শেষ ঠিকানা

সিডনির কবরস্থান ক্যাসেলব্রুক মেমোরিয়াল পার্ক। ছবি: লেখক
সিডনির কবরস্থান ক্যাসেলব্রুক মেমোরিয়াল পার্ক। ছবি: লেখক

চরভবানীপুর গ্রামের ঠিক দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে প্রমত্ত পদ্মা নদী। আসলে এই গ্রামগুলো তৈরি হয়েছে পদ্মার বুকে চর জেগে, তাই প্রতিটি গ্রামের নামের আগে চর যুক্ত। ভবানীপুরের ঠিক দক্ষিণ–পূর্ব কোণের মাঠগুলোকে স্থানীয়রা খড়েরদাড়ি নামে ডাকে। এমন নামকরণের হেতু অবশ্য জানা যায়নি। আমাদের বাসা থেকে খড়েরদাড়ি যেতে হলে মাঝরাস্তায় একটা কবরস্থান পড়ে, স্থানীয়রা সেটা গোরস্থান নামে ডাকে। 

আমাদের মাঝেমধ্যে খেতে কাজ করতে যাওয়া মানুষের জন্য খাবার নিয়ে যেতে হয়। মাথার গামলায় থাকে ভাত, তরকারি আর হাতের জগে থাকে পানি। আমরা বাসা থেকে হেঁটে এসে কবরস্থানের ঠিক আগে থেমে যাই। কবরস্থান একা একা পার হতে ভয় লাগে। রাস্তাটা গেছে একেবারে কবরস্থানের পাশ দিয়ে, তাই অন্য কোনোভাবেও যাওয়া সম্ভব নয়। কবরস্থান জায়গাটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সেই জঙ্গল থেকে শিয়ালের প্রায়ই ডাক শোনা যায়।


মাঝেমধ্যেই শিয়ালগুলো রাস্তার ওপর এসে শুয়ে থাকে অনেকটা রোদ পোহানোর ভঙ্গিতে। এই শিয়ালগুলো সাধারণ শিয়ালের চেয়ে অনেক হৃষ্টপুষ্ট। সবাই বলে কবরস্থানের লাশ খেয়ে খেয়ে ওদের এমন স্বাস্থ্য হয়েছে। পাশ দিয়ে কেউ যাওয়ার সময় হুশহুশ শব্দ করে তাড়াতে গেলে নিতান্ত অনিচ্ছায় দুলকি চালে আবারও কবরস্থানের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

কবরস্থান বা গোরস্থান আমার স্মৃতিতে তাই ভয়ের জায়গা দখল করে আছে। কবরস্থান যে বেড়ানোর জায়গা হতে পারে, সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।

এরপর জীবনের গতিময়তা অনেক কিছুই শেখাল। বেশ কবার গোরস্থানে যেতে হয়েছে মানুষকে মাটি দিতে। আশপাশের গ্রামের কেউ মারা গেলে আমাদের আব্বা সবার আগে হাজির হন মৃতকে গোসল দেওয়ার জন্য। এযাবৎ আব্বা কত লাশকে গোসল দিয়েছেন, ঠিক জানি না। গোসল দেওয়া শেষ হলে বাসায় এসে আমাদের নিয়ে মাটি দিতে যেতেন। সাড়ে তিন হাত দৈর্ঘ্যের আর প্রায় দুই হাত গভীরতার কবর। প্রথমে লাশটাকে শুইয়ে দেওয়া হয়। মুখটাকে কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে পশ্চিম দিকে মুখ করে দেওয়া হয়। তারপর শুরুতে ওপর থেকে নিচ বরাবর কোনাকুনি বাঁশের চটাগুলো দেওয়া হয়। বাঁশগুলোকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে মাঝ বরাবর ফেঁড়ে এই চটাগুলো বানানো। বাঁশের চটা দেওয়া শেষ হলে তার ওপর কাশের একটা স্তর দেওয়া হয়, যাতে করে এরপর মাটি দিলে সেটা যেন কবরের ভেতর না ঢোকে। এরপর শুরুতে হুজুর এক মুঠো করে মাটি নেন আর দোয়া পড়েন তারপর মাটিটা কবরে দিয়ে দেন। ওনার এভাবে তিনবার দেওয়ার পর আমরা সবাই হাতের মুঠোয় মাটি নিয়ে নিতাম আর হুজুরের সঙ্গে সঙ্গে দোয়া পড়ে সেই মাটি কবরে দিয়ে দিতাম। এভাবে দেওয়া শেষ হলে যাঁরা কবর খোঁড়ার দায়িত্বে থাকতেন, তাঁরা বাকি মাটিগুলো দিয়ে দিতেন।

