শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। চিরন্তন সত্য এই কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কম আর বেশি সব শিশুদের মধ্যেই ভবিষ্যৎ আছে, থাকবে। কিন্তু যে ভবিষ্যতের কথা আমরা বিবেচনায় আনি তা হলো উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ। শিশুদের মধ্যে সুন্দর, উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ যদি আমরা সত্যিই দেখতে চাই, তবে তাদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে সবার আগে। সুশিক্ষিত হতে হলে বেশি বেশি বই পড়ার বিকল্প নেই। কারণ বইই হলো একমাত্র মাধ্যম যা মানুষকে প্রকৃত জ্ঞানী করে তোলে। জ্ঞানার্জনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। আর এই বইপড়া নিয়েই আমাদের যত গড়িমসি। তাই, বই পড়তে শিশুরা যেন গড়িমসি না করে তার বিহিত ব্যবস্থা করা আবশ্যকীয়।

বই খোঁজায় ব্যস্ত এক শিশু
বই খোঁজায় ব্যস্ত এক শিশু

গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা

কোনটি সবচেয়ে মহত্তর কাজ। ধনার্জন নাকি জ্ঞানার্জন? এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও সৈয়দ মুজতবা আলীর দেখানো পথটি কিন্তু জ্ঞানার্জনের কথাই বলে। তিনি একজন আরব্য পণ্ডিতের বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘ধনীরা বলে, পয়সা কামানো দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন কর্ম। কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন, না জ্ঞানার্জন সবচেয়ে শক্ত কাজ। এখন প্রশ্ন, কার দাবিটা ঠিক, ধনীর না জ্ঞানীর? আমি নিজে জ্ঞানের সন্ধানে ফিরি, কাজেই আমার পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া কঠিন। তবে একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, সেটা আমি বিচক্ষণজনের চক্ষুগোচর করতে চাই। ধনীর মেহনতের ফল হলো টাকা। সে ফল যদি কেউ জ্ঞানীর হাতে তুলে দেয়, তবে তিনি সেটা পরমানন্দে কাজে লাগান এবং শুধু তা-ই নয়, অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, জ্ঞানীরা পয়সা পেলে খরচ করতে পারেন ধনীদের চেয়ে অনেক ভালো পথে, ঢের উত্তম পদ্ধতিতে। পক্ষান্তরে, জ্ঞানচর্চার ফল সঞ্চিত থাকে পুস্তকরাজিতে এবং সে ফল ধনীদের হাতে গায়ে পড়ে তুলে ধরলেও তারা তার ব্যবহার করতে জানে না। বই পড়তে পারে না।’ তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা একটি ধনী জাতি গড়ে তুলতে পারি, কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে বই পড়ার প্রতি গুরুত্ব দিতে না পারলে আমরা একটি সুশিক্ষিত জাতি উপহার দিতে পারব না। আর এটা যদি আমরা আজকের শিশুদের জন্য করতে না পারি তবে আজকের শিশুরা এমন এক ভবিষ্যৎ হবে যাদের হাতে জ্ঞানচর্চার ফল বই তুলে ধরলেও তারা তার ব্যবহার করতে জানবে না। সে জন্য অধিকতর জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা হিসেবে শিশুদের জন্য বই পড়ার সুব্যবস্থা থাকা উচিত। স্বল্পপরিসরে নিজ নিজ বাড়িতে শিশুদের জন্য বই পড়ার সুব্যবস্থা ব্যক্তিগতভাবে দু-একজনের পক্ষে করা সম্ভব হলেও সকলের পক্ষে তা অসম্ভব। সে জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, প্রয়োজন অধিকসংখ্যক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা।
গ্রন্থাগার হলো জ্ঞানের সমুদ্র যেখানে অবগাহন করে জ্ঞান পিপাসুরা তাদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মিটাতে পারেন। আলোকিত মানুষ তৈরি করতে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের ছোট বড় শহরে অসংখ্য গ্রন্থাগার রয়েছে যা মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। কিছু কিছু গ্রন্থাগারে শিশুদের জন্য সীমিত পরিসরে ‘শিশু কর্নার’ থাকলেও শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার বাংলাদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র শিশুকিশোরদের মাঝে বই বিতরণের মাধ্যমে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। তা সত্ত্বেও স্বতন্ত্রভাবে শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশেই শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার আছে। অন্যান্য দেশে গড়ে ওঠা শিশু গ্রন্থাগারের আদলে বাংলাদেশের শিশুদের জন্য উপযোগী গ্রন্থাগার গড়ে তোলা আবশ্যক। শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার গড়ে তোলার মাধ্যমে শিশুদের বইমুখী করে তাদের সুন্দর, উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব।

