শিশুর জীবন করো রঙিন
একটি ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। সেখানে বই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে সোনার শিশুরা। এগোচ্ছে তারা আনন্দে। গালভরা হাসি। উচ্ছল তাদের জীবন। তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে ভালোবাসা। আজ তাদের কণ্ঠে নতুন খবর। সুর আর ছন্দের সে বার্তা, ‘শোনো তোমরা, আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন।’ তাদের আকুলতা প্রকাশ পায় তালে লয়ে—রঙিন করো শিশুর জীবন। স্লোগান নয়, কাব্যময় এই উচ্চারণ।
কোথায় সে বর্ণিল ব্যানার, বলতে পারেন? হ্যাঁ, ঠিকই ধরতে পেরেছেন আপনি। না গিয়েও বুঝতে পেরেছেন, এটা দূতাবাসের আয়োজন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে সেদিন আলোচনা সভা বসেছিল। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান সভাপতিত্ব করেন এ আয়োজনে।
১৭ মার্চ রোববার। সকালেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। দূতাবাস ছাড়াও বাংলাদেশ বিমান, জনতা ব্যাংক, বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, যুবলীগ, প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু এ পর্বে যার যার পক্ষ থেকে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
ওই দিন একটু আগেভাগেই আসে এক দল শিশু। তাদের পরিচয় বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল। পুষ্পার্ঘ্য নিয়ে তরতর করে বাস থেকে নামে তারা। ওরা শ্রদ্ধা ঢেলে দিল বঙ্গবন্ধুর পাদপদ্মে।
বাংলাদেশ সমিতি এল। মোয়াজ্জেম হোসেন এই সংগঠনের সভাপতি। তিনি দাঁড়ালেন ফুলের স্তবক নিয়ে। তাঁর সঙ্গে সংগঠনের অন্য সদস্যরা। তাঁরা শ্রদ্ধা জানালেন বঙ্গবন্ধুকে।
শুরুতে ছিল দূতাবাস। এরপর পর্যায়ক্রমে এল অন্যান্য সংগঠন। ক্যামেরা জ্বলে ওঠে। আনন্দময় হয়ে ওঠে সময়টি। বঙ্গবন্ধু পরিষদ। দলে-বলে কম নয়। সংগঠনের প্রধান ইফতেখার হোসেন। গভীর শ্রদ্ধা তাঁর চোখে-মুখে। পুষ্পার্ঘ্য রাখলেন বেদিতে। চরাচর বলল, ‘বঙ্গবন্ধু তুমি মহান, তোমারই উদ্দেশে “ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা......তোমার পানে, তোমার পানে”।’
এক কিংবদন্তির নাম বঙ্গবন্ধু। তিনি ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমৃদ্ধ একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁরই দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
আয়োজনের আলোচনা পর্বে বাণী পাঠ করা হয়।
রাষ্ট্রপতির বাণী পড়েন দূতাবাস মিনিস্টার শহীদুজ্জামান ফারুকী। প্রধানমন্ত্রীর বাণী পড়েন লেবার কাউন্সেলর আবদুল আলীম মিয়া। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পড়ে শোনান দুই প্রথম সচিব রিয়াজুল হক ও মোহাম্মদ যোবায়েদ হোসেন।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। চোখ ভিজে যায় আনন্দাশ্রুতে।
কী শোভা-কী ছায়া গো...কী আঁচল বিছায়েছ...।
অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান ভালোবাসার কথা বললেন। বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভালোবাসতেন। তিনি ছড়ার লাইন তুলে ধরলেন। তাঁর নিজেরই লেখা। বিষয় বেসাত-বিত্তর পেছনে ছোটে সবাই, কিন্তু ছড়ার কথা আলাদা। বঙ্গবন্ধুর চেতনা প্রতিধ্বনি হোক প্রতিটি হৃদয়ে। এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করলেন তিনি। মহানায়কের একটি গানের সুর বাজে মনে। ‘নয়নসমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর জন্ম। সে জন্য বাঙালির কাছে এ এক পুণ্যভূমি। মধুমতীর পারের এ জনপদ প্রকৃতিগতভাবে শান্ত। এখানকার গাছেরা মাথা নুইয়ে মাটিকে শ্রদ্ধা জানায়। কিন্তু ভেতরে লালন করে বারুদ। সে তার হন্তারকের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু এই গুণটি পেয়েছিলেন। শৈশব থেকে তিনি মানুষের কাছাকাছি থেকেছেন। শিশু মুজিব তাঁর বই দিয়েছেন সহপাঠীকে। কখনো বৃষ্টিতে দিয়েছেন ছাতা। তবে অধিকার আদায়ে ছিলেন আপসহীন। চল্লিশের দশকে তরুণ বয়সে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সংস্পর্শে আসেন। সম্পৃক্ত হন রাজনীতিতে। হে মহাজীবন...স্বাগত জানায় পৃথিবী।
রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান বলেন, বাংলাদেশে যা কিছু অর্জন সবকিছুর পেছনে বঙ্গবন্ধুর অবদান। বঙ্গবন্ধুর জীবনেতিহাস বাংলার ইতিহাস। ঠিক তা-ই। কোথায় নেই তিনি? ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন—সবটিতে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনসহ বাঙালির মুক্তি আর অধিকার আদায়ের প্রতিটি ধাপে তিনি নেতৃত্ব দেন।
রাষ্ট্রদূত বলেন, দেশে-বিদেশে নন্দিত এক নাম শেখ মুজিব। ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর সম্পর্কে অসমান্তরাল এক মন্তব্য করেছিলেন, ‘হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।’ বুঝিয়েছেন, হিমালয়সমান ব্যক্তিত্বের মানুষটির সান্নিধ্য পেয়েছেন। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী, অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি...।’
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু অগ্নিময় এক ভাষণ দেন। এ তাঁর বজ্রকণ্ঠ। তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মূলত এটা ছিল স্বাধীনতার ডাক। ২৬ মার্চ জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতি অর্জন করে আলাদা এক ভূখণ্ড, একটি পতাকা।
বক্তব্য দেন বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা। বিমান বাংলাদেশের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক নিদান বড়ুয়া গভীর শ্রদ্ধা জানান জনকের প্রতি। জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আবদুল হাই বলেন, বঙ্গবন্ধুই এ দেশে জনতা ব্যাংক খোলার দেন-দরবার করে দেন। প্রিয়াঙ্কা খোন্দকার শিশুর মা হিসেবে শিশুদের বেড়ে ওঠার ওপর গুরুত্ব দিলেন। ওরাই ভবিষ্যৎ। বলেন, ওদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ুক বাঙালির অস্তিত্ব।
ইফতেখার হোসেন শিশুদের কথা বললেন। তারা নিষ্পাপ। শিশুকে ভালোবাসা না দিলে ফুলের গন্ধ নেওয়া যায় না। তাঁর প্রশ্ন, যারা শিশুদের আদর করতে জানে না, তারা মানুষকে ভালোবাসবে কী করে!
রাষ্ট্রদূত মা-বাবা হিসেবে শিশুদের প্রতি যত্ন নিতে আহ্বান করলেন। তারা যেন অনলাইনে সঠিক বিষয়টি বেছে নেয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে জানার ও দেখার সুযোগ আছে। সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুকে পাচ্ছি। ছোটরা এর মধ্য দিয়ে এই আলোকে গড়ে উঠবে, এই আশা তাঁর।
অনুষ্ঠানের পর্দা পড়ে। তবে সবার মধ্যে কিছুটা তড়িঘড়ি লক্ষ করা যায়। কারণ, এরপরই আবার স্কুলের আয়োজন। আমিও বেরিয়ে পড়ি। আমার প্রার্থনা শুনি আমার কানে, একটি সুর বাজে, ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’...।