কবরস্থানের বাইরে বাড়ির মহিলারা এসে ভিড় করতেন কিন্তু ওনাদেরকে জোর গলায় কাঁদতে নিষেধ করা হতো। কারণ, তাহলে মৃত ব্যক্তি বেশি কষ্ট পাবেন। মাটি দেওয়া শেষ হলে সবাই আবার যাঁর যাঁর বাসায় ফিরে মুখরিত জীবনের কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

সিডনির ক্যাসেলব্রুক মেমোরিয়াল পার্কটি সাজানো–গোছানো। ছবি: লেখক
সিডনির ক্যাসেলব্রুক মেমোরিয়াল পার্কটি সাজানো–গোছানো। ছবি: লেখক

সিডনি আসার পর থেকেই কবরস্থানে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলাম। কারণটা পরে বলছি। একবার সুযোগ এসেও গেল। পরিচিত এক বড় ভাই মারা যাওয়ার পর ওনার লাশ দাফন করতে গেলাম। এখানকার ব্যবস্থা খুবই গোছানো। ভেকু (যান্ত্রিক খননযন্ত্র) দিয়ে কবর খোঁড়া হয় একটা নির্দিষ্ট গভীরতা পর্যন্ত। একজন মানুষের কবর হবে নাকি দুজনের, সে অনুযায়ী গভীরতা ঠিক করা হয়। তারপর ক্রেন দিয়ে কংক্রিটের চতুর্ভুজাকৃতির একটা বাক্স বসিয়ে দেওয়া হয় ওপরের ঢাকনাটা ছাড়া। এরপর লাশটা নামিয়ে ঢাকনা দুটো বসিয়ে দেওয়ার পর মাটি দেওয়া হয়। শুরুতে বাংলাদেশের নিয়মে মাটি দেওয়ার পর ভেকু দিয়ে বাকি মাটিগুলো দিয়ে কবরটা ভরে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে এর ওপরে আর কারও কবর দিতে চাইলে ওপরের মাটি সরিয়ে একই প্রক্রিয়ায় কবর খুঁড়ে লাশ দাফন করা হয়। এখানে কবরস্থানগুলো অনেক গোছানো এবং ছিমছাম। এখানে আগে থেকেই কবরস্থানের জায়গা কিনে রাখতে হয়। আর দাফনপ্রক্রিয়া সমাপ্ত করার জন্য আছে অনেক সুন্দর সুন্দর ফিউনারেল এজেন্সি। তাদের আছে হরেক রকম প্যাকেজ। আমি প্রতি মাসে অন্ততপক্ষে কোনো একটা ফিউনারেল এজেন্সি থেকে একটা করে কল পাই। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের অফারগুলো বলতে থাকে। কথার মধ্যেই আমাকে হুট করে লাইন কেটে দিতে হয় কারণ আমাদের সময়ের উচ্চমাধ্যমিকে পড়া ইংরেজি গল্প দ্য লাঞ্চনের নায়কের মতো আমার অবস্থাও 'আই এম টু ইয়াং টু সে নো'। আর মৃত্যু বিষয়টা অকাট সত্য হলেও সেটা নিয়ে কথা বলতে কেন জানি ভালো লাগে না। মনের মধ্যে একটা অবসাদ কাজ করতে শুরু করে।


প্রতি রোববার আমাকে সিডনির একটা সবার্ব 'দ্য পন্ডস'-এ যেতে হয়। প্রথম যেদিন সেখানে গেলাম, সেদিনই রাস্তার পাশে দেখেছিলাম 'ক্যাসেলব্রুক মেমোরিয়াল পার্ক'-এর নামফলক। নাম পার্ক হলেও এটা আসলে একটা কবরস্থান। কবরস্থানগুলোকে এখানে এমন সুন্দরভাবেই নামকরণ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা করে ফেললাম সেখানে যাওয়ার। কাজ শেষ করে গুগল ম্যাপে করবস্থানটার লোকেশন দিতেই আমাদের এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যেখান দিয়ে কবরস্থানে ঢোকা সম্ভব নয়, আগে হয়তোবা সেখান দিয়ে ঢোকা যেত। এরপরের রোববার বুদ্ধি করে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে ভেতরে ঢোকার অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেলাম। কবরস্থানের ভেতরে গাড়ি চলাচলের সুন্দর পিচঢালা রাস্তা আছে। আপনি আপনার সুবিধামতো যেকোনো রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করতে পারেন।
ভেতরে ঢোকার মুখেই ডিজিটাল বোর্ডে কবরস্থানে স্বাগত জানিয়ে বার্তা দেখানো হচ্ছে। এরপর একটা বড় গোলাকৃতির মোড় যেটাকে অস্ট্রেলিয়ার ভাষায় বলে রাউন্ড অ্যাবাউট। রাউন্ড অ্যাবাউটের এক পাশে একটা ভ্রাম্যমাণ ফুলের দোকান। সেখানে হায়দরাবাদের একটা ছেলে ফুল বিক্রি করছে। সবাই কবরস্থানে ঢুকে প্রথমেই তার কাছ থেকে ফুল কিনে নিচ্ছে, তারপর যার যার আত্মীয়–পরিজনের কবরে যাচ্ছে শ্রদ্ধা জানাতে। ছেলেটার সঙ্গে কথা হলো। সে আসলে একজন ছাত্র। এটা তার একটা খণ্ডকালীন কাজ।


অস্ট্রেলিয়ান একজন মালিক ফুলের এই ব্যবসাটা পরিচালনা করেন। ছেলেটা হায়দরাবাদ থেকে এসেছে বছর তিনেক আগে ছাত্র হিসেবে। কথায় কথায় বলল, ছাত্র হিসেবে অস্ট্রেলিয়া এলে গাধার খাটুনি খাটতে হয়। আমি আশা দিয়ে বললাম, ভেবো না, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তার সঙ্গে আলাপ শেষ করে আমি বেরিয়ে পড়লাম কবরস্থানটা ঘুরে দেখতে।

কবরে ফুল দেওয়ার জন্য দোকান আছে ক্যাসেলব্রুক মেমোরিয়াল পার্কে। ছবি: লেখক
কবরে ফুল দেওয়ার জন্য দোকান আছে ক্যাসেলব্রুক মেমোরিয়াল পার্কে। ছবি: লেখক

আমি সাধারণত মূল রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। তবে ভেতরে দেখার জন্য মাঝেমধ্যে সবুজ ঘাসের মধ্যেও নেমে পড়ছিলাম। তবে খুব সাবধানে পা ফেলছিলাম যাতে করে কোনো কবরের ওপর পা না পড়ে। প্রতিটি কবরের নামফলকগুলো আমাকে খুবই আকর্ষণ করছিল। এত সুন্দর সুন্দর কথা লেখা যে মনটাই ভালো হয়ে যাচ্ছিল। আমি বেশ কয়েকটা পড়লাম। সেগুলোর অর্থ করলে দাঁড়ায় 'এই কবরে শুয়ে আছেন একজন মা অথবা বাবা, যিনি অনেক ভালোবাসার মানুষ ছিলেন তাঁর পরিবারের কাছে।'


এ ছাড়া আছে পারিবারিক কবর। সেগুলো আকারে বেশ বড় এবং দেখতেও অনেক বেশি সুন্দর। কবরস্থানটাকে একেবারে পার্কের নকশার মতো করে সাজানো। এক একটা কোনায় একেক রকমের নকশার কবর বিদ্যমান। এ ছাড়া রয়েছে পাথরের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। অনেকগুলো কবরের বাইরে একেবারে বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের মতো প্রাচীর দেখলাম এবং তার গায়ে লেখা রয়েছে সেখানে কারা কারা শায়িত আছেন। খোলা বইয়ের পাতার মতো একটা স্মরণফলকে দেখলাম অনেকের নাম এবং বার্তা লেখা।


কবরস্থানের একেবারে পেছনের দিকে অফিস। অফিসের দুপাশের দুটো গাছের বাহারি রঙের পাতা জানান দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায় এখন রংবহুল শরৎকাল চলছে। এরপরই আসছে শীতকাল। তাই অনেক গাছের পাতা বর্ণিল রং নিয়ে ঝরে যাচ্ছে। পুরো কবরস্থানটা ঘুরে দেখতে আমার প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগল। খেয়াল করে দেখলাম সেখানে ক্রিস্টিয়ান ধর্মের লোক ছাড়াও বৌদ্ধ এবং মুসলিম ধর্মের মানুষের কবর আছে। আসলে অস্ট্রেলিয়াতে একই কবরস্থানে বিভিন্ন ধর্মের লোকের কবর দেওয়া হয়।
কবরস্থান ঘুরে দেখতে দেখতে অনেকের সঙ্গে কথা হলো। সবাই খুব আন্তরিকভাবে শুভেচ্ছা জানাল। প্রতি–উত্তরে আমিও তাঁদের শুভেচ্ছা জানালাম। কবরস্থানের বিভিন্ন জায়গায় লোহার রডের তৈরি খাঁচায় ফুলদানি রাখা। তবে খাঁচার গায়ে লেখা আছে কেউ যেন একটা কবরের জন্য চারটার বেশি ফুলদানি ব্যবহার না করেন। আর এসব ফুলদানির পাশেই পানির ট্যাপ। আপনি ফুলদানিতে ফুল নিয়ে ট্যাপ থেকে পানি নিয়ে সেটাকে কবরের পাশে গেঁথে দিতে পারেন। একটা জায়গায় দেখলাম একটা পরিবার এসেছে কবরস্থানের জায়গা কিনতে। সেটা নিয়ে একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করছেন।


কবরস্থানের প্রায় সব জায়গাতেই মানুষ এসেছে তাঁদের প্রিয়জনদের শুভেচ্ছা জানাতে। এক জায়গায় দেখলাম একজন যুবক একটা কবরস্থানের পাশে অনেকক্ষণ ধরে নীরব দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তোবা তিনি তাঁর বাবা বা মায়ের কবরের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন। খুব ইচ্ছা করছিল কারও সাথে আলাপ করতে।

অবশেষে একজনকে পেয়ে গেলাম। একজন প্রৌঢ়া খুব যত্ন করে একটা কবরের পাশে ফুল দিলেন। তারপর একে একে সেখানে রাখা অন্য ফুলদানিগুলো নিয়ে সেগুলোরও পানি বদলে দিলেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন উনি শেষ করেন তারপর আলাপ করব। ইতিমধ্যে পাশের একটা কবরে একটা পরিবার শুভেচ্ছা জানাতে এল। তাদের সঙ্গে দুটো ছেলে। একটার বয়স আনুমানিক বছর দশেক আর অন্যজনের বছর চারেক। তারা গাড়ি থেকে নেমেই নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দিল। মা–বাবাকে দেখে মনে হলো তারা সেটা নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নয়। তার মারামারি চলতে থাকল। বাবাটা গাড়ি থেকে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ চেয়ার বের করে সবাই মিলে একটা কবরস্থানকে কেন্দ্র করে বসলেন।


