শিল্পী হচ্ছেন রস স্রষ্টা, শিল্পকলার উৎকৃষ্ট কারিগর। মনের চেতনায় যিনি শিল্পবোধ সৃষ্টি করেন তাঁর রং-তুলির স্পর্শে পৃথিবী ও প্রকৃতির ছাপছবি মানুষের অন্তরকে ঋদ্ধ করে তোলে। মনন ও সৃজনের সোপানে শিল্পীর সৃষ্টি সম্ভারে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়। শিল্পের মাধ্যমে লোভ, হিংসা, দ্বেষ, জিঘাংসা, মানুষের প্রতি অমানবিক নির্যাতন, মনুষ্যত্ব-বিনাশী নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ প্রতিবাদ প্রকাশ করা হয়।
শিল্প নানা রকমের হতে পারে। সাহিত্য, সংগীত ও কবিতার মতো শিল্পের বহুমাত্রিক ভাষা আছে। শৈল্পিক নৈপুণ্য প্রকাশের সুযোগ আছে। আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শিল্পকলা ও শিল্পের রূপায়ণে শিল্পীর মন ও স্বভাব।
শিল্পী কী চান? তিনি কি শুধু নিজের সুন্দর কাজকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন? শিল্পী তার শিল্পের মাধ্যমে অন্যের হৃদয়কে নাড়া দেন। অন্যের হৃদয়কে স্পর্শ করার চেষ্টা করেন। শিল্পী চান মানুষের ভেতরের মানুষকে আবিষ্কার করতে। আসলে একজন শিল্পীর সুখ, আনন্দ তৃপ্তির বৈচিত্র্য সম্ভারের মাধ্যমে পৃথিবী, প্রকৃতির সুন্দরতম দিকগুলো ফুটে ওঠে। তেমনই মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার ভেতরে স্থায়ী আসন গেড়ে নিতে পারলেই একজন শিল্পীর পূর্ণতা আসে, মানবভুবন নির্মল ও শান্তিময় হয়ে ওঠে। মানুষের অন্তরে প্রেম ও ভালোবাসার সৌন্দর্য ভরে ওঠে কানায় কানায়। সমাজ ও দেশ সচকিত সৌকর্যময় হয়ে ওঠে। শিল্পী মানসে সৃজনের যে শক্তি আছে, এর মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ সাধনই তার প্রধান লক্ষ্য।
একজন সত্যিকার শিল্পী চোখের মণিতে পৃথিবী, প্রকৃতি, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, প্রাণীকুল এবং মাটি ও মানুষকে ধারণ করেন। প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে মানুষকে জুড়ে দিতে চান। চোখের আলোয় দেখতে পান মানুষের মন। এটি শিল্পীর স্বভাবসিদ্ধ কাজ। শিল্পের দ্বারা পরিলক্ষিত হয় বৈচিত্র্যের বহুরূপ অবলোকন।
সম্প্রতি নিউইয়র্কে একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিউইয়র্কের মেলা চলাকালে নির্ধারিত স্কুলের বেসমেন্টের একটি কক্ষে এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্জন অগম্য আন্ডারগ্রাউন্ড স্থান নির্বাচন ছাড়া প্রদর্শনীটি কোনো জনসমাগম স্থলে হতে পারত। তবুও চিত্র প্রদর্শনীটি ছিল আমার কাছে আকর্ষণীয়। মনে হলো, গিয়ে ঠকিনি। কারণ, সাত শিল্পীর ৪টি করে ২৮টি বিশেষ ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল।
এ কারণেই হৃদয়ের টানে মেলায় গিয়ে কিছুক্ষণ ছিলাম। সেখান থেকেই আবার আটলান্টিক সিটির বঙ্গ সম্মেলনে যোগ দিতে চলে যেতে হয়েছিল।
চিত্র প্রদর্শনীর ওই ৭ শিল্পীর ৫ জনই আমার স্বজন ও ঘনিষ্ঠ। তাঁরা হলেন—বিশ্বজিৎ চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান রোকন, সৈয়দ আজিজুর রহমান, কায়সার কামাল ও জেবুন্নেছা হেলেন। তাঁরা সবাই সৃজনধর্মী মেধাবী ও মননশীল শিল্পী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছেন। তাঁদের আঁকা ছবির সংখ্যা অনেক। ঢাকার বড় গ্যালারি ছাড়াও নিউইয়র্কের ‘সোহ’ এলাকা ও মিডটাউনের গ্যালারিপাড়ায় তাঁদের ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। এঁদের মধ্যে বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কায়সার কামাল, মাহমুদুল হাসান রোকন এবং আলম টিপু মিলে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড সিটিতে ‘আর্টিস্ট রান’ নামে একটি গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশেষ করে বিশ্বজিৎ চৌধুরী ও কায়সার কামাল জুয়েল যে শ্রম ও মেধার পরিস্ফুটন ঘটিয়েছিলেন; তার তুলনা হয় না। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন জেবুন্নেছা হেলেন ও মাহমুদুল হাসান রোকন। গ্যালারিটি এতই সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক ছিল যে তা কখনো ভুলবার নয়। এতে তাঁদের শিল্প মন ও স্বভাবের একটি পরিচ্ছন্ন ছাপ ছিল।
সেখানে নিউইয়র্কে মূলধারা ও বাংলাদেশের বিখ্যাত আর্টিস্টদের প্রদর্শনী হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সেই গ্যালারিটি তাঁরা স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে পারেননি।
যাই হোক, এবারের সদ্য অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহণকারী আরও দুজন ছিলেন কানিজ আকবরী ও রুদ্র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তাঁরা আমার পরিচিত না হলেও তাঁরা যে নামীদামি শিল্পী সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেরই ছবি ঢাকা ও নিউইয়র্কের কয়েকটি বিখ্যাত প্রদর্শনীতে একাধিকবার প্রদর্শিত হয়েছে। পুরো আমেরিকায় তাঁদের সমসাময়িক একটি আর্টিস্ট গ্রুপ আছে। এর মধ্যে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশি আমেরিকান আর্টিস্ট ফোরাম’ নামে একটি শক্তিশালী সংগঠন গত কয়েক বছর ধরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন আরও বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান আর্টিস্ট। ‘আর্টিস্ট ফোরাম’ বিভিন্ন সিটিতে অবস্থানরত আর্টিস্টদের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্রষ্টা ও আলোকিত মানুষের মশালবাহী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ওই প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন।
চিত্র প্রদর্শনীর নেতৃত্বে থাকা কায়সার কামাল জানান, উল্লেখিত ৭ শিল্পীর ছবি ছাড়াও দর্শকদের মধ্য থেকে তাৎক্ষণিক আঁকা ছবি পাশের দেয়ালে প্রদর্শিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল নতুন প্রজন্মকে শিল্পের দিকে আগ্রহী করে তোলা। এরই ধারাবাহিকতায় নতুনদের অনেকেই চিত্রাঙ্কনে অংশ নিয়েছেন। এটা নিশ্চয়ই একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। চিত্রাঙ্কন শুধু ফ্যাশন আর বিনোদনের জন্য নয়, এটি মানুষের জীবনের অনুষঙ্গ। পৃথিবীর প্রায় দেশেই শিক্ষায় চিত্রকলা বিভাগ চালু আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট এখন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অনুষদ। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিল্পীদের উদ্যোগে বহির্বিশ্বে চিত্র প্রদর্শনী আয়োজন আমাদের শেকড় সন্ধানী মনকে উচ্ছ্বসিত করে তোলে। বর্তমানে আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের আর্টিস্টদের মাধ্যমে চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেটি খুব খুশির খবর।