শুরু থেকেই প্রতিবাদ করতে হবে
এক বছর আগে একজন তাঁর মেয়ের বিয়ের সংবাদ দিতে গিয়ে বললেন, এত ভালো পাত্র সহজে পাওয়া যায় না। শিক্ষিত, ধার্মিক, নম্র, ভদ্র এবং পাত্র পক্ষের কোনো দাবি-দাওয়াও নেই; বলেছে একটা সুতাও দিতে হবে না। তাই তাড়াহুড়ো করে বিয়ে ঠিক করে ফেললাম।
পরে শুনি বিয়েতে সব ধরনের ফার্নিচার দিতে হয়েছে। কারণ পাত্রের মা ঘটককে বলেছেন, আমাদের কিছু না লাগলেও মেয়ের জন্য ফার্নিচার লাগবেই। ঘটকের মুখে এই কথা শুনে পাত্রীপক্ষ ফার্নিচারের সঙ্গে ফ্রিজ থেকে শুরু করে একটা সংসার করতে যা যা লাগে সব দিয়েছে। অন্যদিকে বিয়ের দিন পাত্রপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, মেয়ের পাওনা কাবিন নগদে এক পয়সাও দেওয়া হবে না। বাকি থাকবে।
বিয়ের পর মাসখানেক মেয়েটির ভালোই কেটেছে। এরপর থেকেই শুরু হয় নির্যাতন। কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে হওয়ায় বর পক্ষের আত্মীয়স্বজন কেউ মেয়ের বাপের বাড়ি দেখেননি। তাই পাত্র পক্ষের কাছের সব আত্মীয়দের পাত্রী পক্ষের আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে ঘরবাড়ি দেখাতে হবে। এটা নাকি রেওয়াজ।
করোনা মহামারির কারণে মেয়ে পক্ষ এসব আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে তাকে উঠতে বসতে কথা শোনানো হতো। ফলে পাত্রীর পরিবার আত্মীয়স্বজনকে বলে-কয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে দাওয়াত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে।
শ্বশুর বাড়ির রেওয়াজ মেনে নিয়ে এসব বিষয়ে মেয়েটিও কোনো টুঁ শব্দ করে না। এরপর শাশুড়ি-ননদ-জা মিলে শুরু করেন তার সবকিছুতে দোষ ধরা। স্বামীর সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়ার কোনো অধিকার তার নেই। বাড়ির সবাই ঘুমানোর আগে সে নিজের রুমের দরজা লাগাতে পারে না। তার স্বামীর কাছে এসব স্বাভাবিক ঘটনা। কোনো সময় তার স্বামী এসব নিয়ে কিছু বলতে গেলে, সবাই বলে বউয়ের কথায় সে পাল্টে গেছে। ফলে স্বামী বেশির ভাগ সময় এসব মেয়েলি ব্যাপার বলে এড়িয়ে যায়।
স্বামী আবার চায় না স্ত্রী এসব তার পরিবারের কারও সঙ্গে শেয়ার করুক। তাই সে কাউকে কিছু জানায় না। স্বামীকে খুশি করতে মেয়েটি তার ফেসবুক ডিঅ্যাকটিভেট করে ফেলে, পুরোনো ফোন নম্বরও পাল্টে ফেলে। আপ্রাণ চেষ্টা করে শ্বশুর বাড়ির সব নিয়ম মেনে চলতে। কিন্তু তার ওপর নির্যাতন কমে না, বরং দিন দিন বাড়তে থাকে। শেষে সহ্য করতে না পেরে এক বছর পরে পরিবারকে সব জানায়।
এ ঘটনা শুনে মনে হচ্ছিল, কেউ যদি একজনকে খোঁচালেই কিছু আদায় করতে পারে, তো করবে না কেন? যেখানে ঘটককে শুনিয়ে দিলেই ঘরভর্তি ফার্নিচার পাওয়া যায়, করোনার লকডাউনের মধ্যে পুরো গোষ্ঠীর জন্য দাওয়াত আদায় করা যায়। যা বলা হয় মেয়ে বা মেয়ে পক্ষ সব মেনে নেয়, সেখানে তারা আদায় করবে না কেন?
মেয়েটা কি বলতে পারত না, দাওয়াত খাওয়ানো তোমাদের নিয়ম হলেও আমাদের নিয়ম না। বিয়ের আগে কি বলতে পারত না, ফার্নিচার না নিয়ে গেলে যদি শ্বশুর বাড়িতে মাটিতে থাকতে হয়, তাহলে যৌতুক দিয়ে আমি সেই পরিবারে যাব না? মুসলিম বিয়ে আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং একটা চুক্তি। সেই চুক্তিতে শুধু কাবিন নিয়ে দর-কষাকষি না করে, বিয়ের পর জীবনযাপনের শর্তগুলো তো যোগ করা যায়। যেমন—বিয়ের পর যে মেয়ে পড়াশোনা করতে চায় সে করবে, যে চাকরি করতে চায় সে তা করবে। যে যৌথ পরিবারে থাকতে চায় না সে আলাদা থাকবে। এসব শর্ত মেনে যে এগোনোর এগোবে, যে মানতে পারবে না সে সরে যাবে। তাহলে আর পরে এসব নিয়ে কোনো পক্ষের বলার কিছু থাকবে না।
বিয়ের পর প্রতিটি মেয়েরই উচিত নিজের ব্যক্তিত্ব সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া। যা করা সম্ভব না, তা প্রথম থেকেই পরিষ্কার বলে দেওয়া, এতে কে খুশি হলো আর কে বেজার হলো তা নিয়ে চিন্তার কোনো মানে নেই। কারণ সবাইকে খুশি করা কারও পক্ষেই সম্ভব না।
সব নির্যাতনকারী কিন্তু গায়ে গতরে শক্তিশালী না। বরং এরা যখন কোনো কিছু চাপিয়ে দিয়ে দেখে অন্য পক্ষ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিচ্ছে তখন তারা মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ক্রমাগত নিপীড়ন বাড়াতে থাকে।
পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পর ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন মাত্র ২০০ ইংরেজ আর ৫০০ দেশি সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেন জয়ী ব্রিটিশ কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ। তাঁদের দেখতে আশপাশে জড়ো হয়েছিল মুর্শিদাবাদের হাজারো মানুষ। ওই ঘটনা সম্পর্কে ক্লাইভ নিজেই লিখেছেন, ‘স্থানীয় ওই মানুষগুলো যদি ইউরোপিয়ানদের ধ্বংস করতে চাইত, তাহলে শুধু লাঠি আর পাথর মেরেই তা করতে পারত’ (সূত্র: দ্য ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া, ভলিউম ১০, দ্বিতীয় সংস্করণ)। কিন্তু তাঁরা কিছুই না করে নিজেদের দেশে ব্রিটিশদের মেনে নিয়েছিল প্রভু হিসেবে, যার ধারাবাহিকতায় পুরো ভারতকে বরণ করতে হয়েছিল ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন।
নির্যাতন মেনে নিলে নির্যাতন থামে না, বরং নিজেকে দুর্বল হিসেবে উপস্থাপনের কারণে নির্যাতনকারীর সাহস বাড়তে থাকে। অন্যায়ের প্রতিবাদটা করতে হয় প্রথম থেকেই। নিজের ওপর অন্যায়ের প্রতিবাদ সবার আগে নিজেকেই করতে হয়। কারণ যে চুপ করে সবকিছু মেনে নেয় তার জন্য কারও বিশেষ কিছু করার নেই।