প্রৌঢ় ভদ্রমহিলার সবগুলো ফুলদানিতে পানি বদলে দেওয়া হয়ে গেলে আমি এগিয়ে গেলাম। উনিও বোধ হয় আমাকে আগেই লক্ষ করেছিলেন তাই আমার কাছে জানতে চাইলেন, তুমি হারিয়ে গেছ কি? উত্তরে আমি বললাম, না আমি আসলে হারিয়ে যাইনি। কবরস্থান বরাবরই আমার অনেক পছন্দের জায়গা তার দেখতে এসেছি।
এরপর জিজ্ঞেস করলাম এটা কার কবর।
উত্তরে উনি বললেন, এটা আমার মায়ের কবর। বলেই কবরস্থানের গায়ের ছোট একটা ঢাকনা সরিয়ে দেখিয়ে দিলেন ওনার মা–বাবার একটা যুগল ছবি। উনি বলে চললেন, এটা আমার মায়ের কবর। উনি আছেন নিচে, এরপর আমাদের বাবা মারা গেলে ওনাকে মায়ের ওপর কবর দেওয়া হবে।
আমি তখন প্রশ্ন করলাম আপনার মায়ের বয়স হয়েছিল কত? উনি বললাম ৯৭ বছর। আমি তখন ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে আপনার বয়স কত। উনি বললেন, আমার বয়স ৭৯। উন্নত বিশ্বের আসলে মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি।
আমাদের কথা এগিয়ে চলল।
আমি বললাম, এই যে দেখো দুনিয়াতে কত ভেদাভেদ আমাদের কিন্তু এখানে সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষ সহাবস্থান করছে। কেউ কারও শত্রু নয়।

সিডনির কবরস্থান ক্যাসেলব্রুক মেমোরিয়াল পার্কের কবরগুলোতে শুয়ে আছেন মা অথবা বাবা, ভাই, বোন যিনি অনেক ভালোবাসার মানুষ ছিলেন পরিবারের কাছে। ছবি: লেখক
সিডনির কবরস্থান ক্যাসেলব্রুক মেমোরিয়াল পার্কের কবরগুলোতে শুয়ে আছেন মা অথবা বাবা, ভাই, বোন যিনি অনেক ভালোবাসার মানুষ ছিলেন পরিবারের কাছে। ছবি: লেখক

উনি বললেন, একদম ঠিক বলেছ। অবশ্য ধর্মের এবং বর্ণের পার্থক্যটা প্রকৃতির একটা সৌন্দর্যও বটে।
আমি বললাম সেটা তো অবশ্যই, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের এগুলোকে পুঁজি করে যে পরিমাণ হানাহানি চলছে, দেখলে খারাপ লাগে।
উনি বললেন, কী আর করা যাবে বলো, এটাই জীবন।


আমি বললাম, মজার ব্যাপারটা খেয়াল করেছ? উত্তরে উনি আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি বললাম এই রাস্তাটার এক পাশে কবরস্থান, যেখানে সবাই স্থির হয়ে শুয়ে আছেন কারও কোনো তাড়া নেই কিন্তু ঠিক তার উল্টো পাশে মেট্রো রেলের লাইন যেখানে মানুষ ছুটে চলেছে জীবনের গতিময়তায়। এই কন্ট্র্যাসটটা আমাকে ভাবাচ্ছে যে আমরা যতই দৌড়াদৌড়ি করি না কেন, দিনশেষে আমাদের সবার ঠিকানা এই কবরস্থানে। উনি বললেন, একদম ঠিক বলেছ। উনি বললেন আমি আরও কিছুক্ষণ থাকব। আমি ওনাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ির কাছে ফিরে আসতে শুরু করলাম।

আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা বিষয় সব সময়ই বলি এবং বিশ্বাস করি সেটা হলো আপনি যদি আপনার জীবন নিয়ে বিভিন্ন রকমের জটিলতায় ভোগেন এবং জীবনযাপনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, তাহলে একটাবার হাসপাতাল অথবা কবরস্থান থেকে ঘুরে আসেন। তাহলে দেখবেন মনের মধ্যে শান্তি ফিরে আসবে। আপনি আবারও পুনরুদ্যমে জীবনের কর্মে ফিরে যেতে পারবেন। হাসপাতালে মানুষ জীবিত থাকার জন্য নিরন্তর যুদ্ধ করে চলেছে আর কবরস্থানে মৃত মানুষগুলো চিরতরে শুয়ে আছেন। তাই জীবনে আসলে হতাশ হবার কিছু নেই। জীবন চলবে তার নিজের নিয়মে। কখনো সেখানে আসবে জোয়ার, আবার কখনো সেখানে আসবে ভাটা। তাই বলে জীবনের হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আর জীবন শেষে আমাদের শেষ ঠিকানা বা পুনর্মিলনের জায়গা হচ্ছে এই কবরস্থান।