শেখ মুজিব যখন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ একজন কর্মী, তখন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা–ভাবনার ধরন কেমন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর অতি সরলীকরণ করে দেওয়া অনুচিত। আমরা তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তাঁর মানস জগতের যে খোঁজ পাই, তাতে চিন্তা ও বোধের ক্রমপরিবর্তনের বিষয়টি আঁচ করতে পারি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আমরা তাঁর অসংখ্য ভাবনা, পরিকল্পনা, পর্যবেক্ষণের কথা জানতে পারি। কিছু কিছু বামধারার রাজনীতিবিদ স্বাধীনতার আগে শেখ মুজিবকে ডানপন্থী, বুর্জোয়া শ্রেণির মুখপাত্র হিসেবে চিহ্নিত করতেন। ব্যক্তি শেখ মুজিবকে অনেক গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মূল্যায়নকারী ও গবেষকদের একটি সুবিধা ছিল, তাঁরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তাঁকে নানাভাবে চিত্রিত করতে পারতেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর জবানিতে লেখা এবং তাঁর দেওয়া তত্ত্ব ও তথ্যকে চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করেছেন এ রকম অনেক মানুষ বেঁচে আছেন। তাই এখন গবেষক ও মূল্যায়নকারীদের স্বাধীনতা কিছুটা খর্ব হয়েছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নেহাত একটি আত্মজীবনী হলেও বইটিকে আত্মজীবনী, ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা না করে আমাদের উপায় থাকে না।
যাই হোক, যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সে কথায় ফিরে আসি, শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত চিন্তার ধরন এবং তার একান্ত ভাবনাগুলোর দর্শন কেমন ছিল? আমাদের কাছে তাঁর একটি উপলব্ধি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। তাঁর ক্রমপরিবর্তিত মানসজগতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা এবং দর্শনের একটি আগাম ছবি যেন দেখতে পাই। ১৯৪৩ সালের কথা। শেখ মুজিবের বয়স মাত্র ২৩ বছর। পাকিস্তানের জন্ম হয়নি তখনো। তখন তিনি মুসলিম লীগের অতি সাধারণ একজন কর্মী। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কেউ নন তিনি। এই পর্যায়ের একজন কর্মী বাংলাদেশের গহিন জনপদ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে কলকাতায় দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে শুরু করেছেন। যে সময়ের কথা বলছি, তখন তিনি তাঁর নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে লঙ্গর খানাগুলোতে ত্রাণ বিতরণ করে বেড়াচ্ছেন। এ রকম সময়ে তিনি কী ভাবছেন?
শেখ মুজিবের স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে উপসংহারে হয়তো দেখা যেতে পারে, শেখ মুজিবের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি কিংবা বাংলাদেশের মধ্যে শেখ মুজিব।
মাত্র ২৩ বছর বয়সী শেখ মুজিব তখন মুসলিম লীগকে গণমুখী করে তোলার কথা আন্তরিকভাবে ভাবছেন। এ রকম ভাবনার সাহস তাঁর হয় কি করে? ‘অসমাপ্ত আত্ম-জীবনী’তে তিনি তাঁর ভাবনার কথা আমাদের জন্য এভাবে লিখে গেছেন, ‘…মুসলিম লীগের মধ্যে দুইটা দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটা প্রগতিবাদী দল, আর একটা প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় নাই। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কাউকেও লীগে আসতে দিত না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের দলেরাই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল।’