তামাগাওয়া শিশু গ্রন্থাগারের মূল ফটকের কাছেই নানা ধরনের চিত্রকলা
তামাগাওয়া শিশু গ্রন্থাগারের মূল ফটকের কাছেই নানা ধরনের চিত্রকলা

দেশে দেশে গ্রন্থাগার

পৃথিবীর বহু দেশে শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল ও ভারতেও শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার রয়েছে। এসব গ্রন্থাগারে শিশুরা তাদের বয়স অনুযায়ী সব ধরনের বই বা বিনোদনমূলক উপকরণ পেয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় অবস্থিত ‘Queens Library’ এমন একটি গ্রন্থাগার যেখানে শিশুদের জন্য রয়েছে বই পড়ার সুব্যবস্থা। শিক্ষামূলক বা বিনোদনমূলক ভিডিও দেখার ব্যবস্থা, খেলার সুবন্দোবস্ত, বাচ্চাদের স্কুল থেকে দেওয়া ‘Homework’ করতে সাহায্য করার ব্যবস্থাসহ আরও অনেক কিছু। শিশুদের জন্য এই গ্রন্থাগারের সেবার পরিধি শুধুমাত্র বই পড়া বা সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এর সেবার পরিধি আরও ব্যাপক। বাচ্চাদের বাবা-মার জন্য রয়েছে পরামর্শ কেন্দ্র; তাঁরা কীভাবে তাঁদের বাচ্চাদের দেখভাল করবেন, কীভাবে বাসায় পড়াবেন, বাচ্চাদের সঙ্গে কীভাবে সময় কাটাবেন, গল্প করবেন, আরও নানা রকমের পরামর্শ সেবা। তা ছাড়া অভিবাসীর দেশ আমেরিকায় যারা নতুন তাদের জন্যও রয়েছে অভিবাসন সংক্রান্ত পরামর্শের ব্যবস্থা। এক কথায় বলা চলে একের ভেতর অনেক।
কানাডায় শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার না থাকলেও বিভিন্ন গণগ্রন্থাগারে শিশুদের জন্য যে কর্নার রয়েছে তা বহু দেশের মূলধারার গণগ্রন্থাগারের চেয়েও অনেক বড়, আকর্ষণীয় ও মানসম্মত সেবায় ভরপুর। যেমন ভ্যাংকুভার গণগ্রন্থাগার বিভিন্ন বয়সের শিশুদের জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। ৩-৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য ‘Storytime’ যেখানে বাচ্চাদের অভিভাবকরাও অংশগ্রহণ করে থাকেন এবং বাচ্চাদের গান, কবিতা আবৃত্তি এবং গল্প বলা উপভোগ করেন। আবার ১৮ মাস থেকে ৩ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য রয়েছে ছড়া ও গল্প বলার আসর, গান কিংবা খেলনা দিয়ে খেলার মতো নানা ধরনের কার্যক্রম। ভিন্ন আঙ্গিকে একই ধরনের কার্যক্রম রয়েছে আরও ছোট বাচ্চা যারা নবজাতক থেকে ১৮ মাস বয়সী তাদের জন্য। এক কথায় অসাধারণ পদক্ষেপ যা বাচ্চাদের শিখতেও যেমন সাহায্য করবে তেমনি আত্মবিশ্বাসী হতেও।
অস্ট্রেলিয়াতেও শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার ও বড় গণগ্রন্থাগারে শিশুদের কর্নার রয়েছে। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ কানাডার মতোই বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাদের জন্য বিভিন্নরকম কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। অধিকন্তু, সময়-সময় বিভিন্ন জনপ্রিয় লেখকদের সঙ্গে বাচ্চাদের আড্ডার ব্যবস্থাও করে থাকে। এসব আড্ডায় লেখক তার জনপ্রিয় কোনো উপন্যাস বা শিশুসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন এবং বিভিন্ন গল্প বলেন। এতে করে শিশুরা বিখ্যাত ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসে এবং বড় রকমের অনুপ্রেরণা পায় যা পরবর্তীতে তাদের জীবনে প্রতিফলন ঘটে।
ভিবাহ কামাতের ভারতের মুম্বাইয়ে বাস। পেশায় ভাষা শিক্ষক। শিশুভান নামক একটি স্কুলে ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখান। পরিবারের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। সাত বছরের ভাগনে নীলও থাকে ক্যালিফোর্নিয়ায়। ভাগনে নীলের প্রতিদিনের কাজের মধ্যে গণগ্রন্থাগারে যাওয়াও একটি। সেখানে শিশুদের বই পড়ার জন্য বিভিন্নরকম অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়। তেমনি গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে যদি কেউ নির্দিষ্ট সংখ্যক বই পরে তবে তাকে ক্যালিফোর্নিয়ার মেয়রের স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। একসময় ক্যালিফোর্নিয়ার মেয়র ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার। তার স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট পেতে যে কারও মন চাইতেই পারে। নীল গ্রীষ্মের ছুটিতে ২০টি বই পড়ে পেয়েছিল মেয়রের স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট।
শিশুদের মধ্যে এভাবে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার পন্থাটি ভিবাহ কামাতের মনে ধরে। তিনি মুম্বাইয়ে শিশুদের জন্য একটি গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে চান। ভিবাহ কামাতের ছিল আরও দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এর একজন সনাল বিমল যিনি পেশায় কনসালট্যান্ট, আর অন্যজন হলেন ভাইশালি সিন্দে যিনি পেশায় একজন দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। ভিবাহ কামাত তার পরিকল্পনা বন্ধুদের বললেন। বন্ধুরাও ভিবাহ কামাতের এমন সুন্দর পরিকল্পনা শুনে আনন্দিত হন এবং শিশুদের জন্য গণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় গড়ে মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় গড়ে তোলেন ‘Local Public Library for Children’. বর্তমানে এই গ্রন্থাগারে চার হাজারের বেশি বই আছে যার অধিকাংশই নতুন। শিশুরা যাতে এই গ্রন্থাগারে পড়তে আসে সে জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে করে শিশুরা পড়তে আগ্রহী হয়, তাদের মধ্যে তৈরি হয় পড়ার আনন্দ।
জাপানের ওসাকা প্রিফেকচারের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত প্রশিক্ষকদের সহযোগিতায় ২০০১ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে প্রতিষ্ঠিত হয় Nepal-Japan Children Library. শিশুরা যাতে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা অর্জন করতে পারে সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪-১৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, টেক্সট বইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, এবং ‘পড়াই আনন্দ’ এই বার্তা সব শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রন্থাগারটি দিনদিন শিশুদের মাঝে জনপ্রিয় হচ্ছে। বই পড়ার পাশাপাশি শিশুরা সেখানে শিক্ষামূলক খেলনা দিয়ে খেলাধুলা, শিক্ষামূলক ভিডিও দেখা, কম্পিউটার চালনাসহ ইন্টারনেট ব্যবহারও করতে পারে। এর ফলে শিশুরা শুধু বই পড়াই নয়, কারিগরি শিক্ষায়ও দক্ষ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
এশিয়ার অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র জাপান। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে জাপানের রয়েছে বেশ পুরোনো ঐতিহ্য। নবম শতকের গোড়ার দিকে স্কুলভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন শুরু হলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছতে লেগে যায় আরও কয়েক শতক। ১৮৫৮ সালে জাপানে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যার নাম KEIO UNIVERSITY. ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি জাপানে শিক্ষা বিস্তারে রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা। তার কিছুকাল পরেই ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় TOKYO UNIVERSITY যা বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে কোনো গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত না হওয়াতে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারকেই জাপানের সবচেয়ে পুরোনো গ্রন্থাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
সেদিক থেকে বিবেচনা করলে জাপানে পুরোনো গ্রন্থাগারের বয়স ১৩৯ বছর। সারা বিশ্বের গ্রন্থাগারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ১৩৯ বছর খুব একটা বেশি নয়। তা সত্ত্বেও এই স্বল্প সময়ে জাপান গ্রন্থাগারের বহুমাত্রিকতায় বেশ এগিয়ে। প্রায় সব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে তাদের নিজেদের গ্রন্থাগার। গ্রাম, ছোট-বড় সব শহরেই রয়েছে একাধিক গ্রন্থাগার। রয়েছে বিশেষায়িত গ্রন্থাগার যেমন শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার। শিশুদের জন্য গ্রন্থাগারগুলো সুসজ্জিত, পরিচ্ছন্ন, এবং বইয়ের সংগ্রহও বিশাল। রয়েছে ভিডিও দেখার ব্যবস্থা যেখানে শিশুরা নিজেদের পছন্দের শিক্ষামূলক ও বিনোদনমূলক ভিডিও দেখতে পায়।
তা ছাড়া গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ প্রায় প্রতিদিনই শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক ও বিনোদনমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে আড্ডা (ইংরেজি ও জাপানি)। রাস্তা পারাপারের নিয়মকানুন ও এর ওপর আলোচনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকেন সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের বড় কোনো কর্মকর্তা। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ও এর ওপর আলোচনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকেন এই বিভাগের কোনো কর্মকর্তা। ৩ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বিজ্ঞানের এমন ব্যাবহারিক ক্লাস এমনভাবে করা হয় যার মাধ্যমে শিশুরা শিখতেও পারে আবার আনন্দও করতে পারে। স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনাও করা হয়। শিশুদের বাবা-মায়েরা শিশুদের সঙ্গে এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন বিশয়ে জ্ঞানার্জন করে থাকেন যা বাস্তব জীবনে কাজে লাগে।

তামাগাওয়া শিশু গ্রন্থাগারের মূল ফটকের কাছেই নানা ধরনের চিত্রকলা
তামাগাওয়া শিশু গ্রন্থাগারের মূল ফটকের কাছেই নানা ধরনের চিত্রকলা

সরেজমিনে শিশু গ্রন্থাগার

সম্প্রতি জাপানের ইশিকাওয়া প্রিফেকচারের কানাজাওয়া সিটিতে শিশুদের একটি গ্রন্থাগার আমার পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল। গ্রন্থাগারটির নাম হলো তামাগাওয়া শিশু গ্রন্থাগার। শিশুদের জন্য উপযুক্ত করে তৈরি করা চেয়ার টেবিল, বইয়ের তাক, দেয়াল লেখন, মাল্টিমিডিয়া রুমসহ সবকিছুই পরিপাটি এবং শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণে সচেষ্ট। বইয়ের তাকগুলো এমন উচ্চতায় করা হয়েছে যেন ৩-৫ বছরের শিশুরা সহজেই তাদের পছন্দের বইটি তুলে নিতে পারে। পাশেই সুসজ্জিত ছোট ছোট নানা রঙের চেয়ার সারি বেধে রাখা আছে যেখানে শিশুরা স্বপ্রণোদিত হয়ে পড়তে বসে যায়। পড়া যেন তাদের ছুটির দিনের বা অবসরের বিনোদন।
বইপড়া একটি বড় বিনোদন যদি সেটি বিনোদন আকারে উপস্থাপন করা হয়। বাচ্চাদের কিছু কিছু গল্পের বই মাল্টিমিডিয়ায় ডিভিডিতে দেখা যায়। বাচ্চারা যারা এখনো পড়তে পারে না তারা অথবা পড়তে পারে কিন্তু অধিকতর আনন্দ লাভের জন্য অপেক্ষাকৃত বড়রাও ডিভিডির মাধ্যমে বড় পর্দায় দেখে থাকে। এতে করে শিশুরা অনুক্ত জ্ঞান (Tacit Knowledge) আহরণেও সচেষ্ট হয়। তাই গ্রন্থাগার শুধু নিরানন্দ বই পড়ার জায়গা নয়, আনন্দের ফোয়ারাও বটে!
উল্লিখিত বিভিন্ন দেশের গ্রন্থাগারের মতো জাপানের এই শিশু গ্রন্থাগারটিও বিভিন্ন রঙ্গে-রূপে সজ্জিত এবং বিভিন্ন ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে শিশুদের গ্রন্থাগার পরিদর্শনে আগ্রহী করে তোলে। যেদিন আমি ওই গ্রন্থাগারে যাই সেদিন শিশুদের বিনোদন দেওয়ার জন্য জাদু প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়েছিল। পুরো আয়োজনটিই ছিল ৩-৫ বছরের শিশুদের উপযোগী জাদুশিল্প প্রদর্শনী। মজার ব্যাপার হলো দু-একজন বাদে সবাই ছিল শিশু জাদুশিল্পী। জাদু প্রদর্শনী দেখে বাচ্চারাও যেমন আনন্দ পেয়েছে, তেমনি আনন্দ পেয়েছেন বাচ্চাদের অভিভাবকেরাও। একই প্রদর্শনী দিনের বিভিন্ন সময়ে প্রদর্শন করা হয়ে থাকে যাতে সেসময়ে আসা বাচ্চারা উপভোগ করতে পারে।
তামাগাওয়া শিশু গ্রন্থাগারের সংগ্রহে শুধু জাপানি বইই নয়, পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার বই রয়েছে। এর মধ্যে চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনামের ভাষাসহ ইংরেজি ভাষা উল্লেখযোগ্য। তাই বিদেশি দর্শনার্থীরা চাইলে কিছু কিছু বই মাতৃভাষায় পড়তে পারে। ভাষাভাষীর দিক থেকে সপ্তম (কারও কারও মতে পঞ্চম) স্থানে অবস্থানকারী বাংলা ভাষার কোনো বই সেখানে পাইনি। এটা একটু মন খারাপ হওয়ার মতো ব্যাপার।
গ্রন্থাগারটির বিশাল দেয়ালে বিভিন্ন ভাষায় ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি রংবেরঙের কালি দিয়ে লেখা আছে। এত বিশাল দেয়ালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেও বাংলা ভাষায় লেখা ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি পাওয়া গেল না। এবারও হতাশ হলাম, তবে হাল ছাড়িনি। স্পষ্ট করে লিখে দিয়ে এলাম আর আবেদন করে এলাম বাংলাভাষায় ‘ধন্যবাদ’ শব্দটিও যেন দেয়ালে স্থান করে নেয়। আশাকরি কর্তৃপক্ষ কথা রাখবেন। পরবর্তী পরিদর্শনে হয়তো ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি দেয়ালে দেখতে পাব। আশা করছি একটু ব্যস্ততা কমলে একদিন গ্রন্থাগারে বাংলা ভাষার ওপর একটি সেমিনার আয়োজন করব।

বই পড়ায় মগ্ন এক শিশু
বই পড়ায় মগ্ন এক শিশু

বাংলাদেশে কি স্বতন্ত্র শিশু গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা সম্ভব?

অবশ্যই সম্ভব, সে জন্য দরকার প্রবল ইচ্ছাশক্তি। সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো উদ্যোগেই শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার হতে পারে। ওপরে সংক্ষেপে অনেক গ্রন্থাগারের মডেল উপস্থাপন করা হলো। বাংলাদেশের সার্বিক চাহিদা আর পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে শিশুদের জন্য একটি গ্রন্থাগার শুরু করা যেতে পারে। বাংলাদেশে জাপানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি শিশু রয়েছে। এদের বইপ্রেমিক করে গড়ে তুলতে হলে বেশি বেশি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা দরকার, বিশেষভাবে শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার। দেশে যে হারে বোমাপ্রেমিক (জঙ্গি) বাড়ছে তাতে করে শিশুদের জন্য মহল্লায় মহল্লায় গ্রন্থাগার তৈরির উদ্যোগ নিয়ে বইপ্রেমিকের সংখ্যা না বাড়ালে আমাদের সামনে আরও সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে।

*তথ্যসূত্র ইন্টারনেট ও তামাগাওয়া শিশু গ্রন্থাগার।