে উঠল, তোমার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না। শুধু জানতে এসেছি কেমন আছ তুমি!

বেশ আছি তানিম। সেটা দেখতেই পারছ।

কামাল সাহেব বেশ ভালো মানুষ। তুমি ভালো থাকবে।

দূর থেকে কী সব বোঝা যায়?

সোনিয়া, তুমি কেন এসেছ আজ। না এলেই পারতে। আমাদের দেখা না হলেই বেশ ভালো।

অবিরাম আলত করে হেসেই যায় সোনিয়া। কিছুই বলতে চায় না। ভেতরের রক্তক্ষরণ সে বুঝতে দিতে চায় না।

তুমি কিছুই বলছ না কেন সোনিয়া?

আমার অনেক কথার তুমি উত্তর দিতে পারবে না তানিম। তাই কোনো কথাই বলছি না।

কী জানতে চাও তুমি! তোমাকে সেদিন কেন ছেড়ে গেছি!

হ্যাঁ, সেটাই। এত দিনের ভালোবাসা ছেড়ে হুট করে তুমি পালালে কেন?

সেটা তোমাকে বলতে চাই না। তুমি কী কখনো আমাকে ভুলতে দেবে না।

হা হা। হাসালে তুমি। কবেই তো ভুলে গেছ তুমি।

হ্যাঁ, আমি সত্যি ভুলে গেছি। ভালোবাসা আমার জন্য না। কখনো কাউকে ভালোবাসিনি। আমার জীবনে কখনো কেউ ছিল না। আজ থেকে নতুন একজন এসেছে। তাকেই আমি ভালোবাসব। সে–ই আমার ভালোবাসা। আমি চলে যাচ্ছি। এরপর আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। কিছু প্রশ্ন থাকুক তোলা।

কাপুরুষ একটা...তবুও ভালো থেকো তানিম। আমি আর কখনোই তোমার সামনে আসব না। তোমার সুখের ঘরে আমার জন্য কোনো ক্ষতি হবে না।

কোনো রকম অশ্রু লুকিয়ে তানিম এখান থেকে চলে যায়। কোনো উত্তর সে দেয় না। বলুক সে কাপুরুষ। তবুও যদি ভালো থাকে। কাউকে ভুলে থাকার একটা উপলক্ষ লাগে। তাকে কাপুরুষ ভেবে যদি সোনিয়া ভালো থাকে, তবে তাই ভালো। সে তো জানে তার ছেড়ে যাওয়ার কারণ। অথচ তানিম জানে কত কষ্ট হয়েছে তাকে ছেড়ে যেতে। তাকে ভুলে যেতে দিনের পর দিন নিজের প্রতি অনিয়ম করেছে, তবু ভুলে যেতে পারেনি। কেবল ভুলে থাকার কী নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছে। কনের পাশে এসে দাঁড়ায়। ফটোগ্রাফি চলছে আবার। তানিম শতকষ্ট বুকে নিয়ে হাসি হাসি মুখে দাঁড়ায়।

তানিম চলে যাওয়ার পর এত দিনের জমে থাকা অবহেলার স্তূপ, এক অসহনীয় ব্যথা একটু একটু তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে চায় না। বরকে মাথাব্যথার কথা বলে দ্রুত বিদায় নেয় সোনিয়া।

রুমে এসে কাপড় চেঞ্জ করে উত্তরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আজ তার মতো আকাশের ভীষণ মন খারাপ। আকাশ বেশ কালো হয়ে আছে। বৃষ্টি আসবে হয়তো।

বেলা দুইটা বাজে। বাসায় সোনিয়া একা। কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে। একটা পার্সেল এসেছে তার নামে। পার্সেলে ওপরে প্রেরকের নাম–ঠিকানা কিছুই লেখা নেই।

পার্সেল নিয়ে নিজের শোবার ঘরে আসে।

মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন এসে ভিড় জমায়। সব উপেক্ষা করে পার্সেল খোলে। একটা গল্পের বই কে জানি পাঠিয়েছে।

‘তুমি এলে বসন্ত ছুঁয়ে যায়’ নামের গল্পের বই। লেখকের নাম দেখে বুঝতে বাকি থাকে না। কে পাঠিয়েছে! তানিম পাঠিয়েছে। তবে কী তানিম আজও লেখালেখি করে। কই সে তো জানে না।

আস্তে আস্তে বইয়ের প্রথম পাতা উল্টাতেই নজরে আসে একটা চিরকুট....

ভাঁজ করা চিরকুট খুলে পড়তে শুরু করে সোনিয়া...

সোনিয়া,
আমাকে যখন তোমার খুব মনে পড়বে, এই গল্পের বইটি পোড়ো। আমার অনেক না–বলা কথা, তোমার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।

তবে আমি চাইব, আমাদের আর দেখা না হোক, কথা না হোক। আমাদের আর কখনো যোগাযোগ না হোক।

অবশ্যই তুমি ভালো থাকবে। আমিও ভীষণ রকম ভালো থাকব।

ইতি

তানিম।

চিরকুটটা পড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয় জানালা দিয়ে। যদি কখনো বরের চোখে পড়ে তাহলে সমস্যা হবে। এক জীবনে কত কী লুকাতে হয় সংসারের জন্য। সে জানে আর কখনোই দেখা হবে না তানিমের সঙ্গে। না হোক, না হওয়াই ভালো। কোনো প্রশ্নের উত্তর তার জানা লাগবে না। একটা ঘোর, একটা ভালো লাগা আজীবন থাকুক।

দুটি মানুষের মধ্যে কী অদ্ভুত মিল। যে জীবনে শুধুই যাকে চেয়েছে, তার পাশে এখন অন্য একটি মেয়ে জড়িয়ে থাকবে, একই বিছানায় ঘুমাবে, সে ভাবনায় এখন আর তার বিচলিত হওয়া ঠিক না। থাকুক সে ভালো। তার পাশেও তো অন্য একজন পুরুষ। নিশ্চয় তানিমেরও এমন কষ্ট হয়েছিল।

এক জীবনে হয়তো নতুন করে আর ভালোবাসা হবে না। যা হবে তার নাম সংসার।

শুধু এটুকু সোনিয়ার উপলব্ধি হয়, পৃথিবীতে একজন মানুষ আছে, যাকে ভালোবাসার পর নতুন করে আর কাউকে ভালোবাসার কোনো শক্তি থাকে না।

আচ্ছা! শেষটা যদি একটু অন্য রকম হতো, তবে কী খুব বেশি ক্ষতি হতো!

মনে মনে জিজ্ঞাসা সোনিয়ার। তাকে উত্তর দেওয়ার মতো কেউ নেই।

একটা সময় প্রিয় একটা মানুষকে নিয়ে কত রঙের স্বপ্ন দেখে মানুষ।

অথচ কী বিচিত্র মানুষের জীবন। একটা সময় এই স্বপ্নের মানুষ আর থাকে না। কারণে হোক আর অকারণে, সে চলে যায় দূরে বহুদূরে। সেখান থেকে আর ফিরে আসে না। ফিরে আসার সব পথ রুদ্ধ করেই তো যায়। কতশত আবেগের মোহ একদিন কেটে যায়। তাকে ছাড়া দিব্যি সংসার কেটে যায়। মনে যে পড়ে না তা কিন্তু নয়। সময়–অসময়ে সে হঠাৎ এসে জীবনটা কিছুটা অগোছালো করে দিয়ে যায়। ক্ষণিক ঝড় আসে, আবার সব শান্ত হয়ে যায়।

এককালের চিরচেনা মানুষটি কত সহজেই পর হয়ে যায়।

সোনিয়া এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে জলে চোখে ভরে গেছে খেয়ালই করেনি।