পাকিস্তানের জন্মের চার বছর আগে খান বাহাদুরদের বৃত্তাবদ্ধ্ব মুসলিম লীগকে প্রান্তজনের দলে রূপান্তরের ভাবনা ভাবছেন শেখ মুজিব। রাজনীতির ময়দানে তিনি তখন নবিশ। অন্তরে ভালোবাসা ও বোধবৃক্ষ বেড়ে উঠছে প্রান্তজনের প্রতি। শেখ মুজিবকে যখনই ঢালাওভাবে ভবিষ্যৎ কোনো মূল্যায়নকারী ডানপন্থী, বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করবেন, তখন তাঁর এই অকৃত্রিম, সৎ ভাবনা স্বেচ্ছাচারী মূল্যায়নের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের অনেকের কাছে মনে হয়, এই উপলব্ধিই হচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন প্রগতিমুখী হওয়ার টার্নিং পয়েন্ট।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে। এই ভাষা, সংস্কৃতির প্রশ্নের সঙ্গে নব্যউপনিবেশ স্থাপন ও শোষণের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা অনেক অগ্রসর বাঙালির বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ভাষা আন্দোলন যেমন ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, তেমনি তা ছিল অর্থনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে শেখ মুজিবের ভূমিকা কিছুটা অবগুণ্ঠিত ছিল। অস্পষ্ট, কুয়াশাচ্ছন্নও বলা যায়।
পরে আমরা দেখতে পাই, ভাষার প্রশ্নে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পাকিস্তানি শাসকদের অবস্থানের বিরুদ্ধে ডাকা ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবসে সবচেয়ে সক্রিয় সংগঠকদের একজন তিনি। আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় শেখ মুজিবকে আন্দোলনের সংগঠক ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখা যায়। পিকেটিংরত শেখ মুজিবকে, তাঁর ভাষায় পুলিশের ‘উত্তম মধ্যম’ হজম করতে হয়। নির্দয়ভাবে তাঁকে জিপে তুলে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কারাভোগের সময়ও তিনি সক্রিয়, বাইরের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। ভাষার জন্য গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের খবর পাই আমরা তাঁর আত্মজীবনীতে।
শেখ মুজিবের মতো একজন নেতার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ততার বিষয়টি আমাদের কাছে মোটেই পরিষ্কার ছিল না এবং এ নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। তিনি সে দায় মাথায় নিয়ে কুয়াশা সরিয়ে দেন। আমরা তাঁর জবানিতেই জানতে পারি, কীভাবে তিনি এই আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। যে পাকিস্তানের জন্য শেখ মুজিব মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে প্রাণপণ লড়াই করেছেন, সেই পাকিস্তান তাঁকে ভাষা আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে নির্যাতন করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। স্বপ্নের পাকিস্তানের মাটিতে তার প্রথম কারাবরণ, দূরবর্তী স্বপ্নের বাংলাদেশের পথের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।
মুজিব চরিত্রের স্বরূপ সন্ধানের জন্য ভবিষ্যৎ গবেষকেরা হয়তো বহুমাত্রিক ধারণা দেবেন। ইতিহাসের জল যখন স্থির হবে, তখন শেখ মুজিব আমাদের কাছে তাঁর প্রকৃত রূপ নিয়ে হাজির হবেন।
নির্মোহ একাডেমিক গবেষক কিংবা আবেগ মিশ্রিত বিশ্লেষণকারী, যারাই শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার যাত্রাকে মূল্যায়ন করবেন তাঁরা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের পথে পূর্ববাংলার সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাওয়াকেও সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবেন। একজন ব্যক্তি যখন সমষ্ঠিকে ধারণ করেন, তখন ব্যক্তি আর ব্যক্তির মধ্যে থাকেন না। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিশ্বনেতাদের আমরা এভাবেই দেখে থাকি। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে এর মাত্রার ব্যাপ্তি ছিল অনেক বেশি। ব্যক্তি যখন সমষ্টির প্রতীক হয়ে দাঁড়ান, তখন তাঁর চিন্তা, ভাবনা, ভাষা স্বপ্ন সমষ্টির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। তাই, আমরা দেখি শেখ মুজিবের ভাষা, যোগাযোগ ছিল অনন্য, এর সঙ্গে আর কোনো বাঙালি নেতার ভাষার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলায় শেখ মুজিবের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত দক্ষতা। সমসাময়িক মধ্যবিত্ত নেতাদের ভাষা জনগণের কাছে ছিল দুর্বোধ্য। অনেক গণমুখী তাত্ত্বিক নেতা নিজেদের মধ্যে রাতের পর রাত তত্ত্বের ফুলঝুরি ছুটিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কেউ জনগণকে বোঝার চেষ্টা করেননি। শেখ মুজিবের ভাষা এমনকি ইশারাও জনগণের কাছে বোধগম্য পর্যায়ের ছিল। তিনি একপর্যায়ে আর শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে থাকেন না। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের আপন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যান। তাঁর অকৃত্রিম আহ্বান সংবলিত ভাষা লক্ষ্য করুন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ শেখ মুজিব ছাড়া আর কেউ ‘দাবায়ে রাখতে পারবে না’—এ কথাটি এভাবে অনানুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে বলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। শেখ মুজিব যখন বলেন, তখন তার সব শব্দ হয়ে যায় কবিতা। বাঙালি তার কবিতার সবচেয়ে বড় পাঠক ও মনোযোগী শ্রোতা হয়ে পড়ে।
বাঙালি মননে হাজার বছর ধরে যে মানবতার বাণী ধ্বনিত হয়, তার বাহক হচ্ছেন শেখ মুজিব। চতুর্দশ শতাব্দীর বাঙালি কবি চণ্ডীদাসের উদাত্ত আহ্বান, ‘শুন হে মানুষ ভাই, সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’—সে কথারই প্রতিধ্বনি আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনতে পাই। তাঁর সব কর্মকাণ্ডের মর্মমূলে ছিল বাংলার সাধারণ মানুষ। সেখানে খান বাহাদুর, রায় বাহাদুরদের স্থান ছিল না। ১৯৪৩ সালে তিনি যেমন অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিদের মুক্ত করার ভাবনা ভেবেছিলেন, একইভাবে আমরা দেখি মৃত্যুর আগে তিনি আওয়ামী লীগকেও অভিজাত শ্রেণির কবল থেকে মুক্ত করার এক বৈপ্লবিক প্রয়াস হাতে নেন। যখনই তিনি রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেন তখনই দেশি–বিদেশি অভিজাতরা তাঁকে ঘিরে ধরে। জীবনভর সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তাদের সুস্পষ্ট লক্ষ্যে পরিণত হন তিনি। পরবর্তীতে তাঁকে এই গোষ্ঠীর হাতেই নির্মমভাবে জীবন বিসর্জন দিতে হয়।
শেখ মুজিবকে বুঝতে হলে বাংলাদেশকে বুঝতে হবে। তাঁকে নিয়ে গবেষণা করতে হলে বাঙালির ইতিহাস–ঐতিহ্যকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। চণ্ডীদাস থেকে নজরুল—এই পরম্পরায় বাঙালি মূল্যবোধ ও মননকে না বুঝলে শেখ মুজিবকে বোঝা কষ্টকর, কারও কারও কাছে তিনি দুর্বোধ্য হয়ে যেতে পারেন। একাডেমিক গবেষণা যদি একটি ফ্রেমের মধ্যে বন্দী হয়ে শেখ মুজিবকে বুঝতে চায়, তাহলে বিপদ হতে পারে। তিনি বাঙালি আবেগের মতো ফ্রেমে বন্দী বা বৃত্তাবদ্ধ্ব কোনো বাঙালি নন। চণ্ডীদাস থেকে নজরুল—এই পরম্পরায় বাঙালি মূল্যবোধ ও মননের ধারাবাহিকতা বহনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি এগিয়েছিলেন। তাকে বুঝতে হলে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের প্রকৃতি, বাংলার তেরো শ নদীর স্রোতের
গতি–প্রকৃতি, সবুজ ঢেউয়ের মতো স্থির হয়ে থাকা বাংলাদেশের পাহাড়কে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। শেখ
মুজিবের স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে উপসংহারে হয়তো দেখা যেতে পারে, শেখ মুজিবের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি কিংবা বাংলাদেশের মধ্যে
শেখ মুজিব। তাই, তাঁকে বুঝতে
হবে খুঁজতে হবে বাংলাদেশের ভেতর থেকে, আলধরা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে।