শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম

টরন্টো ফিল্ম ফোরাম প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়
টরন্টো ফিল্ম ফোরাম প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়

বিজয়ের ৪৮ বৎসর। আমরা গর্ব করতেই পারি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের লাল-সবুজের পতাকা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বিশেষ দিবসগুলোতে। আমরা প্রজন্ম কিংবা আগামী দিনের তরুণ—ফেসবুকে পতাকা হাতে প্রোফাইল পিকচার আপডেট করা হয়ে গেলে, আসুন আমাদের ভাবনায় আপলোড করি সেই দিনটির কথা।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। বাংলাদেশের পূর্ব দিগন্তে আঁধার ভেদ করে রক্তিম আভা ছড়িয়েছে মাত্র। সাত কোটি মানুষ রক্তলাল এক সূর্যের অপেক্ষায়। বিজয়ের ঠিক দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর নেমে আসে এক ভয়াবহ কৃষ্ণপক্ষ। সেদিন দেশের সর্বোচ্চ মেধার অধিকারী মানুষদের, গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে মাইক্রোবাসে করে তুলে নেয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসর আলবদর-আল শামস বাহিনী। তাঁদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাড়ি থেকে।

মাথা উঁচু করে সেই বীরেরা সেদিন দেশ মাতৃকার জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। রেখে গিয়েছিলেন এক ধ্বংস প্রায় দেশ। বলে গিয়েছিলেন আগলে রাখতে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল আমরাই গড়তে পারব।

সেই সূর্যসন্তানদের আত্মত্যাগের দিনটিকেই আমরা বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে জানি। বিজয়ের আনন্দের ভাঁজে-ভাঁজে বিষাদ কালো রাত। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বরে তারা আসেন চুপিচুপি আমাদের বিবেকের বন্ধ দরজায়, যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছেন প্রাণ।

বুদ্ধিজীবীদের স্ত্রী-সন্তানেরা কোনো অভিযোগ-অনুযোগ ছাড়াই, শোক গোপন করে, তাদের বাবা-চাচা-ভাইদের এই আত্মত্যাগ হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন; একটি অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা দেখবেন বলে। বিজয়ের ৪৮ বছর। আর কত দিন লাগবে বুঝতে?

কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেই দেশপ্রেমিক মানুষগুলো, দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করে গেছেন। অনায়াসেই তাঁরা সীমান্ত পাড়ি দিতে পারতেন। হাতের মুঠোয় মৃত্যু নিয়ে যে মানুষগুলো লড়ে গেছেন পাকিস্তানি আর রাজাকারদের বিরুদ্ধে; সেই সংগ্রামী মানুষদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে, তাঁরা মাটি আঁকড়ে থেকেছেন। যারা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তখনো বেঁচে ছিলেন, আতঙ্কে বিনিদ্র রাত যাপন করছিলেন দেশের ভেতরে, তাদের সেই যন্ত্রণার কথা লিখতে গিয়ে থেকে গিয়েছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সার। ঘাতকেরা নির্মমভাবে, সেই কলমের কালিকে রক্তাক্ত করেছিল সেদিন।

টরন্টো ফিল্ম ফোরাম প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়
টরন্টো ফিল্ম ফোরাম প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়

পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকেই এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের আঞ্জাম দিতে থাকে। একে একে হত্যা করা হয় অসংখ্য গুণী মানুষদের। নির্যাতনের বীভৎসতা কতটা নৃশংস ছিল, সেলিনা পারভীনের মুখ থেকে নাক আলাদা করা হয়েছিল যাতে, তাঁকে চিনতে না পারা যায়। রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল বধ্যভূমি।

সুতরাং আমাদের বুঝতে হবে, আজকের দিনে যারা বুদ্ধিকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তারা সেই বুদ্ধিজীবী নন। তবে কারা এরা?

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির এই সূর্য সন্তানদের সংজ্ঞায়িত করেছিলেন বুদ্ধিজীবী। শব্দটি একটি কনসেপ্ট। একটি আদর্শ। ১৪ ডিসেম্বর যে বুদ্ধিজীবীদের আমরা স্মরণ করি, তাঁরা ছিলেন সমাজের আদর্শ, সমাজের বিবেক, সৎ-উদার-নির্লোভ-নিরহংকার, সহিষ্ণু-পরোপকারী-দেশপ্রেমিক-ধর্মীয় সংকীর্ণতামুক্ত-বিজ্ঞানমনস্ক এবং সর্বোপরি সংস্কৃতিমান। যারা বিশ্বাস করেছিলেন, দেশটা আমাদের হাতে দিয়ে গেলে ভালো থাকবে।

অতীত ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নাতীত। স্বাধীনতার দাবি একদিনে আসেনি, তাকে তৈরি করতে হয়েছিল; এর জোগালি ছিলেন এই সূর্যসন্তানেরা। প্রজন্ম হিসেবে আমাদের তা জানতে হবে।

বুদ্ধিজীবীদের অনেক কাজই আমাদের আড়ালে রয়ে গেছে এখনো। বুঝতে হবে, কতটা বিশ্বাস নিয়ে তাঁরা এই দেশটা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। আসুন তবে, দেশে-প্রবাসে আমরা যে যেখানেই আছি, দুফোটা অশ্রুর দর্পণ দিই তাঁদের উদ্দেশ্যে।

প্রতিবছরের মতো এবারও টরন্টো ফিল্ম ফোরাম ১৪ ডিসেম্বর হিমের রাতে প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। এ আয়োজনে আমরা শরিক হয়েছিলাম সর্বস্তরের মানুষ।

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করে যাচ্ছে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম।

আসুন শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার রক্তাক্ত অধ্যায়কে নিজে জানি ও জানাই প্রজন্মকে। প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের পঙ্‌ক্তিতে অভিশাপ দিই তাদের, যারা আমাদের কলিজায় সেঁটে দিয়েছে একখানা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ।

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: <[email protected]>